কুষ্ঠ আক্রান্ত ৫৮ শতাংশই চা বাগানের শ্রমিক

কুষ্ঠ একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা হলেও বাংলাদেশসহ আশপাশের দেশগুলোতে এটাকে ঘিরে কুসংস্কার রয়েছে। ফলে কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তি এমনকি তাদের আত্মীয়স্বজনরা হীনমন্যতায় ভোগেন। এমনকি তারা নানা ধরনের সামাজিক বৈষম্যের শিকার হন। তবে আশার কথা এসব কুসংস্কার মোকাবিলা করে বাংলাদেশ কুষ্ঠ রোগ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে নানা কার্যক্রম। শনাক্ত কুষ্ঠরোগীদের বিনামূল্যে সেবা দেয় সরকার ও বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)। তবে এখনো দেশের ৯টি জেলাকে কুষ্ঠ রোগের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ কুষ্ঠ রোগ নির্মূলের পথে হাঁটলেও এখনো রংপুর, সিলেট ও ঢাকা বিভাগে তুলনামূলকভাবে রোগী বেশি শনাক্ত হচ্ছে। সিলেটের মৌলভীবাজারে গত এক বছরে ৬৬০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। যাদের ৫৮ শতাংশই চা বাগানের শ্রমিক।
আরও পড়ুন: এখনো কুষ্ঠরোগের ঝুঁকিতে ৯ জেলা
কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মৌলভীবাজারসহ সারাদেশে শনাক্ত রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে চিকিৎসাধীন এবং শনাক্তের বাইরে থাকা রোগীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে সংক্রামক এ রোগ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার রয়েছে। অধিকাংশ রোগী সমাজ ও পরিবারে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
এদিকে, বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে কুষ্ঠ রোগ নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তবে পুনর্বাসন সমস্যার ফলে রোগটি নির্মূলে চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শেষ রোববারকে বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস ঘোষণা করেছে। সে অনুযায়ী সারাবিশ্বের মতো রোববার (২৯ জানুয়ারি) বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে দিবসটি। এবছর ডব্লিউএইচও দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘অ্যাক্ট নাউ অ্যান্ড লেপ্রোসি’ অর্থাৎ ‘এখনই কাজ শুরু করি, কুষ্ঠরোগ নির্মূল করি’।
আরও পড়ুন: কুষ্ঠ রোগ কেন হয়?
সরকারের জাতীয় কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ২ হাজার ৮৭২ জন নুতন কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ সময় ৯টি জেলাকে লেপ্রোসি এন্ডেমিক এরিয়া বা রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেগুলো হলো- মৌলভীবাজার, দিনাজপুর, গাইবান্দা, নীলফামারী, পঞ্চগড়, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট এবং মেহেরপুর। রেড জোনে প্রতিলাখে ৫ জনের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
এছাড়া বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ, কুষ্টিয়া, লালমনিরহাট এবং ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে অরেঞ্জ এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে প্রতিলাখে ৫ জনের কম তবে ২ জনের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে ৩৪ জেলাকে চিহ্নিত করা হয়েছে ইয়েলো জোন হিসেবে। যেখানে প্রতিলাখে শনাক্ত হচ্ছে ২ জনের কম রোগী। বাকি ১৫ জেলা হোয়াইট জোন চিহ্নিত হয়েছে। যেখানে রোগী শনাক্ত শূন্যের ঘরে।
জাতীয় কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লেপ্রোসি কন্ট্রোল অফিসার আবুল কালাম আজাদ বলেন, কুষ্ঠ একটি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রামক ব্যাধি। যা মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি দিয়ে হয়ে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির চামড়ায় অনুভূতিহীন দাগ দেখা দেয়। যা হালকা লালচে এবং তামাটে বর্ণের হয়ে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি চিহ্নিত করে চিকিৎসা না নিলে অঙ্গহানি হতে পারে।
আরও পড়ুন: কুষ্ঠ নির্মূলে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, দেশে ২০০০ সালে ১২ হাজার ১৩৭ জন কুষ্ঠরোগী ছিল। এরপর থেকে রোগী কমতে থাকে। ২০০৫ সালে কুষ্ঠরোগী ছিল ৭ হাজার ৮৮৩ জন। এরপর ২০১০ সালে ৪ হাজার ৩০৭ জন, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৯৭৬ জন এবং ২০২০ সালে ২ হাজার ৭২৪ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়। ২০২২ সালের সেপ্টম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ২২৩ রোগী শনাক্ত হয়েছে।
বিগত কয়েক বছরে শনাক্ত কুষ্ঠরোগীর মধ্যে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। এরমধ্যে ২০১৭ সালে ২৯৬ জন, ২০১৮ সালে ২৯৭ জন, ২০২০ সালে ২৫২ জন এবং ২০২১ সালে ১৩৭ জন কুষ্ঠরোগী পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
এসব বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মেডিকেল অফিসার ডা. আদনান রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, দারিদ্র্যপীড়িত ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাসরত পরিবারের সদস্যদের কুষ্ঠ রোগ বেশি দেখা যায়। এছাড়া আক্রান্তের অতীত ঘটনা রয়েছে এমন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রোগটি বেশি দেখা যায়।
তিনি আরও বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে জিরো লেপ্রোসি ইনিশিয়েটিভ ঘোষণা করেছেন। এই সময়ে মধ্যে কুষ্ঠরোগী ও এ রোগে প্রতিবন্ধিতা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারিভাবে কাজ করা হচ্ছে। এজন্য রোগ শনাক্ত করা, শনাক্ত রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ, বিশেষ জুতা ও ক্র্যাচসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া যারা কুষ্ঠ রোগে সম্পূর্ণ পঙ্গুত্ব বরণ করছেন, তাদের প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে।
এএএম/কেএসআর/এমএস