কানাডীয়-বাঙালি শিল্পীর একক প্রদর্শনী ঢাকায়

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:৩১ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫
ঢাকার খ্যাতিমান শিল্পীদের নিজের প্রদর্শনী ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন শিল্পী জিসান হক। ছবি: জাগো নিউজ

কানাডার টরোন্টো থেকে প্রথমবার ঢাকায় এসেছেন রিচার্ড পিজন। দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গী জিসান হকের শিল্পকর্মের প্রদর্শনী তার কাছে নতুন নয়। তবে বাংলাদেশে এসে যেন স্ত্রীকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন তিনি। ভিন্ন এক দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি ও মানুষের মাঝে সে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হলেন এই কানাডীয়।

২৬ ডিসেম্বর ধানমন্ডির সফিউদ্দিন শিল্পালয়ে শুরু হয়েছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় শিল্পী জিসান হকের একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ‘ইনভাইটেশন টু লাইফ’। সন্ধ্যায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগের সাম্মানিক অধ্যাপক খ্যাতিমান শিল্পী সৈয়দ আবুল বার্ক্ আলভি, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক প্রধান নকশাকার শিল্পী আবদুল মান্নান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রশিদ আমিন ও শিল্পীর পরিবার।

শৈশবে আঁকিবুঁকি ছিল অনুকরণ। বাবা আবু জাফর জিয়াউল হককে দেখে আঁকতে শেখা জিসান হক দেশ ছাড়েন ১৯৭৯ সালে। যুক্তরাষ্ট্র হয়ে পরে থিতু হন কানাডায়। বিদেশে পড়শোনা, প্রশিক্ষণ, বিয়ে ও সংসারের ফাঁকে ফাঁকে চালিয়ে নেন শিল্পচর্চা। বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে প্রথম একক প্রদর্শনী হয় তার ছবির। পরে নিউইয়র্ক ও কানাডার টরোন্টোতেও করেছেন একক প্রদর্শনী। বাংলাদেশে এটি তার তৃতীয় একক প্রদর্শনী।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন রশিদ আমিন। তিনি বলেন, ‘কানাডায় কী ধরনের কাজ হয়, মানুষ কী দেখেন, কী পছন্দ করেন, সেসব সরাসরি তিনি আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন জিসান, সেটা একটা চমৎকার ব্যাপার। এভাবেও কানাডার সঙ্গে বাংলাদেশের একটা যোগসূত্র স্থাপিত হলো। ডিজিটাল পেইন্টিংকে এ দেশে জনপ্রিয় করার চেষ্টা চলছে, সেই চেষ্টায় জিসানকে স্বাগতম।’

ডিজিটাল পেইন্টিং প্রসঙ্গে সৈয়দ আবুল বার্ক্ আলভি বলেন, ‘মাধ্যমটা বড় কথা নয়, শিল্পী কী সৃষ্টি করছেন সেটাই আসল। সামনে হয়তো ছবি আঁকার মাধ্যম আরও বদলে যাবে। আমেরিকায় আগে শিল্পীরা কেবল তুলি দিয়ে ছবি আঁকতেন। কিন্তু এখন তারা আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ মাধ্যমে কাজ করছেন। আমেরিকানরা তাদের পোশাকের মতো আর্টের ঘরানাও বদলে ফেলছেন। তাই নতুন মাধ্যমে কাজ করার জন্য জিসানকে অভিনন্দন।’

jagonews

আবদুল মান্নান বলেন, ‘ডিজিটাল পেইন্টিং বাংলাদেশে নতুন ধরনের কাজ। এখনো এ মাধ্যম অতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তবে সামনে হবে। যেহেতু জিসান হক আগে অন্য মাধ্যমে কাজ করেছেন, এ কারণে তার ডিজিটাল মাধ্যমের কাজগুলো দেখে মনে হয়েছে, তিনি আর্টে সিদ্ধহস্ত, যদিও তার কাজগুলো বিমূর্ত। তার কাছ থেকে আমরা আরও ব্যতিক্রম ও বাস্তবধর্মী কাজ দেখতে চাই। তাকে আহ্বান জানাবো, তিনি যেন নিয়মিত দেশে আসেন। তাতে আমাদের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হবে।’

আরও পড়ুন
কানাডিয় বরকে ৩০ বছর পর ঢাকায় আবার বিয়ে 
মার্টিন লুথার কিং কে ছিলেন জানেন? 

