যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ‘ডুব’র অস্কার যাত্রা কী অবৈধ?

লিমন আহমেদ
লিমন আহমেদ লিমন আহমেদ , বিনোদন প্রধান
প্রকাশিত: ০৫:০৭ পিএম, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর চলচ্চিত্র ‘ডুব’। নানা বিতর্কের মুখে মুক্তি পেয়েছিল ছবিটি। তেমন ব্যবসায়িক সাফল্য না আসলেও বেশ প্রশংসিত হয়েছে এর নির্মাণ ও কলাকুশলীদের অভিনয়।

ছবিটি এবারের ৯১ তম অস্কারের আসরে বিদেশি ভাষার প্রতিযোগিতায় লড়াই করার জন্য বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত হয়েছে। গতকাল রোববার রাজধানীর এক রেস্তোরাঁয় এই ছবির নাম ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের অস্কার কমিটি।

এবার অস্কারের অংশ নেওয়ার জন্য আমাদের কাছে দুটি সিনেমা জমে পড়ে। একটি হচ্ছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ও জাজ মাল্টিমিডিয়া প্রযোজিত ‘ডুব’। অন্যটি নূরে ইমরান পরিচালিত ও ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত ‘কমলা রকেট’। দুটি সিনেমা বিচার বিশ্লেষণ করে ‘ডুব’কে অস্কারে অংশ নেওয়ার জন্য নির্বাচিত করেছে ৯১তম অস্কারে বাংলাদেশ কমিটি। এমনটাই নিশ্চিত করেছেন চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান খান।

সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে একাডেমি পুরস্কার মনোনয়নের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রথম চলচ্চিত্র পাঠানো হয় ২০০২ সালে তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রটি। এরপর দুই বছর বিরতি দিয়ে ২০০৫ সালে অস্কারে পাঠানো হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’ ছবিটি।

২০০২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত মোট ১২টি চলচ্চিত্র পেশ করা হয়। এর মধ্যে কোনটিই চূড়ান্ত মনোনয়ন লাভ করতে পারেনি। সর্বশেষ এ বছরে ৯১তম একাডেমি পুরস্কারের জন্য সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে বাংলাদেশ থেকে ‘ডুব’ পাঠানো হচ্ছে। অস্কারের জন্য ‘ডুব’ নির্বাচিত হওয়ায় এই ছবি ও তার পরিচালক-প্রযোজক এবং শিল্পীদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন চলচ্চিত্রের মানুষজন।

তবে শুরু হয়েছে একটি বিতর্কও। প্রশ্ন উঠেছে, যৌথ প্রযোজনার ছবি হিসেবে ‘ডুব’-কে অস্কারের জন্য নির্বাচন করা কী বৈধ না অবৈধ? অন্য দেশের সঙ্গে যৌথভাবে নির্মিত ছবি অস্কারে পাঠানোর নিয়ম আছে কী? অনেকে এ দাবিও করছেন, যৌথ প্রযোজনার ছবিকেই কেন বেছে নেয়া হলো অস্কারের জন্য? দেশের একক প্রযোজনার কোনো ছবি কী যোগ্যতা রাখেনি? এসব প্রশ্নকে ঘিরে গতকাল থেকেই জমে উঠেছে তর্ক-বিতর্ক।

এ বিষয়ে জানতে চলচ্চিত্রের বেশ ক’জন নির্মাতা ও প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারলেন না অস্কারে যৌথ প্রযোজনার ছবির অংশগ্রহণ বৈধ না অবৈধ। মনের সন্দেহ থেকে কেবল বিতর্কটাই করে গেলেন যৌথ প্রযোজনার ছবি নিয়ে।

অবশ্য, এই বিতর্ককে দোষও দেয়া যায় না। এমনটাই মনে করেন ‘ডুব’ ছবির বাংলাদেশি প্রযোজক জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আব্দুল আজিজ। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই অভিজ্ঞতাটা প্রথম। এর আগে কখনো বাংলাদেশ থেকে যৌথ প্রযোজনার কোনো ছবি অস্কারে পাঠানো হয়নি। তাই এটা নিয়ে কথা হবেই। অনেকেই এই নিয়মের ব্যাপারে জানেন না। তবে আমি নিশ্চিত করে বলছি যৌথ প্রযোজনার ছবি অস্কারের জন্য অযোগ্য নয়। আর সেটা জেনেই আমরা ছবিটি জমা দিয়েছিলাম।’

এক্ষেত্রে ‘ডুব’ যদি কোনো ক্যাটাগারিতে পুরস্কৃত হয় তবে সেটি যৌথ প্রযোজকদের মধ্যে কীভাবে বন্টন করা হবে? ছবির অর্জনকেই বা কোনো দেশের বলে ধরা হবে? জবাবে আব্দুল আজিজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘যেহেতু ‘ডু্ব’-কে বাংলাদেশের ছবি হিসেবে পাঠানো হয়েছে সেহেতু এর যা সাফল্য আসবে সবই থাকবে বাংলাদেশের প্রযোজকের কাছে। যদি বিদেশি তারকা হিসেবে ইরফান খান এই ছবির জন্য সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান সেটিও হবে বাংলাদেশের ছবির জন্য। এটা নিয়ে বিতর্কের কিছুই নেই।’

