করোনা মহামারির বছরে কেমন ছিলেন শরণার্থীরা?
বিশ্বজুড়ে যখন করোনা মহামারির আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন শরণার্থীদের কথা ভেবে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন স্বেচ্ছাসেবী ও মানবাধিকার কর্মীরা। কারণ শরণার্থী শিবিরগুলোর সংকীর্ণ পরিসরে কীভাবে এই মানুষগুলো পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখবে? এতগুলো মানুষের জন্য পর্যাপ্ত স্যানিটাইজার ও মাস্কের ব্যবস্থা করা কীভাবে সম্ভব হবে সেটা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। শরণার্থীদের মধ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন দেশের সরকার যদি তাদেরকে সমাজ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে দেয়, তাহলে চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতার মধ্যে এতগুলো মানুষ কী অসহায় অবস্থায় পড়বে তা ভেবে খুবই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন তারা।
সৌভাগ্যক্রমে করোনায় আক্রান্ত হয়ে শরণার্থী মৃত্যুর ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে করোনা মহামারি যতটা অনুমান করা হয়েছিল ততটা ছড়ায়নি। এরপরও শরণার্থীদের জন্য ২০২০ ছিল একটি কঠিন বছর। করোনাভাইরাস থেকে শারীরিকভাবে তারা বাঁচতে পেরেছেন ঠিকই, কিন্তু এটাকে তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে বিভিন্ন দেশ।
বিপজ্জনক পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বছরজুড়ে বিভিন্ন দেশে তিন হাজার দুইশোর বেশি শরণার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই সাগরপথে অন্য দেশে পাড়ি দিতে গিয়ে মারা গেছে। এ বছর স্প্যানিস ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ থেকে সুদান পর্যন্ত নতুন করে শরণার্থী সঙ্কট শুরু হয়েছে।
বহু শরণার্থীকে বঙ্গোপসাগর এবং ভূমধ্যসাগরে কয়েক মাস ধরে ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিয়ে ভেসে থাকতে হয়েছে। করোনা মহামারির ঝুঁকির কথা বলে তাদেরকে গ্রহণ করা হয়নি। সেপ্টেম্বরে গ্রিসের শরণার্থী শিবির মরিয়ায় একটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এই শিবিরটিতে ১৩ হাজার শরণার্থীর বসবাস এবং সেখানকার অবস্থা অত্যন্ত মানবেতর। এদিকে গত অক্টোবরে সেনেগাল উপকূলে ১৪০ জন শরণার্থীর মৃত্যু হয়েছে। পুরো বিশ্ব করোনা মহামারি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এই ঘটনাগুলো সেভাবে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি।
মানবাধিকার কর্মী ও শরণার্থীদের অভিজ্ঞতা:
দিয়ানা জয়নাব আলহিনদাওয়ী সাবেক শরণার্থী ও একজন ফটোগ্রাফার। তিনি বলেন, চলতি মাসের শুরুর দিকে আমি গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে ফিরে আসি। এই দেশকে আমি আমার দ্বিতীয় আবাস বলে মনে করি। আমি কঙ্গোর ইতুরি প্রদেশে অবস্থান করছি। গত মার্চ থেকে এখানে জাতিগত সহিংসতা চলছে। শুধু ইতুরিতেই গৃহহীন হয়েছে ১৬ লাখ মানুষ। করোনার প্রকোপের মধ্যে হয়তো আপনারা এ ব্যাপারে অল্পই জেনেছেন অথবা কিছুই জানেননি।
পুরো বিশ্ব এই ঘটনায় অনেকটাই উদাসীন। এই অসহায় মানুষগুলোকে নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথাই নেই। আমার নিজের দেশে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শরণার্থীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পাওয়ার বিষয়টিকে ক্রমশ কঠিন করে তুলেছেন। এ বছর ট্রাম্প প্রশাসনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার শরণার্থীদের আশ্রয় না দেওয়াকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য করোনাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
