ইমরান না মোদি, কৌশলের লড়াইয়ে কে এগিয়ে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:১৯ এএম, ০৪ মার্চ ২০১৯

পাকিস্তান তাদের হাতে আটক ভারতীয় পাইলটকে ছেড়ে দেয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে গত কয়েকদিন ধরে কাশ্মীর নিয়ে এই সঙ্কটে মানুষ যা দেখল বা বুঝল তাতে জিতল কোন পক্ষ?

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মধ্যে কৌশলের লড়াইয়ে আসলে জিতলেন কে?গত বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সংসদে ঘোষণা করেন ‘শান্তির বার্তা’ দিতে আটক ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দেবে পাকিস্তান।

ইমরান খানের এই ঘোষণার সময় দিল্লিতে বিজ্ঞানীদের একটি সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ইমরান খানের ওই ঘোষণার কয়েক মুহূর্ত পরেই মোদি পাকিস্তানকে বিদ্রূপ করে মন্তব্য করেন, পাইলট প্রজেক্ট শেষ হলো। এখন আমাদের আসল খেলায় নামতে হবে। এখানে পাইলট প্রজেক্ট বলে তিনি পাইলটের ঘটনাকে একধরনের পরীক্ষা বলে ইঙ্গিত করেছেন হয়তো। তার সমর্থকরা এই বক্তব্যে উল্লাস প্রকাশ করেছে, কিন্তু অনেকেই তার এই মন্তব্যকে রুচিহীন ও উদ্ধত বলে মনে করছেন।

ইমরানের এই ঘোষণার আগে গত মঙ্গলবার ভারতীয় জঙ্গী বিমান যখন পাকিস্তানের আকাশসীমায় ঢোকে এবং জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শিবিরে হামলা চালায় তখন মোদি বিশাল এক নির্বাচনী জনসভা শুরু করেন। তিনি ওই জনসভায় বলেন, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যোগ্য নেতৃত্বের হাতে এই দেশ নিরাপদ। মনে রাখতে হবে ভারতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে আর কয়েক মাসের মধ্যেই।

তার এমন ঘোষণার ২৪ ঘন্টা যেতে না যেতেই পাকিস্তান ভারতীয় জঙ্গী বিমানটি গুলি করে ভূপাতিত করে পাকিস্তান অধ্যুষিত কাশ্মীরে এবং বিমানের পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে বন্দী করা হয়। দু'পক্ষের ওপর উত্তেজনা প্রশমনের জন্য প্রচুর চাপ ছিল। কিন্তু এর মধ্যেই ইমরান খান এগিয়ে আসেন পাইলটকে মুক্ত করার প্রস্তাব নিয়ে।

ভারতের সাবেক কূটনীতিক এবং কৌশলগত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কে সি সিং বলেন, মোদির বিজেপি দলের কট্টরপন্থী এবং ভারতীয় প্রশাসনের জন্য ‘ইমরান খানের কূটনৈতিক রিভার্স সুইং-এর জবাব দেয়া কঠিন হবে।’ ইমরান খান ক্রিকেট জীবনে বিশ্বের প্রথম সারির একজন খেলোয়াড় ছিলেন। তাই এ কাজে তিনি যথেষ্ট পারদর্শী।

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদি এমন একটি ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন যে, তিনি তার বক্তব্য থেকে নড়েন না। আর স্থানীয় গণমাধ্যমে তার জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তিকে আনুগত্যের সঙ্গে উজ্জীবিত রেখেছে তার সমর্থকদের বড় একটা অংশ। ভারত একটা ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছে এবং পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভারত আশু যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে কিনা এ নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে। এমন পটভূমিতে অনেকের মনেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, মোদি নিজে কেন জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য না রেখে তার আমলা ও সেনাবাহিনীকে দিয়ে কথা বলাচ্ছেন।

ভারতের বড় বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অন্তত ২১ টি দল মোদির কড়া সমালোচনা করে বলছে তার শাসনামলে ভারতে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা সঙ্কট চলছে। এমন সময় মোদি তার নির্বাচনী জনসভা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এমনকী মোবাইল অ্যাপ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে হাজিরা দেয়া থামাননি।

অনেকেই বলছেন, পাকিস্তান দ্রুত পাল্টা হামলা চালিয়ে ভারতের জঙ্গী বিমান ভূপাতিত করে এবং বিমানের পাইলটকে আটক করে মোদিকে কোণঠাসা করে দিয়েছে।

