অবসরে গেলেন ২৩তম প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী
দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী অবসরে গেলেন। এর মধ্য দিয়ে ১৭ বছরের বিচারক জীবনের ইতি ঘটতে যাচ্ছে তার। সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) অবসরে গেলেও হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বিচারপতি হিসেবে শেষ কর্মদিবস পার করেছেন গত ৩১ আগস্ট। ওইদিন শেষবারের মতো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এজলাসে বসেছিলেন তিনি। এরপর গত ১ ও ২ সেপ্টেম্বর ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ৩ সেপ্টেম্বর শুরু হয় সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি। সে হিসেবে গত ৩১ আগস্টই ছিল তার শেষ কর্মদিবস।
রেওয়াজ অনুযায়ী ৩১ আগস্ট অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি বিদায়ী প্রধান বিচারপতির বিদায় সংবর্ধনা দেয়। তবে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আইনজীবীদের একাংশ উপস্থিত ছিল না।
২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি পদে শপথের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করেন হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। টানা ২০ মাস বিচারিক প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
আবদুল গফুর মোল্লা ও নূরজাহান বেগম দম্পতির সন্তান হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার রমানাথপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ৯ ভাইবোনদের মধ্যে তিনি চতুর্থ।
আরও পড়ুন: বিদায় বেলায় কাঁদলেন প্রধান বিচারপতি
তিনি খোকসা জানিপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে এসএসসি এবং ১৯৭৪ সালে সরকারি পিসি কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন। পরে তিনি ধানমন্ডি ল’ কলেজ থেকে আইনে স্নাতক করেন।
১৯৮১ সালে হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। একই বছরের ২১ আগস্ট জেলা আদালতে আইন পেশায় যোগ দেন। ১৯৮৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তিনি আইনজীবী হিসেবে হাইকোর্ট এবং ১৯৯৯ সালের ২৭ মে আপিল বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হন।
তিনি খুলনা সিটি করপোরেশন, কুষ্টিয়া পৌরসভা, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন সংস্থা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রধান আইন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে কাজ করেছেন। দায়িত্ব পালনে অসুবিধার কথা উল্লেখ করে ২০০৮ সালের ৪ জুন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।
এর আগে ২০০১ সালে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তবে হাইকোর্টের নিয়মিত বিচারপতি থাকা সত্ত্বেও ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তাকে বাদ দেওয়া হয়। পরে ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ আপিল বিভাগের বিচারক হন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিচারপতি হিসেবে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ভারতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি। এছাড়াও তিনি সৌদি আরব সফর করেছেন।
আরও পড়ুন: পরবর্তী প্রধান বিচারপতি গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবেন
এছাড়াও তিনি ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথমবার মেয়াদ শেষ হলে তাকে ২০২০ সালে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে পুনরায় নিযুক্ত করা হয়। ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
তার বড় ভাই বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি থেকে অবসরে গিয়েছেন। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী ও প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী দেশের ইতিহাসে প্রথম দুই ভাই- যারা সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে আসীনের নজির স্থাপন করেছেন।
প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বিচার বিভাগে গতিশীলতা আনতে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের সমন্বয়ে বেঞ্চ পুনর্গঠন, সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন ছাড়া কর্মস্থল ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা, পুরোনো মামলা নিষ্পত্তিতে বিভিন্ন সময়ে বিশেষ বেঞ্চ গঠনসহ বিচারকদের পূর্ণ কর্মঘণ্টা কাজে ব্যয় করার নির্দেশনা দিয়ে বেশ কিছু আদেশ জারি করেন।
অধস্তন আদালতে বিভাগওয়ারি মামলাজট তদারকি ও পর্যালোচনাসহ মামলা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে হাইকোর্টের আট বিচারপতির নেতৃত্বে পৃথক কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। বছরব্যাপী এসব কমিটি নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করে।
প্রধান বিচারপতি দেশের অধস্তন আদালতগুলো পরিদর্শন করার পাশাপাশি সেখানকার সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেন। বিচারক ও আইনজীবীদের মামলাজট কমাতে তাগিদ দেন। এসব কাজ সার্বিকভাবে মামলাজট কমাতে সহায়ক হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশের সব আদালতে বিচারাধীন ছিল ৪২ লাখ ৮ হাজার ৯৮৭ মামলা। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারাধীন মামলা ছিল ৪২ লাখ ৩ হাজার ৫১৬টি। এ সময়ে নতুন মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তি বেড়েছে।
এছাড়া প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর কর্মকালে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত হয় বঙ্গবন্ধুর স্মারকসংবলিত স্তম্ভ ‘স্মৃতি চিরঞ্জীব’। এখানে আরও রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৬৯ আইনজীবীর নামের তালিকা। সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে বিচারপ্রার্থীদের সুবিধার্থে নির্মাণ করা হয়েছে ‘ন্যায়কুঞ্জ’ নামে বিশ্রামাগার।
এফএইচ/কেএসআর