চিঠির অপেক্ষায় লাল ডাকবাক্স

মোহাম্মদ সোহেল রানা
মোহাম্মদ সোহেল রানা মোহাম্মদ সোহেল রানা , গণমাধ্যমকর্মী ও ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ১২:৫৯ পিএম, ০৯ অক্টোবর ২০২৫
হলুদ খামে ভরা চিঠিতে ভরে যেত ডাকবাক্স

‎এক সময় লাল রঙের একটি ডাকবাক্স ছিল শহর কিংবা গ্রামের অলিগলির পরিচিত দৃশ্য। প্রতিদিন কেউ না কেউ এসে চিঠি ফেলতেন সেই ডাকবাক্সে, আর অপেক্ষা করতেন উত্তরের। সেসব চিঠি পৌঁছে যেত দূরের কোনো প্রিয় মানুষের কাছে, আর এই চিঠির যাত্রায় নীরবে-নিভৃতে সাক্ষী হয়ে থাকত ছোট্ট এক লাল রঙের বাক্স। কিন্তু প্রযুক্তির এই যুগে সে চিঠির ব্যবহার আগের মতো নেই। ডাকবাক্সেও ফেলা হয় না চিঠি। তাই চিঠির অপেক্ষায় সময় কাটছে সেই লাল ডাকবাক্সের।

একটা সময় ছিল, যখন মানুষ মন খুলে চিঠি লিখত। মনের গভীর আবেগ, না বলা কথাগুলো, দীর্ঘদিনের অপেক্ষা কিংবা হঠাৎ পাওয়া আনন্দ-সবই ধরা পড়ত কলমের কালিতে। সাদা কাগজের গায়ে কালি ছুঁয়ে ফুটে উঠত ভালোবাসা, শোক, সফলতা আর ছোট ছোট সুখের গল্প। সেইসব চিঠির ধারক ছিল লাল রঙের ডাকবাক্স।

চিঠির অপেক্ষায় লাল ডাকবাক্স

শহরের ব্যস্ত রাস্তার ধারে, স্কুল-কলেজের গেটের পাশে, কিংবা গ্রামের নির্জন মোড়েও দাঁড়িয়ে থাকত এই বাক্সটি। যেন এক নীরব প্রহরী-যে জানে হাজারো মানুষের না বলা গল্প, যন্ত্রণার ভার, ভালোবাসার গভীরতা। প্রতিদিন সেখানে জমা পড়ত শত শত চিঠি। কারো চাকরির নিয়োগপত্র, বাবার লেখা সন্তানের খোঁজখবর, মায়ের উদ্বেগভরা বার্তা, প্রিয়জনের মিষ্টি প্রেমপত্র কিংবা যুদ্ধবিধ্বস্ত থেকে কোনো সৈনিকের মনখারাপের কথা-সবকিছুরই নীরব বাহক হয়ে উঠত সেই ডাকবাক্স। একটি ছোট্ট বাক্স, কিন্তু তার ভেতরে জমে থাকত হাজারো হৃদয়ের কান্না-হাসি, ভাঙাগড়ার ইতিহাস, অপেক্ষার প্রহর আর ভালোবাসার অমলিন ছাপ।

প্রতিদিন ডাকপিয়ন এসে ডাকবাক্স থেকে চিঠি সংগ্রহ করতেন। পরনে খাকি পোশাক, কাঁধে চামড়ার ব্যাগ-যেন আবেগ, খবর আর ভালোবাসা বহনের নির্ভরযোগ্য বাহক। তার হাতে ধরা প্রতিটি চিঠির সঙ্গেই যেন পাড়ি দিত শত শত মানুষের অনুভব, আবেগ, অপেক্ষা, প্রত্যাশা আর একরাশ উত্তেজনা। কেউ হয়তো জানলার পাশে বসে থাকত দিনভর, চোখে থাকত অপেক্ষার ছায়া, আর চিঠির আশায় সেই ডাকপিয়নের পায়ের শব্দের অপেক্ষা।

তখন চিঠি মানেই ছিল সংযোগ। দূরে থাকা মানুষকে কাছে টেনে আনার একমাত্র উপায়। কোনো ইন্টারনেট ছিল না, ছিল না তাৎক্ষণিক বার্তা পাঠানোর আধুনিক সুবিধা। তাই চিঠিই ছিল হৃদয়ের ভাষা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। আর চিঠির যাত্রা শুরু হতো সেই ডাকবাক্স থেকে।