পাইলটকে বন্দী করার দু’দিনের মধ্যেই ইমরান খান বৈরিতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন, শান্তির কথা বলেছেন এবং পাইলটকে মুক্তি দেবার ঘোষণা দিয়েছেন। কে সি সিং বলছেন, পাক প্রধানমন্ত্রী নিজের ‘একটি সম্মানজনক ইমেজ তৈরি করেছেন এবং তিনি আলোচনার মাধ্যমে দু’পক্ষের বিবাদ মীমাংসার জন্য তৈরি’ এমন একটি ভাবমূর্তি তুলে ধরেছেন।

ইমরান খানের ভারতীয় পাইলটকে ফিরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত সবাইকে অবাক করেছে। ইমরান তার দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি তার প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং গণমাধ্যমকে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত অবহিত করেছেন।

ভারতের অনেক বিশ্লেষক বলছেন, পাক প্রধানমন্ত্রী নিজেকে একজন ‘গ্রহণযোগ্য নেতা’ হিসাবে প্রমাণ করেছেন, যিনি ভারতকে কোণঠাসা করার চেষ্টা না করে বৈরিতা বন্ধের প্রস্তাব দিয়েছেন।

অপরদিকে, মনে হচ্ছে মোদ পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। ঐতিহাসিক ও লেখক শ্রীনাথ রাঘাবান বলেছেন, আপনি যেভাবেই দেখার চেষ্টা করুন না কেন, পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় ভারত হতচকিত হয়ে পড়েছে।

গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় হামলায় ৪০ জনের বেশি ভারতীয় আধাসামরিক সেনা নিহত হবার পর ভারত প্রতিশোধমূলক হামলা চালায় রাতের অন্ধকারে। পাকিস্তান জবাব দেয় দ্রুত এবং সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে পরের দিনই একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে।

ভারতীয় পাইলট ধরা পড়ার ঘটনা যেহেতু ছিল অপ্রত্যাশিত, তাই এরপর মোদি ও তার সরকারকে দেখা যায় ভিন্ন সুরে কথা বলতে। তখন তাদের কাছে মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় পাইলটকে ভারতে ফিরিয়ে আনা। পাকিস্তানের পাল্টা হামলার পর সেনাবাহিনী তাদের ব্রিফিং দেয় ৩০ ঘন্টা পর। মোদি ও তার সরকারের ব্যাখ্যা দেবার জায়গাটা স্পষ্টতই ছিল খুবই সীমিত।

পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলোর উস্কানি থেকে একটা নিরাপত্তা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া ভারতে নতুন কোন ঘটনা নয়। মোদির আগে অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং মনমোহন সিংকেও একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। যেখানে আক্রমণ চালানোর সামরিক ক্ষমতা থাকলেও হিসাব করে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যাতে উত্তেজনার পারদ চড়ে না যায়। রাঘাবান বলেন, প্রতিশোধ কখনই কৌশলগত লক্ষ্য হতে পারে না। আবেগতাড়িত হয়ে কৌশল ঠিক করলে তা ব্যর্থ হবার বড় ধরনের সম্ভাবনা থাকে।

ভারতের গণমাধ্যমগুলোর একটা বড় অংশ ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দেবার ঘটনাকে মোদির বিজয় হিসেবে তুলে ধরেছে। খুব কম মানুষইই প্রশ্ন তুলছেন পুলওয়ামার হামলা গোয়েন্দা তথ্যের ব্যাপক ব্যর্থতার কারণে ঘটেছিল কিনা। কিংবা পাকিস্তান প্রকাশ্য দিবালোকে ভারতের প্রতিরক্ষা দুর্গ ভেদ করল কীভাবে?

এছাড়াও পাকিস্তানের ভেতর সন্ত্রাসীদের কথিত প্রশিক্ষণ শিবিরে ভারতীয় জেট হামলা চালিয়ে কতটা ক্ষয়ক্ষতি করতে পেরেছে সে চিত্রও এখনও স্পষ্ট নয়। ওই আক্রমণে ঠিক কতজন মারা গেছে সে বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এখনও পরিষ্কার করে কিছু জানাতে পারেনি। যদিও গণমাধ্যমের একাংশ খোলাখুলিভাবে প্রায় ৩০০ জঙ্গী নিহত হবার খবর দিয়েছে।

কাজেই এসব কঠিন প্রশ্ন নিয়ে মোদির ভাবার সময় এসেছে এবং তার বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে বসেছে কিনা তা নিয়েও তার মাথাব্যথার কারণ তৈরি হয়েছে। তবে অনেকেই বলছেন ইমরান খান হয়ত তার দেশবাসীর কাছে, এমনকী ভারতেও বহু মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের লড়াইয়ে জিতে গেছেন। কিন্তু ভারতে নিজের ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণে মোদি যে পুরো হেরে গেছেন তেমনটা এখনই বলা যাচ্ছে না।

টিটিএন/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।