আত্মোপলব্ধির ৭ মার্চ
প্রতি বছর মার্চ আসে, মার্চ যায়। এই মার্চ মাসটির সাথে বাঙালির জীবন নানাদিক থেকে নানাভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এই মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম-মাস। এই মার্চেই তৎকালে মানচিত্রখচিত প্রত্যাশিত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। এই মার্চেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল পূর্ব-বাংলা, আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ। রাজনৈতিক বিবেচনায় মার্চের চেয়ে উত্তাল সময় বাঙালিও খুব একটা অতিক্রম করেনি কোনো কালে। বিশেষত ১৯৭১ সালের মার্চের স্মৃতি আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। আর, ৭ মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল বাঙালির জেগে ওঠা, আত্মমুক্তি ও আত্মআবিষ্কারের দিক-নির্দেশক।
বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি ও সার্বিক স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সাহিত্য-শিল্পের নন্দনতাত্তিক বিবেচনায়ও পৃথিবীর ইতিহাস-প্রসিদ্ধ ভাষণসমূহেরও একটি হয়ে ধ্রুপদী উচ্চতায় টিকে আছে। আর, পাকিস্তানি নরঘাতকেরা এই মার্চেরই ২৫ তারিখের মধ্যরাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক অভিযান চালিয়ে জঘন্যতম গণহত্যা পরিচালনা করেছিল নিরস্ত্র ও নিরীহ বাঙালির ওপর। রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিয়ে পাকিস্তানিরা শুরু করেছিল বাঙালি নিধনের নির্মম যজ্ঞ। রাতের অন্ধকারে তারা বাঙালির প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বন্দী করে প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ও তার পরে পাকিস্তানের অন্ধকার কারাকারে আটকে রাখে। সেখানে কোর্ট মার্শালে তার বিচার প্রক্রিয়াও শুরু করে। কিন্তু বন্দী হওয়ার আগেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা জাতির উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। সেই থেকেই মার্চেরই ২৬ তারিখ বাঙালির স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষিত, উদযাপিত।
৭ মার্চের ভাষণে ব্যক্ত বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ বাঙালিরা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিপক্ষে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর কথামত এদেশের মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করে মহান স্বাধীনতা। সুতরাং মার্চ নানাভাবেই বাঙালির জীবনের সঙ্গে যুক্ত এবং স্মরণীয় এক মাসের নাম একথা বলা যায়। মার্চ বাঙালিকে উজ্জীবিত করার একটি মাসের নাম।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বঙ্গবন্ধুর জন্ম-মাস হওয়ায়ও বাঙালির জীবনে এই মার্চ মাসটির রয়েছে আলাদা এক আবেদন। এবছরের এই মার্চেও ১৭ তারিখ পালিত হবে, উদযাপিত হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি যেন নিজেকেই গৌরবের অংশভাগী করে নেয়। কিন্তু আমরা জানি, জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু নিজের জন্মদিন পালনে বিব্রতই বোধ করতেন। জনক-জননীকে সালাম করাই ছিল জন্মদিনে তাঁর সবচেয়ে বড় পাওয়া, ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সবচেয়ে বড় উদযাপন। বড় মাপের মানুষের এমন বিনয়-বোধ আমাদেরকে ভাবতে শেখায় আড়ম্বর নয়, মাতাপিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদনের মধ্য দিয়েই অর্জন সম্ভব জন্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহার।
