এশিয়ার এক সময়ের শীর্ষ ধনীর নাটকীয় উত্থান-পতন
![এশিয়ার এক সময়ের শীর্ষ ধনীর নাটকীয় উত্থান-পতন](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2023March/1-20231001162639.jpg)
এক সময় এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন চীনের অন্যতম বৃহৎ রিয়েল স্টেট কোম্পানি এভারগ্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান হুই কা ইয়ান। ২০১৭ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের জরিপে এশিয়ার ধনী ব্যক্তিদের তালিকার শীর্ষে ছিলেন তিনি।
ছয় বছর আগে হুইয়ের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ হাজার ২৫০ কোটি ডলার। তবে ২০২১ সালে ঋণ খেলাপি হয় এভারগ্র্যান্ড। তখন থেকেই পতনের শুরু হুই কা ইয়ানের। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, এভারগ্র্যান্ডের ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। বিশ্বে আর কোনো আবাসন কোম্পানির এত বেশি ঋণ নেই।
কে এই হুই কা ইয়ান?
১৯৫৮ সালে সেন্ট্রাল হেনান প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন হুই কা ইয়ান। বয়স এক বছর হওয়ার আগেই (আট মাস) তার মা মারা যান। পরে বেড়ে ওঠেন নানির আদর-যত্নে।
২০১৭ সালে তাইহাই পাবলিশিং হাউজ হুইয়ের জীবনী প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ছোটবেলায় তিনি তার পরিবারকে গ্রামের বাজারে ভিনেগার ও কাঠ বিক্রিতে সহায়তা করতেন। চরম অভাবের মধ্যে কেটেছে তার ছোটবেলা। কিন্তু এর মধ্যেও তিনি তার পড়ালেখা চালিয়ে যান।
১৯৮২ সালে হুই কা ইয়ান উহান আয়রন অ্যান্ড স্টিল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর স্থানীয় একটি স্টিলের কারখানায় কাজ শুরু করেন। ১৯৯২ সালে তিনি দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর শেনঝেনে চলে যান ও একটি ট্রেড কোম্পানিতে পাঁচ বছর কাজ করেন।
এরপর তিনি চলে যান গুয়াংঝু শহরে। সেখানে একটি ডেভেলপার কোম্পানির সেলসম্যান হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে গুয়াংঝু শহরেই প্রতিষ্ঠা করেন নিজের কোম্পানি ‘এভারগ্র্যন্ডে’।
হুই তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। এমনকি ২০০৮ সালে তিনি চীনের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা গ্রুপের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। এলিট এ গ্রুপটি সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত দেশের শীর্ষ উপদেষ্টা সংস্থা হিসেবে কাজ করে।
ফরাসি বিনিয়োগ ব্যাংক নাটিক্সিসের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিয়া গার্সিয়া হেরেরো বলেন, যদি আপনি যথেষ্ট স্মার্ট হন ও পরিশ্রম করেন তবে যে কেউ ধনী হতে পারে- তার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হলেন হুই কা ইয়ান।
বিস্ফোরক উত্থান
২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকটের সময় চীন সরকার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে চার ট্রিলিয়ন ইউয়ানের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। আবাসন কোম্পানিগুলো সেখান থেকে অল্প সুদে ঋণ নেওয়ার সুযোগ পায়। এতে দেশটিতে জমি থেকে শুরু করে অ্যাপার্টমেন্টের দাম দ্রুত বেড়ে যায়। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে পর্যাপ্ত তহবিল সংগ্রহ করে এভারগ্র্যান্ডে।
বিশ্লেষকরা জানান, হুই ওই সময় তহবিল সংগ্রহে সবচেয়ে আগ্রাসী ভূমিকা রাখেন। বন্ড থেকে শুরু করে ব্যাংকঋণ, এমনকি তৃতীয় পক্ষ থেকেও অর্থ সংগ্রহ করতে থাকেন। এতে তার ব্যবসাও ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে।
