আমার সব স্বপ্নপূরণে বাবাই যথেষ্ট
মোস্তাফিজুর রহমান
বাবাকে নিয়ে সমস্ত স্মৃতি সন্তানের পক্ষে লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। সন্তানের সাথে বাবার সম্পর্ক ঠিক তেমন; বৃক্ষের সাথে শিকড়ের সম্পর্ক যেমন। আমার ক্ষেত্রেও একই। জমে আছে অসংখ্য স্মৃতি। সেখান থেকে একটু লেখার প্রচেষ্টা।
আমার বাবা ভীষণ রাগী। আবার ভালোবাসতেও পারেন সবার চেয়ে বেশি। তখন আমি ছোট। ক্লাস থ্রিতে পড়ি। দুপুরে বাবা আমাকে চিৎকার করে ডাকছেন। আম্মাকে বলছেন, ‘কই সে নবাব?’ আম্মা বললেন, ‘খেলতে গেছে।’ বাবার রাগ আরো বেড়ে গেল। চিৎকার করে এলাকা ফাটিয়ে ফেলছেন। কী যেন একটা কাজ করছিলেন, হাতে ছিল দা। সামনে আসতেই দা হাতে দিলেন এক দাবড়। অলিগলি দিয়ে এমন জোরে দৌড়ালাম, আমাকে ধরতেই পারলেন না। জানতাম, কিছু বলবেন না। তারপরও ভয়ে কোন কিছু না ভেবেই দৌড় দিয়েছিলাম। সে কথা মনে পড়লে আজও হাসি পায়।
ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত ফার্স্ট বয় ছিলাম। সকাল-সন্ধ্যা বাবা আমাকে পড়াতেন। শীতের ভোরেও আদর করে উঠাতেন পড়ার জন্য। সব কিছুই ভালো পারতাম। মাঝে মাঝে অঙ্ক একটু ভুল করতাম। বাবাও আমাকে শাস্তি দিতেন। ঠাস করে মারতেন। কান্না করতাম, সেদিন জেদ করে আর পড়তাম না। আম্মা এসে জড়িয়ে বুকে নিতেন। পরীক্ষার সময় বাবা পৌঁছে দিতেন। বার্ষিকে যখন ফার্স্ট হতাম, ভীষণ ভালো লাগতো। বাবার পক্ষ থেকে আমার জন্য পুরস্কার থাকতো। পড়াশোনায় ভালো হওয়ার পেছনে বাবার ভূমিকাই বেশি।
বাবারা সাত ভাই, এক বোন। পারিবারিক সমস্যার কারণে গোষ্ঠীর অন্যদের ভালোবাসা তেমন পাইনি। কিন্তু বাবার অসীম ভালোবাসা পেয়ে কখনোই সেই অভাব অনুভব করিনি। আমার সব স্বপ্ন পূরণে বাবাই যথেষ্ট।
পেশাগত কারণে বাবা সিলেটে থাকেন। একদিন নিউ মার্কেটে বিদায় দিতে গেছি। বাবা আদর করলেন। কিছুক্ষণ পর গাড়ি ছাড়ল। গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছি, চোখের সীমানা পেরিয়ে গাড়ি বহুদূরে। বুকের ভেতর পাহাড় চাপা কষ্ট অনুভব করলাম। অশ্রুতে চোখ ভিজে গেল। বাসায় আসতে আসতে কতবার কেঁদেছি আর কতবার চোখ মুছেছি তার হিসেব নেই। বড় হওয়ার সাথে সাথে বুঝতে পারলাম, আমার সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য বাবা নিজেও এই কষ্ট বরণ করে নিয়েছেন।
যখন মোবাইল ব্যাংকিং শুরু হয়নি, বাবা তখন পোস্ট অফিসের মাধ্যমে টাকা পাঠাতেন। ডাক পিয়ন বাড়িতে আসতো। খাম খুললেই টাকার সাথে আরেকটি জিনিস পেতাম। সেটি হলো বাবার হাতে লেখা চিঠি। প্রত্যেক চিঠিতেই বাবা আমাকে নিয়ে লিখতেন। ভীষণ খুশি হতাম। ইনকামিং কল লিস্টে বাবা এখন পর্যন্ত নাম্বার ওয়ানেই আছেন।
মধ্যবিত্ত পরিবারে সব শখ পূরণ করা কখনো কখনো সম্ভব হয়ে ওঠে না। বেশি গুরুত্বপূর্ণ অভাবগুলোই এখানে পূরণ করা হয়। সব কিছুর পরও আমার জন্য বাবার ভালোবাসা অপরিসীম। নতুন সাইকেল থেকে শুরু করে স্মার্টফোন, সব চাওয়াই বাবা পূরণ করে চলেছেন। কয়েক মাস আগে বাবাকে বললাম, ‘একটা ল্যাপটপ হলে খুবই ভালো হতো।’ বাবা বললেন, ‘চিন্তা করো না সোনা। কিনে দেব। ভালো করে লেখাপড়া করো।’ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করা টাকা দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি একটু একটু সঞ্চয় করে আমার সেই স্বপ্নটাও বাবা পূরণ করেছেন।
এসএসসির আগে একটুখানি বখে গিয়েছিলাম, বাবার সুন্দর নির্দেশনা আর গাইডলাইনে সেখান থেকে বেরিয়ে আজ আমি ইংরেজিতে অনার্স পড়ছি। জীবনে বাবাই সব। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তেই বাবাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।
ভাগনি যখন ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট ওর বাবাকে হারালো; তখন খুব কাছ থেকে বাবা হারানোর বেদনা উপলব্ধি করেছি। কবুতর জবাই দিলে যেমন ছটফট করে, ও ঠিক তেমনি করছিল। জানি পৃথিবীতে কেউই চিরদিন বাঁচে না। কিন্তু সবার বাবা যদি হাজার বছর বাঁচতেন, তবে কতোই না ভালো হতো।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, সরকারি এমএম কলেজ, যশোর।
এসইউ/এএ/এমকেএইচ