সানজানা রহমান যুথী
Advertisement
পিতা-মাতা এই দুটি শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, আত্মত্যাগ এবং নিরন্তর সহানুভূতির প্রতিচ্ছবি। একজন মানুষের জীবনের গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে পরিণত মানুষ হয়ে ওঠা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে যারা ছায়ার মতো পাশে থাকেন, তারা হচ্ছেন বাবা-মা। শিশুর জীবনে প্রথম শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন তার পিতা-মাতা। জীবনের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি চ্যালেঞ্জে সন্তানকে পথ দেখানোর জন্য তারা নিজেকে বিলিয়ে দেন কোনো প্রতিদান বা স্বীকৃতির আশায় নয়, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থেকেই।
এই আত্মত্যাগ, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধকে সম্মান জানানোর জন্য প্রতিবছর ১ জুন পালিত হয় বিশ্ব পিতা-মাতা দিবস। জাতিসংঘ ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক পিতা-মাতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এর লক্ষ্য ছিল পিতা-মাতার ভূমিকার স্বীকৃতি প্রদান, শিশুদের সার্বিক বিকাশে তাদের অবদানের প্রতি সচেতনতা সৃষ্টি এবং পরিবারকে একটি নিরাপদ ও সহানুভূতিশীল পরিবেশ হিসেবে গড়ে তুলতে উৎসাহ প্রদান।
জন্মের পর থেকেই একজন শিশুর সার্বিক বিকাশ শারীরিক, মানসিক, আবেগগত এবং নৈতিক সবকিছুই নির্ভর করে পিতা-মাতার যত্ন ও দিকনির্দেশনার ওপর। একটি শিশুর প্রথম হাঁটা, প্রথম কথা বলা, প্রথম স্কুলে যাওয়া এইসব ছোট ছোট ধাপগুলো পিতা-মাতার জন্য বিশাল এক অনুভূতির উৎস। তারা কখনো ক্লান্ত হন না, বিরক্ত হন না। সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে তারা দিনের পর দিন নিজেদের ইচ্ছা, প্রয়োজন, এমনকি স্বপ্নও বিসর্জন দেন।
Advertisement
আমাদের চারপাশে অনেক এমন বাবা-মাকে দেখা যায়, যারা নিজেদের কষ্টার্জিত আয় থেকে সন্তানের লেখাপড়া, স্বাস্থ্য, ও ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করেন, অথচ নিজের প্রয়োজনীয়তাগুলো উপেক্ষা করেন। মা হয়তো নিজের জন্য নতুন শাড়ি না কিনে সন্তানের স্কুল ফিস মেটান। বাবা হয়তো রাতভর ওভারটাইম করে বাড়ি ফেরেন, যাতে সন্তানের জন্য নতুন বই বা পছন্দের খেলনাটা কেনা যায়। এই আত্মত্যাগের কোনো তুলনা হয় না।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা অনেক সময় বাবা-মার এই অবদানকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিই। তাদের কষ্ট, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, সীমাহীন সহনশীলতা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। আমরা ভাবি ওটাই তো তাদের দায়িত্ব। অথচ যখন আমরা একটু বড় হই, নিজের পছন্দ-অপছন্দ গড়ে উঠতে থাকে, তখন তাঁদের পরামর্শকেও কখনো কখনো বিরক্তিকর বলে মনে হয়।
প্রায়শই দেখা যায়, পিতা-মাতা সন্তানদের জন্য ভালো কিছু চাইলেও, সন্তানেরা তা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে। অনেকেই মনে করেন, বাবা-মা তাদের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো বাবা-মা-ই সন্তানের খারাপ চান না। তাদের প্রত্যেকটি নিষেধাজ্ঞা বা উপদেশের পেছনে থাকে অভিজ্ঞতা ও ভালবাসার ছোঁয়া।
সবচেয়ে কষ্টের বিষয়টি হলো যখন সন্তান প্রতিষ্ঠিত হয়, সমাজে একটা অবস্থান তৈরি করে, তখন অনেকেই বাবা-মার অবদান ভুলে যায়। তাদের গুরুত্ব কমে যায়। সময়ের অভাব দেখিয়ে কথা বলা কমিয়ে দেয়, ব্যস্ততার অজুহাতে দেখা করতে চায় না। অথচ এই সন্তান যখন ছোট ছিল, অসহায় ছিল, তখন তার প্রতিটি কান্নায়, প্রতিটি সমস্যায় বাবা-মাই ছুটে এসেছেন সমাধানের জন্য। তারা যদি তখন সন্তানকে এভাবে দূরে ঠেলে দিতেন, তাহলে কি আজ সে এই অবস্থানে পৌঁছাতে পারতো?
Advertisement
বৃদ্ধাবস্থায় বাবা-মা সবচেয়ে বেশি যা চান, তা হলো সন্তানদের একটু সময়, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। টাকা-পয়সা, উপহার কিংবা বিলাসিতা তাদের কাছে বড় বিষয় নয়। তাদের প্রয়োজন সন্তানের আন্তরিকতা, সান্নিধ্য।
বিশ্ব পিতা-মাতা দিবস কেবল একদিনের আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং প্রতিদিনই আমাদের বাবা মায়ের প্রতি দ্বায়িত্ব পালন করা কর্তব্য। কিন্তু আমরা কি সত্যিই বাবা-মাকে যথাযথ সম্মান দিচ্ছি? আমরা কি তাদের অনুভূতি বুঝছি? তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি, যেমনটা তারা সারাজীবন আমাদের পাশে থেকেছেন?
এই দিনে আমরা চাইলে বাবা-মার জন্য ছোট্ট একটি চিঠি লিখতে পারি, যেখানে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো। তাদের জন্য একটি প্রিয় খাবার রান্না করতে পারি। কিংবা কেবল একটু সময় নিয়ে গল্প করে কাটাতে পারি। ছোট ছোট এমন কাজেই তারা খুশি হন।
যারা বাবা-মাকে হারিয়েছেন, তারা এই দিনে তাদের স্মরণ করতে পারেন। তাদের জীবনের গল্প লিখে রাখতে পারেন, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে বাবা-মা কতটা শক্তি, ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের উৎস হতে পারেন।
পিতা-মাতা শুধু জন্মদাতা নন, তারা জীবনের প্রতিটি কঠিন সময়ের সাথী, অভিভাবক এবং বন্ধু। তাদের প্রতি দায়িত্ব ও ভালোবাসা শুধু একদিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। প্রতিদিনই তাদের জন্য আমাদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত।
বিশ্ব পিতা-মাতা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের জীবনে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি, তারাই সবচেয়ে অবহেলিত হয়ে পড়েন অনেক সময়। তাই এই দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত যে আমরা আমাদের বাবা-মার পাশে থাকবো, তাদের কথা শুনবো এবং তাদের ভালোবাসবো যেমনটা তারা আমাদের ভালোবেসেছেন নিঃস্বার্থভাবে।
আরও পড়ুন
চুলের মুঠি গাছে বেঁধে ঝুলে রইলেন ২৫ মিনিট বাংলাদেশি হিসেবে যারা জয় করেছেন মাউন্ট এভারেস্টকেএসকে/এমএস