একটা সময় রিয়েল স্টেট থেকে গাড়ি তৈরি, খাদ্য ও পানীয় উৎপাদন, ইঞ্জিনিয়ারিং, সংবাদমাধ্যম, স্বাস্থ্য ও আর্থিক সংস্থাসহ নানা ধরনের ব্যবসা শুরু করে এভারগ্রান্ডে। এমনকি চীনের শীর্ষ ফুটবল দল গুয়াংঝু এফসিতেও বিনিয়োগ করে প্রতিষ্ঠানটি।
বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দ্রুত বাড়তে থাকা এভারগ্র্যান্ডে ২০০৯ সালে হংকং স্টক মার্কেট থেকে ৯০০ কোটি ডলার সংগ্রহ করে।
আর্থিক বাজার গবেষণা প্ল্যাটফর্ম বন্ডসুপারমার্টের জ্যাকসন চ্যানের মতে, এভারগ্র্যান্ডের দ্রুত উত্থানের অন্যতম কারণ ছিল- হংকংয়ের সবচেয়ে ধনী রিয়েল এস্টেট টাইকুনদের একটি গ্রুপের সঙ্গে হুইয়ের ভালো বন্ধুত্ব ও এভারগ্র্যান্ডকে হংকং স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত করার সুযোগ পাওয়া।
হুই কা ইয়ান তার হংকংয়ের বন্ধুদের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিলেন। হংকংয়ের রিয়েল এস্টেট টাইকুনদের অনেকেই এভারগ্রান্ডের ব্যবসা বৃদ্ধিতে সহায়তা করার জন্য কোম্পানিটির প্রচুর স্টক ও বন্ড কিনেছিলেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এভারগ্রান্ডে ২০২১ সাল পর্যন্ত চীনের ২৮০টি শহরে ৯০০টির মতো আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করেছে। নিজস্ব ওয়েবসাইট অনুসারে বর্তমানে চীনের ২৮০টিরও বেশি শহরে ১ হাজার ৩০০ প্রকল্প রয়েছে এভারগ্র্যান্ডের। কোম্পানিটির মোট কর্মী দুই লাখের বেশি, অস্থায়ী কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৩৮ লাখ।
এভারগ্র্যান্ডের ব্যবসায়িক মডেল ছিল মূলত বড় অঙ্কের অর্থ ধার নেওয়া ও পরে তড়িঘড়ি করে এমন সব অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করা, যার নির্মাণকাজই শুরু হয়নি।
পতন
করোনা মহামারি শুরুর আগ পর্যন্ত এভারগ্র্যান্ডের মতো চীনা রিয়েল স্টেট কোম্পানিগুলো ক্রেতাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা আর ব্যাংকঋণের মাধ্যমে ফ্ল্যাট তৈরি করতো। কিন্তু ২০২০ সালে আবাসন খাতের ঋণের জন্য নতুন আইন জারি করে চীন। ‘থ্রি রেড লাইনস’ নামের ওই আইনে ঋণের নেওয়ার জন্য প্রপার্টি ডেভেলপারদের ওপর বেশকিছু শর্তারোপ করা হয়।
নতুন আইনে আরোপিত শর্তগুলোর কারণে আগের মতো চাইলেই ঋণ পাওয়ার সুযোগ হারিয়ে ফেলেন চীনা আবাসন ব্যবসায়ীরা। আর তাতে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে এভারগ্র্যান্ডের মতো জায়ান্ট কোম্পানিগুলো।
ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যাওয়ায় বড় প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করতে না করতেই দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয় এভারগ্র্যান্ডে। সেই সঙ্গে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয় ৩০ হাজার কোটি ডলারের ঋণ। তাছাড়া ঋণ খেলাপি হওয়ার পর হুই কা ইয়ানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে শি জিনপিং প্রশাসন। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করে।
জানা যায়, সংকটের কারণে শেয়ারবাজারে এভারগ্র্যান্ডের মূল্য ৯৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে ও হুইয়ের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৪ হাজার ২৫০ কোটি ডলার থেকে মাত্র ৩২০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।
এভারগ্র্যান্ডের অবস্থা এখন এতটাই খারাপ যে, গত ১৭ আগস্ট নিউইয়র্কের আদালতে চ্যাপ্টার ১৫ দেউলিয়াত্ব সুরক্ষা আবেদন করে গ্রুপটি। বিদেশি কোনো কোম্পানির ঋণ পুনর্গঠনে কাজ চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্রে সেটির সম্পত্তির সুরক্ষা দেয় চ্যাপ্টার ১৫।
সূত্র: বিবিসি
এসএএইচ