‘বাবা এখন আমি বুঝি, বাবা হলে সন্তানের জন্য কেমন লাগে’


প্রকাশিত: ০৬:৪৫ পিএম, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

শুক্রবার ডে অফের দিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল প্রায় ৮টা। বাসার সবাই তখনও ঘুমে। ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্র্যাব) এর পুর্বনির্ধারিত শুক্রবারের পিকনিকে কিভাবে যাবো, বাসে যাবো নাকি বাবার কাছ থেকে প্রাইভেটকারটা চেয়ে নিয়ে যাবো সে ব্যাপারে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।

তবে শুক্রবার সকালে দেরি করে ঘুম উঠে ড্রাইভারকে কল করে দ্রুত বাসায় আসতে বললাম। তারপর দুই ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দ্রুত রেডি হতে বলে নিজেও গোসলে ঢুকলাম। আজিমপুর নতুন পল্টন লাইনের বাসা থেকে বের হতে হতে সোয়া ৯টা বেজে গেল।

শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় রাস্তাঘাট ফাঁকা। গাবতলিতে কিছুটা যানজট পেরিয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই নির্ধারিত পিকনিক স্পট সাভারের গেন্ডায় স্পটে পৌঁছে গেলাম। স্পটটিতে পা রেখেই অদ্ভুত এক ভাললাগার অনুভূতি হলো। পুকুর, মিনি পার্ক, খাঁচায় হরিণ, খরগোশ, পাখি, দোলনা ইত্যাদি দেখে আমি খুশী, স্ত্রী ও সন্তানরাও খুশী। সহকর্মী অনেকের সাথেই দেখা হলো, হলো কথা।

 

দ্রুত সকালের খাবার খেয়ে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে পুকুরে ছোট্ট নৌকায় চেপে বসলাম। পুকুরে পাড়ে রাজহাঁস, বগ ও ছাগল ছানা দেখে ছেলে মেয়ের নানা প্রশ্ন জবাব দিতে দিতে ভাবলাম একদিন আমিও হয়তো বাবাকে এমন প্রশ্নই করতাম। মনে মনে ভাবলাম সারাক্ষণ সংবাদের পেছনে ছুটে চলার নেশায় ওদেরকে তেমন সময় দেয়া হয় না। আজ সারাদিন ওদের সঙ্গ দেবো। এরই মাঝে ক্র্যাব সদস্যের কমন গিফট ও বাচ্চাদের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার শুরু হওয়ার ঘোষণা এলো।

হঠাৎ করে স্ত্রীর মুখ মলিন হয়ে গেল। অপরাধি অপরাধি ভাব নিয়ে কাছে এসে ফিসফিস করে বললো, এইরে সর্বনাশ হয়েছে। পিকনিকের চাঁদার রশিদ ও র‌্যাফল ড্রয়ের টিকিটতো বাসায় ফেলে এসেছি। এ কথা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ।

ক্র্যাবের বার্ষিক পিকনিকের এবারের আয়োজন বিশেষ করে র‌্যাফল ড্র’তে অনেক দামি দামি গিফট থাকছে বলে সহকর্মীদের অনেকের কাছ থেকে শুনেছিলাম। আমিও বাচ্চাদের সঙ্গে গল্প করতে বিভিন্ন গিফটের প্রসঙ্গ তুলতেই ওরা বললো, বাবা আমরা কি পাবো? আমি বললাম, র‌্যাফেল ড্রয়ের কুপনে যা উঠে তাই পাবে। ওদের চোখেমুখে আশার আলো। দেখে কি যে ভাল লাগলো তা ভাষায় বলে বুঝাতে পারবো না।

স্ত্রীকে ডেকে বললাম, চাঁদার রশিদ আর র‌্যাফেল ড্রয়ের টিকিট তোমার কাছে রাখ, আমি আবার ফেলে গেলে বাচ্চারা কষ্ট পাবে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো আমি যতটা অগোছালো তারচেয়ে আমার স্ত্রী অনেক বেশি গোছালো। সেই ভরসা থেকেই তার কাছে টিকিট রাখতে দিয়ে আমি নিশ্চিত হই।