ডেলিকেট এলিগ্যান্স, ক্রিয়েশন উইদাউট ক্যাওস, রিফ্লেকশন অব লংগিং, এটারনাল ইকোস ইন ফ্রাগমেন্টেড লাইট শিরোনামে জিসান হকের ডিজিটাল চিত্রকর্মগুলো গ্যালারির দেওয়ালে ছড়াচ্ছিল সূক্ষ্ম সৌন্দর্য। জানান দিচ্ছিল জীবনের বর্ণিল অনুভূতি। জীবনের নানান ব্যথা-বেদনাকে মোছার বদলে শিল্পী সেগুলোকে রূপান্তর করেছেন সৃষ্টিকর্মে। তারপর ক্যানভাসে এঁকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিল্পসংগ্রাহকদের দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে জিসানের আনন্দ-বেদনার রূপান্তরিত রং। শিল্পী জানালেন, মাত্র একটি কপি প্রিন্ট করার পর তা কম্পিউটার থেকেও মুছে ফেলেন, যাতে অনুলিপির সুযোগ না থাকে। যেন সেটি কেবল সংগ্রাহকের কাছেই থাকে।

ঐতিহ্যবাহী পরিবার জিসানদের। ‘ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ বইতে ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন তাদের পরিবার নিয়ে লিখেছেন, ‘জমিদার আবুল খায়রাত মোহাম্মদের প্রথম পুরুষ মুন্সী আলম। ইয়েমেনে তার জন্ম। মুন্সী আলমের দুই ছেল মুন্সী গুল বকস, আরেকজন মুন্সী নূর বকস। নূর বকসের ছেলে মৌলভী আবুল খায়রাত মোহাম্মদ। তার দুই ছেলের একজন আবুল হাসনাত ও আরেকজন আবু জাফর জিয়াউল হক ওরফে নাবালক মিয়া। নাবালক মিয়ার ছয় ছেলে ও ছয় মেয়ের একজন জিসান হক। পুরান ঢাকায় তাদের বাড়ির পাশে চার সড়কের নাম এই পরিবারের চার সদস্যের নামে, নূর বকস রোড, আবুল খায়রাত রোড, আবুল হাসনাত রোড ও নাবালক মিয়া লেন।’

নাবালক মিয়া লেনের শেষ মাথায় তাদের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জিসান হক বলেন, ‘আজ আমার পরিবারের অনেকে এখানে উপস্থিত। প্রথমবারের মতো আমার সন্তানেরা মাতৃভূমিতে এসেছে, বর এসেছে। নিজের সব মানুষদের নিয়ে নিজের দেশে নিজের ছবির প্রদর্শনী করতে পেরে আমি গর্বিত।’ তিনি মঞ্চে ডেকে অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন কানাডীয় স্বামী রিচার্ড পিজন, ছেলে কাইল, লুকাস ও জোসুয়াকে।

jagonews

ঐতিহ্যবাহী পরিবার, জন্মভূমি, বন্ধুদের ছেড়ে ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠার একাকিত্ব, পুরান ঢাকার খাবার, বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি, পূর্বপুরুষদের সমাধিসৌধ জিসানের কাছে স্মৃতি। যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্র নগরী হলিউড ও কানাডায় সংগ্রামী জীবনস্মৃতিও তার অমূল্য সম্পদ। শিল্পকর্মে সেসবের ছোঁয়া রেখেছেন এই শিল্পী। রক্তে প্রতিভাবান বাবার সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটেছে আধুনিক চিত্রকলায়। দীর্ঘদিনের শিল্পকর্মগুলো বহুদূরের দেশ থেকে নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের শিল্পরসিকদের জন্য।

একাধিক আকৃতির ২২টি ডিজিটাল চিত্রকর্ম দেখা যাবে জিসানের ‘ইনভাইটেশন টু লাইফ’ প্রদর্শনীতে, চলবে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সমাপনী অনুষ্ঠানে অতিথি হতে সম্মতি জানিয়েছেন খ্যাতিমান চিত্রকর মনিরুল ইসলাম। প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত শিল্পরসিকদের স্বাগত জানাবেন গ্যালারি কর্তৃপক্ষ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন উন্নয়নকর্মী নাশমিন নাহিদ।

আরএমডি/এসইউ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।