৮১ মিনিট: বিশ্বের ইতিহাসে দুর্ধর্ষ এক চুরি

মাহমুদা আক্তার
ভোর রাত। বোস্টনের রাস্তাগুলো তখনো ঘুমিয়ে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা ইসাবেলা স্টুয়ার্ট গার্ডনার মিউজিয়ামটি যেন নিঃশব্দ এক ঘুমের দেশে ডুবে আছে। কিন্তু সে ঘুম ভাঙতে চলেছে চিরতরে।
১৯৯০ সালের ১৮ মার্চ। সেন্ট প্যাট্রিক’স ডে’র উৎসবের রং তখনো শহরের বাতাসে। ঠিক ১টা ২৪ মিনিটে দুইজন মানুষ এসে দাঁড়াল মিউজিয়ামের দরজায়। তাদের পরনে পুলিশ ইউনিফর্ম, হাতে ওয়াকিটকি। নক করতেই ভেতরের নিরাপত্তাকর্মী ইন্টারকমে বললেন, ‘কী চান?’
পুলিশ ইউনিফর্মের লোকেরা বললো, ‘একটি গোলযোগের খবর পেয়েছি। ভেতরে আসতে দিন।’ কোন দ্বিধা না করে দরজা খুলে দিলেন গার্ডনারের নিরাপত্তাকর্মী।
পুলিশের পোশাক পরা দুজন ব্যক্তি মিউজিয়ামে ঢুকেই বললেন, ‘আপনাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।’ আসল পরিচয় তখনো অজানা। তারা পুলিশ নয়, তারা ছিল চোর। ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাতে আসা ঠান্ডা মাথার চোর।
তারা নিরাপত্তাকর্মীদের হাতকড়া পরিয়ে বেসমেন্টে বেঁধে রেখে শুরু করল এক অপারেশন। সময় মাত্র ৮১ মিনিট। এত অল্প সময়ে তারা চুরি করে নিল ১৩টি অমূল্য শিল্পকর্ম, যার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার।
চুরি হওয়া চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে ছিল জোহানেস ভারমিয়ারের ‘দ্য কনসার্ট’, রেমব্রান্টের ‘দ্য স্ট্রম অন দ্য সি অব গ্যালিলি’, দেগার'র পাঁচটি স্কেচ ছাড়াও আরও অনেক মূল্যবান জিনিস।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চোরেরা অপেশাদার ছিল। কারণ, তারা অনেক চিত্রকর্ম কেটে নিয়ে যায় ফ্রেম থেকে, অথচ পাশেই ঝুলছিল আরও দামি চিত্র, যেগুলো তারা ছুঁয়েও দেখেনি। তাহলে কি তারা কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনা নিয়ে এসেছিল?
সকালের আলো ফুটতেই গার্ডনার মিউজিয়ামের করিডোরে নিঃশব্দ আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে। খালি ফ্রেম ঝুলে আছে দেয়ালে, যেন নিখোঁজ আত্মার নিদর্শন।
এফবিআই শুরু করলো বিশাল অনুসন্ধান। বোস্টনের আন্ডারওয়ার্ল্ডে তল্লাশি চালানো হলো। সন্দেহের তালিকায় কুখ্যাত গ্যাংস্টার জেমস হোয়াইটি বালজার। সেসময় অনেকেই বলেন, এই চুরি ছিল ‘আর্নেস্ট হেইস্ট’ যেন কেউ জাদুঘর থেকে শুধু নিজের প্রিয় জিনিসগুলো তুলে নিয়ে গেছে।
তবে রহস্য আজও রহস্যই থেকে গেছে। ৩৪ বছর পেরিয়েও চিত্রকর্মগুলো আর ফিরে আসেনি। মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ ১ কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। তবু সেই দেয়ালে ঝুলে থাকা ফাঁকা ফ্রেমগুলো আজো চোখে জল আনে।
শিল্প হারায়নি শুধু রং আর ক্যানভাস। হারিয়েছে ইতিহাস, অনুভব, ভালোবাসা। আর আমরা....আমরা শুধু অপেক্ষায় থাকি, হয়তো কোনো একদিন পৃথিবীর কোনো এক কোণে সেই নিখোঁজ চিত্রকর্মগুলো আবার ফিরবে। আর গার্ডনার মিউজিয়ামের দেয়ালে ফিরবে রঙের গান।
সূত্র: ইসাবেলা স্টুয়ার্ট গার্ডনার মিউজিয়াম, এফবিআই আর্ট ক্রাইম টিম, টাইম ম্যাগাজিন
কেএসকে/জেআইএম