তিনি বলেন, আমার পরিবারও একসময় শরণার্থী ছিল। এখন আমার চিকিৎসক বাবা যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জীবন বাঁচানোর জন্য কাজ করছেন।
১৯৮৭ সালে আমরা তৎকালীন কমিউনিস্ট রোমানিয়া থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। আমার বাবা তার জন্মভূমি ইরাকেও ফিরতে পারেননি; সেখানে তখন সাদ্দাম হুসেনের শাসন চলছিল। সে সময় আমার বাবার পরিবার ইরাক সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পাওয়ার কারণে আমরা আমাদের ভাগ্য বদলাতে পেরেছি। যদি আজকের পৃথিবীতে আমরা শরণার্থী হিসেবেই থাকতাম, তাহলে আমাদের ভাগ্য বোধহয় অন্যরকম হতো।
গ্রিসে আশ্রয় নেওয়া আফগান শরণার্থী আজিজ বারবারি বলেন, ২০২০ সাল এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ বছর। আমি এই পুরো বছরটি মরিয়া ক্যাম্পে কাটিয়েছি। এ বছর কোনো দিক থেকেই এখানে কোনো সাহায্য আসছে না। অপেক্ষা করতে করতে আমরা সাহায্য পাওয়ার আশাই ছেড়ে দিয়েছি।
রাজনীতিবিদরা কী করছে তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। তারা যা চায় তাই করে এবং অন্যরা নিঃশব্দে সেটা দেখে। অনেকটা আক্ষেপের সুরেই তিনি বলেন, মানুষ কীভাবে চোখ বন্ধ করে থাকে? অল্পবয়সী মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। শিশুদের আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই শীতে শিবিরগুলোতে ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া মানুষ, সমুদ্রে ডুবে যাওয়া মানুষ অথবা শুধু খাবার চেয়ে চপেটাঘাত খাওয়া মানুষদের ব্যাপারে কারো যেন কোনো মাথাব্যথা নেই।
৩৯ বছর বয়সী মোহাম্মদ আলী আলামি নামের আরও এক শরণার্থী বলেন, ২০২০ সাল আমার জন্য বিশেষ অভিজ্ঞতার একটি বছর। আমরা আহত শরীর ও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এখানে এসেছি। কিছু নিবেদিত মানুষ আমাদের ভালোবেসে আমাদের সাহায্য করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু এ বছর তাদেরকে তাদের দেশে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। আমাদের ক্ষতগুলো সারিয়ে তোলার জন্য এবং আমাদের কঠিন দিনগুলোর কথা ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য তাদেরকে আমাদের প্রয়োজন।
২০২০ সালে পুরো বিশ্ব এক হয়ে একটি অভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করেছে। করোনা কাউকে রেহাই দেয়নি। উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলো সমানভাবে এই বিপদে আক্রান্ত হয়েছে। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। আমি আশা করি, ২০২১ সালে পুরো বিশ্ব করোনার চেয়েও মারাত্মক সমস্যা যেমন- যুদ্ধ, ঔপনিবেশিক শাসন, বৈষম্য, বর্ণবাদ নির্মূল করতে ঐক্যবদ্ধ হবে।
এদিকে শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) পূর্ব ও হর্ন অব আফ্রিকা এবং গ্রেট লেকের আঞ্চলিক পরিচালক ক্লেমেনটাইন নেটা সালামি বলছেন, শরণার্থীদেরও ভ্যাকসিন কর্মসূচির আওতায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
২০২০ সালের শুরুতে শরণার্থীদের জন্য কিছুটা আশার আলো দেখা দিয়েছিল। কিন্তু মহামারি শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন দেশের সরকার লকডাউন, চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ এবং সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় শরণার্থীরা সুন্দর জীবনের যে স্বপ্ন দেখছিলেন তা অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা শরণার্থী ও অভিবাসীরা কাজ হারাতে শুরু করেন। একই সঙ্গে পারিবারিক সহিংসতা, বাল্যবিয়ে, অল্প বয়সে সন্তান ধারণ এবং আত্মহত্যার ঘটনাও অনেক বেড়ে গেছে।
ফারুক ফেরদৌস/টিটিএন/জেআইএম