তবে বদলে গেছে যুগ, বদলে গেছে যোগাযোগের ধরন। যে চিঠিগুলো এক সময় মানুষের মনের কথার একমাত্র বাহক ছিল সেই হলুদ রঙের খামে ভরা চিঠি আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লাল ডাকবক্স, আজ তারা যেন ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে।

এক সময় ডাকঘরে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে চিঠি পাঠানো ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কেউ কেউ আবার সকালে উঠে হেঁটে যেত ডাকবাক্স অবধি, যত্ন করে খামে ভরা চিঠিটা ফেলে দিয়ে ফিরে আসতেন। এখন আর সে দিন নেই।

ডিজিটাল যুগের সঙ্গে সঙ্গে সেই ধীর, গভীর আবেগময় যোগাযোগও যেন হারিয়ে গেছে। চিঠির জায়গা দখল করে নিয়েছে নীল রঙের মেসেঞ্জার, সবুজ হোয়াটসঅ্যাপ, নীলচে টেলিগ্রাম, আর লাল-নীল-সবুজ-হলুদের রঙে সাজানো ই-মেইল। এখন আঙুলের এক ছোঁয়ায় মুহূর্তে পৌঁছে যায় খবর, ছবি, ভিডিও-যার মধ্যে অনুভবের গভীরতা থাকলেও, সময়ের সেই নিঃশব্দ অপেক্ষা আর নেই।

এখন আর আগের মতো হাতে লেখা চিঠির আদান-প্রদান তেমন হয় না। বিশেষ করে বিদেশ থেকে আসা চিঠিগুলো, যা এক সময় ছিল পরিবারের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। তাও অনেকেটাই কমে গেছে। বর্তমানে হাতে লেখা চিঠি ব্যবহার হয় মূলত কেবল দাপ্তরিক কাজে। জমির পরচা, নোটিশ, ব্যাংক সংক্রান্ত নথিপত্র, কিংবা আদালতের বা সরকারি বিভিন্ন কাজের চিঠি-এসবই এখন ডাকব্যবস্থার মাধ্যমে আদান-প্রদান হয়। এক কথায়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে চিঠির ব্যবহার আর হয় না বললেই চলে।

চিঠির অপেক্ষায় লাল ডাকবাক্স

এক সময়ের কোলাহলমুখর সেই ডাকবাক্স আজ নিঃশব্দ। তা পড়ে আছে একা, অবহেলিত। সময়ের ভারে তার গায়ে জমেছে ধুলোর আস্তরণ, লোহায় ধরেছে মরিচা। আগের সেই টকটকে লাল রং আর নেই-রোদ, বৃষ্টি আর বাতাসে মলিন হয়ে গেছে রঙের উজ্জ্বলতা। আজ কোনো রাস্তার পাশে ডাকবাক্স চোখে পড়লে মনে হয়-এ যেন একজন অপেক্ষমান বৃদ্ধ। সে তাকিয়ে থাকে ফাঁকা রাস্তায়, যেন এখনো আশা করে-হয়তো কেউ আসবে, কেউ তার বুকের ভেতরে রেখে যাবে একটি চিঠি।

চিঠির জন্য এখন আর ডাকপিয়নের অপেক্ষায় থাকতে হয় না। আধুনিক প্রযুক্তির অগ্রসরতায় গুরুত্ব হারাতে বসেছে পোস্টঅফিসের। তাই অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ডাকবক্স, একই সঙ্গে কদর নেই ডাকপিয়নের। ‎এক সময় প্রতিদিন শত শত চিঠি যেতেন ডাকঘরে। মানুষ চিঠির খোঁজে এখন আর ডাকঘরে যান না। হয়তো আগামীর শিশুরা ডাকবাক্সের সঙ্গে পরিচিত হবে জাদুঘরে-কাচের ঘেরা কোনো ঘরে রাখা হবে ধূলিধুসর লাল বাক্স, যার পাশে লেখা থাকবে ‘এক সময় এভাবেই মানুষ চিঠি পাঠাতো’।

আরও পড়ুন
এক কাপ কফির বিশ্বরেকর্ড 
ঠান্ডার সঙ্গে যুদ্ধ যেখানে, নাক হারাতে বসেছিলেন রুহি চেনেট 

কেএসকে/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।