স্ত্রীর পাশে মিনিটখানেক বিনাবাক্য ব্যয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মস্তিস্কে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে? আমার কি করা উচিত। র‌্যাফল ড্রতে অংশগ্রহণ করতে না পারলে বাচ্চারা মনে কষ্ট পাবে। এ সময় স্ত্রী পীড়াপীড়ি করে বাসায় গিয়ে আলমারি খুলে টিকিট নিয়ে আসার জন্য বারবার অনুরোধ জানাতে লাগলো। তখন প্রায় সাড়ে ১১টা বাজে। আবার ঢাকায় ফিরে যাওয়া আবার ফিরে আসায় কষ্টকর হবে, তাছাড়া ওদের ছাড়াও বহুদিন যাদের সঙ্গে দেখা হয় না এমন সহকর্মীদের আজ দেখা করার সুযোগ নষ্ট হওয়ার ভয়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু একটা পর্যায়ে সন্তান দুটির মুখ ভেসে উঠলো। একটু কল্পনা করার চেষ্টা করলাম বিকেলে র‌্যাফেল ড্রয়ের প্রোগ্রাম চলছে কিন্তু টিকিট না থাকায় ওরা ঝুঁড়িতে কুপন ফেলতেই পারলো না, মুখ কালো করে রেখেছে। এ দৃশ্যে কল্পনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম ওদের খুশীর জন্য ঢাকায় বাসায় ফিরে আবার আসতে হবে। এতে যত দেরিই হউক।

সহকর্মীদের কাউকে কিছু না বলেই নিরবে নি:শব্দে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে আসলাম। বাসায় ফিরতেই বাবা দেখে হতভম্ব। সংক্ষেপে বাবাকে ঘটনা বলে টিকিট নিয়ে রওনা দিলাম। প্রায় দুই ঘণ্টা পর আবার পিকনিক স্পটে ফিরে আসলাম। এ দুই ঘণ্টায় কী হয়েছে তা বলতে পারবো না। দুই ঘণ্টা পর দুই একজন দেখে বললো, কি সুন্দর ফুটবল খেলা হলো, আপনাকে খুঁজে পেলাম না। আমি তখন রহস্যের হাসি হেসে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা চালাই। এরপর যথারীতি সব চলতে থাকে।

বিকেল বেলা র‌্যাফেল ড্রয়ের ঘোষণা আসতেই মেয়ে এসে হাজির। বাবা আমাদের টিকিট দাও, আমি ফেলবো। টিকিট পেয়ে হাসিমুখে দৌঁড়ে মঞ্চে গিয়ে কাচের জারে টিকিট ফেলে আসলো। ওর হাসিমুখটা দেখে আমার দুই ঘণ্টার কষ্ট দূর হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলাম, এখন কপালে থাকলে কিছু পাবো কিন্তু না থাকলে দু:খ থাকবে না। কারণ অন্তত অংশগ্রহণ তো করতে পেরেছি।

 

একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই, বছর ১৫ আগে তখনও বিয়ে করা হয়নি। এই আমির তখন একাকী জীবন, বয়সেও অপেক্ষাকৃত তরুণ। অফিস শেষে বন্ধুদের সঙ্গে অনেক রাত করে ঘরে ফিরতাম তখন বাবা জেগে থাকতেন। আগে থেকে টেলিফোন করে না জানালে রাগ হতেন। তার রাগ দেখে আমার রাগ হতো। কথা প্রসঙ্গে বলতাম, আমি তো এখন যথেষ্ট ম্যাচিরউড, টেলিফোন করে না জানালে কি এমন হয়। এ সময় তিনি বলতেন, একদিন বাবা হবি, সন্তানদের জন্য কেমন লাগে বুঝবি।

প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বিকেলে যখন র‌্যাফেল ড্রয়ে একের পর এক নাম ঘোষণা করা হচ্ছিল অনেকটা রিলাক্স হয়ে বসেছিলাম। পাশে মেয়ে বসে আছে। অনেকগুলো পুরস্কার ঘোষণার পর হঠাৎ করে ক্র্যাবের সহসভাপতি সাব্বির মাহমুদ (যিনি গলা ভাঙার জন্য ঠিকমতো কথা বলতে না পারায় মাজহারুল ইসলামকে নাম ঘোষণার দায়িত্ব দেন) পাশে দাঁড়ানো ক্র্যাব সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার আলমকে নীচু স্বরে টোকেন নম্বর ... আমাদের উজ্জ্বল পেয়েছে বলতে শুনি। নাম ও ২৪ ইঞ্চি এলইডি টিভির ঘোষণা করতেই মেয়ের মহানন্দ। ছেলেও ছুঁটে আসে। ওদের আনন্দ দেখে স্ত্রী ও আমি দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসি। ওই মুহূর্তে বাবার কথাটা কানে বাজে, বাবা হলে একদিন বুঝবি, সন্তানের জন্য কেমন লাগে।

র‌্যাফেল ড্রয়ের টিকিট ভুলে রেখে আসা, সন্তানদের আনন্দের জন্য আবার ঢাকায় ফিরে টিকিট নিয়ে আসা, সৌভাগ্যক্রমে লটারিতে টিভি পাওয়া সব মিলিয়ে হিসাব করে দেখি, যা করেছি সন্তানদের আনন্দ খুশীর জন্যই করেছি। আর বাবাকে মনে মনে বলেছি, ‘বাবা এখন আমি বুঝি, বাবা হলে সন্তানের জন্য কেমন লাগে’।

এমইউ/এআরএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।