নিজের জন্মদিন সম্পর্কে এমন নির্মোহ মানুষটির মৃত্যুদিবস এত কারুণ্যে ভরা হবে তা কে কখন ভেবেছিল! এমন মহান মানুষের মৃত্যুর দুর্বিষহ ইতিহাস আমাদের ব্যথিত করে। একদল বিপথগামীর ষড়যন্ত্র এবং লোভ-লালসার শিকার হতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মত এমন মানুষেকে, এমন এক বিশ্বনেতাকে। ১৫ আগস্টের সেদিন রাতের অন্ধকারে ঘাতকের বুলেটের আঘাত এই মহান রাষ্ট্রনায়ক ও তাঁর পরিবারের শিশুসহ ১৮জন সদস্যকে নির্মম-নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এই ভূগোল-বাংলা থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করেছিল ঘাতকেরা। কিন্তু ঘাতকের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে এই ভূগোল-বাংলা থেকে, এই ভূগোল-বাংলার ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। বরং ইতিহাসের প্রত্ম-অভিযানে এই ভূগোল-বাংলার নানা প্রান্ত থেকে, নানা স্তর থেকে বঙ্গবন্ধু আরো বেশি প্লাবিত হয়ে ওঠেন। চারিদিক ছাপিয়ে, চারিদিক ভাসিয়ে সগর্ব উচ্চারণে বঙ্গবন্ধু বাঙালির জীবনে মূর্ত হয়ে উঠেন নিরন্তর। তাই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনেও তাঁর হত্যা-দিবসের চিত্রই আমাদের ব্যথিত করে, আমাদের সকল অর্জনকে ম্লান করে দেয়।
আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি মহিমাময় মার্চ মাসকে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে ব্যক্ত হয়ে উঠেছিল বাঙালির স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মুক্তিলাভের আকাক্ষা। মাত্র সতেরো কি আঠারো মিনিটের একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতিকে উজ্জীবিত করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল এজন্য যে, এদেশবাসী সেকালে একমাত্র বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ওপরই রাজনৈতিকভাবে আস্থা ও ভরসা স্থাপন করতে পারতো। আবাল্য রাজনৈতিক সংগ্রাম ও সাধনায় তিনিই বাঙালির সকল আশা-আকাক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন। নানা আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু তাঁর কথায় ও কাজে যে নিষ্ঠা দেখিয়েছিলেন তার জন্যই বাঙালি জাতির নিকট তিনিও লাভ করেছিলেন অপরিসীম ভালোবাসা। সাধারণ মানুষের নিকট থেকে তিনি এই গভীর ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলন স্বীয় রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কারণে।
সমগ্র জীবনের রাজনৈতিক সাধনায় তিনি মানুষকে প্রতারিত করেননি কোনো কালে। তাই ৭ মার্চে তাঁর দেওয়া ডাক বাংলার সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বানেই সর্বস্তরের মানুষ সংঘবদ্ধভাবে পাকিস্তানি অপশাসনের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে সমর্পণ করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করেনি। তাঁরই আহ্বানে তিরিশ লক্ষ মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে কুণ্ঠিত হয়নি বরং সাড়ে সাত কোটি বাঙালিই সেদিন দীপ্ত প্রত্যয়ে উন্মুখ ছিল যতদিন স্বাধীনতা অর্জিত না হবে ততদিন সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। তাই বাঙালির জীবনে মার্চের গুরুত্ব অসীম। বাঙালির অস্তিত্বের সাথে জড়িত এই মার্চ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ারও অবকাশ নেই। একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ৭ মার্চের সেই ভাষণ ছিল বাঙালির আত্মআবিষ্কারের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা। এই প্রেরণার প্রাণবিন্দু থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ারও অবকাশ নেই।
কিন্তু, মার্চের এবং ৭ মার্চের চেতনা ও প্রেরণা আমাদেরকে কতটুকু জর্জরিত রাখে সেটিই আসল প্রশ্ন। পরাজিত পাকিস্তানিদের মতো এদেশীয় মূলধারার রাজনৈতিক সংগঠন বিএনপিও যখন শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক তোলে তখন নিশ্চিতভাবেই আমাদের উপলব্ধি করা উচিৎ যে, এই দলটি মার্চের চেতনা থেকে, মার্চের প্রেরণা থেকে তথা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনারও পরিপন্থি। ১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাবলি যাদেরকে উজ্জীবিত করে না তাদেরকে ধিক্কার জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের ভাষায় আক্ষেপের সঙ্গে শুধু এটুকুই বলা যায় : “সেজন কাহার সৃজন নির্ণয় ন জানি।”
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এইচআর/এমএস