মার্টিন লুথার কিং কে ছিলেন জানেন?

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:০৫ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বিশ্বজুড়ে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের এক অনিবার্য প্রতীক

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ব্যাপটিস্ট ধর্মযাজক ও নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা। তিনি শুধু একজন নেতা নন, বিশ্বজুড়ে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের এক অনিবার্য প্রতীক। কৃষ্ণাঙ্গদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তার অহিংস ও নৈতিক নেতৃত্ব মানুষের চিন্তা-চেতনায় এক বিপ্লব ঘটায়। ১৯৬০-এর দশকের আমেরিকা তার কণ্ঠে পেয়েছিল ন্যায়বিচারের ভাষা, আর নিপীড়িত মানুষ পেয়েছিল নতুন করে বাঁচার সাহস।

১৯২৯ সালের ১৫ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার আটলান্টায় জন্ম নেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। তার বাবা ছিলেন একজন প্রভাবশালী ব্যাপটিস্ট পাস্টর, আর মা ছিলেন শিক্ষিকা। ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধে বড় হওয়া এই পরিবারে ছোটবেলা থেকেই কিং বুঝেছিলেন বৈষম্য কীভাবে মানুষের জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করে। সেসময় আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ বিভাজন ছিল আইনি স্বীকৃত। বাস, রেস্টুরেন্ট, স্কুল সবকিছুতেই ছিল আলাদা ব্যবস্থা। এই অবিচারের বাস্তবতা তাকে নাড়া দিয়ে যায়।

martin

মেধাবী ছাত্র কিং খুব অল্প বয়সেই উচ্চশিক্ষা শেষ করেন। তিনি সমাজবিজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্বে পড়াশোনা করে পাস্টর হিসেবে দায়িত্ব নেন। পাস্টর হলেন একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক বা আধ্যাত্মিক নেতা, যিনি একটি মণ্ডলীর নেতৃত্ব দেন, ধর্মীয় উপাসনা পরিচালনা করেন এবং বিশ্বাসীদের আধ্যাত্মিক পরিচর্যা ও পথপ্রদর্শন করেন। তার চিন্তায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন যেখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ালেও সহিংসতার পথ পরিহার করা হয়। এই দর্শনই পরবর্তীতে তার আন্দোলনের মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে।

১৯৫৫ সালে আলাবামার মন্টগোমারিতে এক কৃষ্ণাঙ্গ নারী রোজা পার্কস বাসে শ্বেতাঙ্গ যাত্রীর আসন ছেড়ে দিতে অস্বীকার করায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গরা বাস বয়কট আন্দোলন শুরু করেন, যার নেতৃত্বে উঠে আসেন তরুণ পাস্টর মার্টিন লুথার কিং। টানা এক বছর ধরে চলা এ বয়কট আন্দোলন আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনে নতুন অধ্যায় রচনা করে এবং কিংকে জাতীয়ভাবে পরিচিত করে তোলে।

এই সাফল্যের পর তিনি দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন শহরে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন। তার ভাষণগুলো ছিল যুক্তি, নৈতিকতা ও গভীর মানবিক বোধে সমৃদ্ধ। কিং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ঘৃণা জয় করা যায় শুধুই ভালোবাসা ও ন্যায়ের শক্তিতে।

১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটন ডিসির লিংকন মেমোরিয়ালে অনুষ্ঠিত ‘মার্চ অন ওয়াশিংটন’ ছিল কিংয়ের নেতৃত্বে সবচেয়ে বড় শান্তিপূর্ণ সমাবেশ। মার্টিন লুথার কিং এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন সেদিন। সেখানে দেওয়া তার ঐতিহাসিক ভাষণ- ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ মানবসভ্যতার এক অনন্য দলিল। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন এক আমেরিকার, যেখানে মানুষের মূল্য নির্ধারিত হবে না তার ত্বকের রং দিয়ে, বরং তার চরিত্র ও মানবিকতার ভিত্তিতে।

martin

তার আন্দোলনের ফলে ১৯৬৪ সালে পাস হয় সিভিল রাইটস অ্যাক্ট এবং ১৯৬৫ সালে ভোটিং রাইটস অ্যাক্ট, যা কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে বড় ভূমিকা রাখে। একই বছর অহিংস সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে পাওয়া এই পুরস্কার তখন পর্যন্ত অন্যতম কমবয়সী বিজয়ের রেকর্ড ছিল।

লুথার কিংয়ের জীবন ছিল সংগ্রাম ও ত্যাগে ভরা। তিনি স্ত্রী কোরেটা স্কট কিং ও চার সন্তান নিয়ে পারিবারিক জীবন কাটালেও প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যুর হুমকির মুখে পড়তেন। তার বাসায় বোমা হামলা করা হয়, গ্রেফতারও হয়েছেন বহুবার। তবুও তিনি কখনো অহিংস পথ থেকে সরে আসেননি। তার বিশ্বাস ছিল ন্যায়ের পথে চলতে গেলে ঝুঁকি নিতেই হবে এবং অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করা যায় না।

বন্ধুসুলভ, শান্তভাষী কিন্তু দৃঢ়চেতা এই নেতা মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা পোষণ করতেন। সাধারণ জীবনযাপন, গভীর আধ্যাত্মিকতা এবং অসাধারণ বক্তৃতা ক্ষমতা তাকে আলাদা করে তুলেছিল।

১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে টেনেসির মেমফিস শহরে শ্রমিকদের অধিকার সমর্থনে অবস্থান নেওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। মাত্র ৩৯ বছরের জীবনে তিনি রেখে যান অমর উত্তরাধিকার সমতা, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের এক চিরন্তন বার্তা।

মার্টিন লুথার কিং শুধু আমেরিকার ইতিহাস নয়, বিশ্বমানবতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি দেখিয়েছেন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদও রাষ্ট্র ও সমাজকে বদলে দিতে পারে। তার স্বপ্ন আজও প্রেরণা দেয় জাতিগত, ধর্মীয় ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। ‘ন্যায়বিচার কোথাও বিঘ্নিত হলে তা সর্বত্র ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি’ তার এই কথাই আজও মানবাধিকার আন্দোলনের মূলমন্ত্র হয়ে আছে।

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের জীবন ছিল মানুষের মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম। তিনি বিশ্বাস করতেন, সব মানুষ সমান এবং ন্যায়ই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। তার ভাষণ, দর্শন ও আন্দোলন আজও পৃথিবীর অসংখ্য মানুষকে সাহস জোগায়। তাই তিনি শুধু একজন নেতা নন তিনি সমতা ও মানবতার চিরন্তন বাতিঘর।

আরও পড়ুন
সন্ধ্যা নামলেই পুরোনো ইলেকট্রনিক্স পণ্যের হাট বসে যেখানে
এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কী, খরচ কেমন?

কেএসকে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।