এদিকে অস্কারের নীতিমালা ঘেঁটেও দেখা গেল যৌথ প্রযোজনার ছবির জন্য অস্কারে কোনো নিশেধাজ্ঞা নেই। অস্কারের নীতিমালায় ১৩ নম্বর নীতিটি বিদেশি ভাষার ছবির প্রতিযোগিতার জন্য। সেখানে বেশ কিছু বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া আছে। তবে কোথাও বলা নেই যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত কোনো ছবি যোগ দিতে পারবে না।

৬টি অনুচ্ছেদ সংবলিত নীতিমালায় সর্বমোট ১৯টি নির্দেশনা রয়েছে। প্রথমেই বলা হয়েছে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতার চলচ্চিত্রগুলোকে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে হতে হবে। এর সংলাপ সাধারণত ইংরেজি ভাষায় হওয়া যাবে না। তবে ইংরেজি সাবটাইটেল দিতে হবে। চলচ্চিত্রের দৈর্ঘ্য কমপক্ষে ৪০ মিনিট হতে হবে।

নীতিমালায় নির্দেশ দেয়া আছে কোনো দেশ থেকে ছবি পাঠানো হলে সেই ছবির নির্মাতাকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিক হতে হবে। এ সংক্রান্ত সরকারি কাগজ তাকে জমা দিতে হবে ছবির সঙ্গে। অর্থাৎ ‘ডুব’র জন্য মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীকে বাংলাদেশের নাগরিকপত্র দেখালেই হবে।

তবে নীতিতে বলা আছে, অস্কারে পাঠানো ছবির দেশটিকে অবশ্যই এটা নিশ্চিত করতে হবে যে নির্বাচিত ছবিটির সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ ওই দেশের নাগরিকদের হাতেই ছিলো। অর্থাৎ, ‘ডুব’র ক্ষেত্রে ছবিটির সৃজনশীলতা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে হবে। আর সেটি যে হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যৌথ প্রযোজনায় এবং বলিউডের তারকা অভিনীত ছবি হলেও এই ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপ, নির্মাণ, অভিনয়, সংগীতসহ সবকিছুতেই বাংলাদেশের নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ ছিলো।

নীতিমালায় আরও বলা আছে অস্কারের জন্য ছবি বাছাই কমিটির কাছে ছবির প্রযোজক তার ছবির প্রযোজনা ও নির্মাণ সংক্রান্ত তথ্যাদি অবশ্যই দাখিল করবে।

নীতিমালার নির্দেশনায় উল্লেখ আছে, অস্কারে যে ছবিটি পাঠানো হবে সেটি অবশ্যই ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে মুক্তি দিতে হবে। সেই যোগ্যতার প্রশ্নেও পাশ মার্ক পেয়েছে ‘ডুব’। আনুষ্ঠানিকভাবে ছবিটি ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর মুক্তি পেয়েছিলো। কিন্তু অস্কারকে মাথায় রেখে ছবিটি ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ভোলার একটি সিনেমা হলে ‘ডুব’ মুক্তি দেয়া হয়েছিলো। বেশ গোপনেই করা হয়েছিলো কাজটি। দর্শককে হলে আনা উদ্দেশ্য ছিলো না। ছবিটি যে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই মুক্তি দেয়া হয়েছে সেই সার্টিফিকেট পাওয়াই ছিলো মূল উদ্দেশ্য।

‘ডুব’র এই গোপন মুক্তি নিয়ে সমালোচনাও হয়েছিলো। সংবাদও প্রকাশ হয়েছিলো বিভিন্ন গণমাধ্যমে। সমালোচনা যাই হোক, ছবিটি সেপ্টেম্বরে মুক্তি পেয়েছে সেই প্রমাণ দেখিয়েই অস্কারে যাবার জন্য অনুমতি পেয়েছে।

প্রসঙ্গত, অস্কারে পাঠানো ‘ডুব’ ছবিতে অভিনয় করেছেন ইরফান খান, রোকেয়া প্রাচী, নুসরাত ইমরোজ তিশা, পার্নো মিত্র প্রমুখ। চলচ্চিত্রটির প্রযোজনা করেছে বাংলাদেশের জাজ মাল্টিমিডিয়া, কলকাতার এসকে মুভিজ এবং বলিউডের ইরফান খান ফিল্মস।

উল্লেখ করা যেতে পারে, সর্বশেষ তিন বছরে গেল বছর অস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল সরকারি অনুদানের ছবি ‘খাঁচা’ ছবিটি। ২০১৬ সালে নির্বাচিত হয়েছিলো তৌকীর আহমেদের ‘অজ্ঞাতনামা’ এবং ২০১৫ সালে পাঠানো হয়েছিলো ‘জালালের গল্প’ ছবি।

এলএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।