নেহরুকে নিশানা করে কেন ‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে বিতর্ক তুললেন মোদী?
ভারতের জাতীয় গান ‘বন্দে মাতরম’ ঘিরে নতুন রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। লোকসভায় আনুষ্ঠানিক আলোচনার সূচনাতেই তিনি অভিযোগ তোলেন, গত শতাব্দীতে মুসলিম লীগের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে কংগ্রেস দল গানটির সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছিল। আর এর জন্য তিনি সরাসরি আঙুল তুলেছেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও প্রয়াত কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরুর দিকে।
মোদীর এই বক্তব্যের পরই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান কংগ্রেসের সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভাদরা। তিনি অভিযোগ করেন, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন সামনে রেখে ইচ্ছাকৃতভাবে এই বিতর্ক উস্কে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ তোলার জন্য সরকার সুযোগ খুঁজছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচিত ‘বন্দে মাতরম’-এর ১৫০ বছরপূর্তি হয়েছে। এ উপলক্ষে ভারত সরকার দেশজুড়ে আয়োজন করেছে একাধিক অনুষ্ঠান। সেই সূত্রেই সংসদে শুরু হয়েছে আনুষ্ঠানিক বিতর্ক। মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) রাজ্যসভাতেও এই বিষয়টি উঠবে বলে জানা গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান বিতর্কের শেকড় ১৯৩৭ সালে। ‘বন্দে মাতরম’-এর প্রথম দুটি স্তবকের পরের অংশে হিন্দু ধর্মীয় শব্দ ও চিত্রকল্প থাকার কারণে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহসহ তৎকালীন বহু মুসলিম নেতা আপত্তি জানিয়েছিলেন। ওই সময় সমাধানের পথ খুঁজতে নেহরু, সুভাষ চন্দ্র বোস ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শ নেন। রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাব দেন, শুধু প্রথম দুটি স্তবক গাওয়া হোক, কারণ সেগুলোতে ধর্মীয় আপত্তির কারণ নেই।
১৮৯৬ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে পুরোটাই প্রথমবার গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরে ১৯৩৭ সালে তার তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয় একটি রেকর্ড। এক পাশে ‘জনগণ মন’, অন্য পাশে ‘বন্দে মাতরম’।
স্বাধীনতার পরও ‘বন্দে মাতরম’ নাকি ‘জন গণ মন’ ভারতের জাতীয় সংগীত হবে, তা নিয়ে বহুবার বিতর্ক হয়। শেষ পর্যন্ত ‘জন গণ মন’কে জাতীয় সংগীত ও ‘বন্দে মাতরম্’কে জাতীয় গান হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
জিন্নাহর কাছে নেহরু মাথা নত করেছিলেন: মোদীর অভিযোগ
লোকসভায় সোমবার (৮ ডিসেম্বর) মোদী বলেন, ‘বন্দে মাতরম’-এর ৫০তম বর্ষে দেশ ছিল পরাধীন। ১০০ বছর হলে জরুরি অবস্থার শৃঙ্খল। এবার ১৫০ বছরে এসে গানটির গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময় এসেছে।
তিনি অভিযোগ করেন, বিজেপি-আরএসএস ও তিনি নিজে বারবার প্রশ্ন তুলছেন কেন প্রথম দুটি স্তবকের পরের অংশ গাওয়া হয় না। এই প্রসঙ্গ টেনে তিনি আবার বলেন, ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের বিরোধিতার মুখে নেহরুই গানটির কিছু অংশ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেন।
মোদীর ভাষায়, জিন্নাহর বিরোধিতার পরে নেহরু সুভাষ বসুকে চিঠিতে জানান যে গানটির প্রেক্ষাপট মুসলমানদের উসকানি দিতে পারে, তাই পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। মোদীর দাবি, এই সিদ্ধান্ত ছিল ‘মুসলিম তোষণের রাজনীতি’; আর দেশভাগের সময়েও নেহরুকে ‘মাথা নত’ করতে হয়েছিল।
কংগ্রেসের জবাব
কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভাদরা মোদীর মন্তব্যকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, আপনারা তো বারবার নেহরুকে টানেন! একটি দিন নির্ধারণ করুন, সেদিন তাকে যত অপমান করা সম্ভব সব বলুন, বিতর্কও করুন, তারপর এই প্রসঙ্গ চিরতরে শেষ হোক। তারপর আসুন আমরা বর্তমানের বাস্তব সমস্যা, দ্রব্যমূল্য ও বেকারত্ব নিয়ে কথা বলি।
তিনি আরও বলেন, ‘বন্দে মাতরম’ দেশের আত্মার অংশ। মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া গান নিয়ে বিতর্ক তোলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তার অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন কেন্দ্র করেই এই বিতর্ক উসকে দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ তৈরির কৌশল এটি।
ঐতিহাসিক পটভূমি, কেন আপত্তি ছিল মুসলিম নেতাদের?
১৮৭৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্র গানটি লেখেন। পরে ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাসে তা অন্তর্ভুক্ত করেন, যেখানে উপস্থাপনায় ব্রিটিশবিরোধী ‘সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ’কে হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের ছায়ায় দেখানো হয় বলে অনেকে মনে করেন। প্রথম দুটি স্তবকের পরের অংশে হিন্দু দেবী দুর্গার স্তুতি থাকায় মুসলিম সমাজ ও ব্রাহ্মদের একাংশের আপত্তি ছিল যৌক্তিক, বলছেন গবেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য।
রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ ছিল, প্রথম দুটি স্তবক উপন্যাস থেকে পৃথক করে দেখা হলে আপত্তির কারণ থাকে না। সেই পথই নেয় কংগ্রেস।
রেকর্ড প্রকাশ ও ইতিহাস
১৯৩৭ সালে কংগ্রেস যখন গানটিকে তাদের সংগীত করে, একই বছরে হিন্দুস্তান রেকর্ডস একটি এলপি প্রকাশ করে। যার এক পাশে ‘বন্দে মাতরম’, অন্য পাশে ছিল ‘জন গণ মন’। রবীন্দ্রনাথের শেখানো সুরে গানটি গেয়েছিলেন প্রভা রায়, জয়া দাস, বিজয়া দেবী, ধীরেন গুপ্ত ও হরিপদ চট্টোপাধ্যায়।
পরে ১৯৫০ সালের দিকে এইচএমভি প্রকাশ করে আরেকটি রেকর্ড, যেটি গেয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, জগন্ময় মিত্রসহ অন্যরা।
স্বাধীনতার পর ১৩ দফা বিতর্ক শেষে সিদ্ধান্ত
সংবিধান সভার নথি অনুসারে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ‘জাতীয় সংগীত’ বাছাই নিয়ে ১৩ দফা বিতর্ক হয়। ১৪-১৫ আগস্টের মধ্যরাতে স্বাধীনতা উদযাপনের সময় প্রথমেই ‘বন্দে মাতরম’ গাওয়া হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধান সভার তৎকালীন সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ঘোষণা করেন, ‘জন গণ মন’ জাতীয় সংগীত ও ‘বন্দে মাতরম’ জাতীয় গান ও দুটির মর্যাদা একই হবে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসএএইচ