পাইলট নিয়োগে অনিয়ম

তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে পদক্ষেপের নির্দেশ হাইকোর্টের

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:৩৯ এএম, ১৩ মার্চ ২০২৪

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে (বিমান) পাইলট নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, শিক্ষা সনদ জালসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি।

মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজীক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এসব সুপারিশ অনুযায়ী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা প্রতিবেদন আকারে আগামী ১৯ মার্চের মধ্যে দাখিল করতে নির্দেশ দেন আদালত।

এ সময় আদালত পাইলট নিয়োগে অনিয়মের তদন্ত প্রতিবেদন দেখে উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিসহ আমজনতা সবাই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের যাত্রী। এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে লোক দেখানো হলে সেটি মেনে নেওয়া হবে না।

আদালতে এদিন রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তানভীর আহমেদ। সিভিল এভিয়েশনের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট সাইফুর রশিদ। আর, রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাইনুল হাসান।

আদেশের বিষয়ে রিটকারী আইনজীবী তানভীর আহমেদ বলেন, গত বছর মার্চ মাসে বিমানের পাইলট নিয়োগের অনিয়ম নিয়ে পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদনযুক্ত করে আমি একটি রিট দায়ের করি। ওই রিটের শুনানি নিয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন আদালত। ওই তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করেন, যাতে অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা প্রমাণিত হয়েছে এবং পত্রিকার প্রতিবেদনের সত্যতা রয়েছে। তবে ঘটনার সত্যতা পেলেও দোষীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেটি বলা হয়নি। এ কারণে আদালত দোষীদের বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন।

গত বছরের ১ মার্চ দেশের একটি ইংরেজি পত্রিকায় পাইলট নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ উড্ডয়নের জন্য চুক্তিভিত্তিক পাইলটদের একটি ব্যাচ নিয়োগ দিয়েছিল। নিয়োগের সময় বিমান দাবি করেছিল যে তাদের পাইলট সংকট থাকায় অবিলম্বে এ নিয়োগ দিতে হবে। এর ১ বছর পরে নিয়োগ করা ১৪ জন পাইলটের মধ্যে মাত্র ৫ জন উড়োজাহাজ উড্ডয়ন করেছে।বাকিরা আটকে আছেন জাল সনদ, অযোগ্যতা ও লাইসেন্সিং পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে।

বিমান তাদের দিয়েছে মোটা অংকের বেতন, সেইসঙ্গে প্রশিক্ষণের জন্য খরচ করেছে বিপুল অর্থ, যার সবই গেছে জলে। অপারেশন ম্যানুয়াল অনুযায়ী, বিশ্বের বৃহত্তম যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ বোয়িং ৭৭৭ উড়তে ফার্স্ট অফিসারদের কমপক্ষে ৩০০ ঘণ্টার ফ্লাইং অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্তদের কারোই সেই অভিজ্ঞতা নেই।

এ প্রতিবেদনের পর সংক্ষুব্ধ হয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন আইনজীবী তানভীর আহমেদ। সেই রিটের শুনানি শেষে গত বছরের ১৩ আগস্ট হাইকোর্ট বিষয়টি তদন্ত কররে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন।

এরপর আদালতের নির্দেশে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুহাম্মদ আশরাফ আলী ফারুকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির বাকি সদস্য হলেন- বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. মুকিত-উল-আলম, চিফ অব প্লাইট সেফটি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ক্যাপ্টেন এনামুল হক তালুকদার।

কমিটির প্রতিবেদন:

শিক্ষা সনদ জালিয়াতি, নিয়োগে কোনো নীতিমালা নাই, বিমানের নিজস্ব পাইলট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকা আবশ্যকসহ তদন্ত কমিটি পর্যবেক্ষণসহ ১৬টি সুপারিশ উপস্থাপন করেছেন।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশে যা বলা হয়েছে:

এক. তৎকালীন চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন সাজিদ আহমেদের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ককপিট/ কেবি ক্র সংক্রান্ত বিমান পরিচালনা পর্ষদের বিশেষ সাব কমিটির ৬ষ্ঠ সভায় বিমানের বিভিন্ন উড়োজাহাজে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

দুই. পরিচালনা পর্ষদের ২৬৬ তম সভায় সমগ্র চাহিদার ৬০ শতাংশ বা সামগ্রিক সংখ্যার ২৫ জন ক্যাপ্টেন/ ফার্স্ট অফিসারকে জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এরপর বোয়িং ৭৭৭ এর জন্য ৫ জন ক্যাপ্টেন এবং ১০ জন ফার্স্ট অফিসার নিয়োগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীতে ৫ জন ক্যাপ্টেন ও ৬ জন ফার্স্ট অফিসার চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয় এবং ৩ জন ক্যাপ্টেনকে অপেক্ষমান তালিকায় রাখা হয়।

তিন. ক্যাপ্টেন সাজিদ আহমেদের মৌখিক বিবৃতি অনুসারে কর্তৃপক্ষের মৌখিক নির্দেশে তিনি বিদেশে অবস্থানরত বিভিন্ন বাংলাদেশি পাইলটদের সাথে ইমেইল এবং নানাভাবে যোগাযোগ করে বিমানে বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজের পাইলট হিসেবে যোগদানের সুযোগের বিষয়টি অবহিত করেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশের পূর্বে এ ধরনের যোগাযোগ নৈতিকতা পরিপন্থি।

চার. সাধারণত ৭৩৭ এবং ৭৮৭ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে ‘টাইপ রেটেড’(বিমানের এক ধরণের সার্টিফিকেশন) চাওয়া হয়। কিন্তু বোয়িং ৭৭৭ এর ক্যাপ্টেন এবং ফার্স্ট অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘টাইপ রেটেড’ চাওয়া হয়নি। যা এখানে বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।

পাঁচ. বোয়িং ৭৭৭ এর কো-পাইলট/ফার্স্ট অফিসারের যোগ্যতা হিসেবে বিগত দুই বছরে পাইলটের কমপক্ষে ৩০০ ঘণ্টা উড্ডয়ন ঘণ্টা থাকা আবশ্যক কিন্তু বিজ্ঞাপনের শর্তে সেটি দেওয়া হয়নি।

ছয়. ক্যাপ্টেন হিসেবে ২০০০ ঘণ্টা উড্ডয়নের অভিজ্ঞতা বিপরীতে বিমানের ওএমডি অনুসারে মাত্র ৫০০ ঘণ্টা উড্ডয়নের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। যার ফলে তুলনামূলক কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পাইলটদের ক্যাপ্টেনদের হিসেবে যোগাদানের সুযোগ তৈরি হয়। অথচ বিমানের ক্যারিয়ার প্ল্যান অনুযায়ী ২০০০ ঘণ্টা উড্ডয়নের শর্তারোপ করলে অধিক যোগ্যতা সম্পন্ন ক্যাপ্টেন নিয়োগ করা যেত।

সাত. সরাসরি ফার্স্ট অফিসার ও ক্যাপ্টেন নিয়োগের জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কোন স্বতন্ত্র নীতিমালা নাই। বিমানের পাইলট ঘাটতি পূরণের জন্য বিমানের নিজস্ব পাইলট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকা আবশ্যক।

আট.নিজ স্ত্রী আবেদনকারী হওয়া সত্বেও বিমানের তৎকালীন চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন সাজিদ আহমেদ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলেন। বিষয়টি তিনি লিখিতভাবে কাউকে অবহিতও করেননি। এজন্য আত্মীয় প্রার্থী বা প্রশিক্ষণার্থী থাকলে নিয়োগ সংক্রান্ত বা সংশ্লিষ্ট যে কোনো পদে উক্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীর না থাকার বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি।

নয়. ফার্স্ট অফিসার সাদিয়া আহমেদের শিক্ষা সনদ(মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক) জাল প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য তার সকল লাইসেন্স বাতিল করেছে এবং তার বিরুদ্ধে বেসামরিক বিমান চলাচল আইনে মামলা করা হয়েছে।

দশ. ফার্স্ট অফিসার আল মেহেদী ইসলাম বেবিচকের চিঠি জাল করে (অন্য একটি চিঠি স্ক্যান করে নিজের নাম বসিয়ে) সব বিষয়ে পাশ করেছে বলে একটি চিঠি তৈরি করেছেন। তার রেকর্ড পর‌্যালোচনা না করে তার দাখিল করা সনদের উপর ভিত্তি করে তাকে প্রশিক্ষণে পাঠানোয় বিমানের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। যদিও পরে তার লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

এগার. ক্যাপ্টেন সাজিদ বোয়িং ৭৭৭ এর একজন প্রশিক্ষক হলেও তিনি তার স্ত্রী কোন প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনা করেননি। তবে তিনি তার স্ত্রী ফার্স্ট অফিসার সাদিয়া আহমেদের থাইল্যান্ডের সিমুলেটর ট্রেনিং চলাকালীন সময়ে পরীক্ষণের উদ্দেশ্যে উক্ত সিমুলেটর ট্রেনিং সেন্টার পরিদর্শন করেন। তার স্ত্রীর প্রশিক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেন। স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিবেচনায় যা সুশাসনের পরিপন্থী।

বার. যে সকল ক্যাপ্টেনদের ২০০০ ঘণ্টা বা তার বেশি ক্যাপ্টেন হিসেবে উড্ডয়নের অভিজ্ঞতা ছিল তাদের ক্ষেত্রে পূর্ণ সক্ষমতা অর্জনের সময়কাল তুলনামূলক কম লাগতো।

তের. বিমান বাংলাদেশ নতুন নিয়োগ-প্রাপ্ত সকল চুক্তিভিত্তিক পাইলটদের প্রথম প্রশিক্ষণ, ফ্লাইট হতে বেতন প্রদান করে। অথচ তাদের বেতন পাওয়ার কথা প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হওয়ার পর থেকে।

চৌদ্দ. সিমুলেটর প্রশিক্ষণ সমাপনান্তে বিভিন্ন কারণে বিমানে পাইলট হিসেবে অযোগ্য হওয়ায় তাদের প্রশিক্ষণ ব্যয়ের জন্য বিমান আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পনের. ২০২৩ সালের ১৫/১৬ জানুয়ারি বিমানের জেদ্দা-ঢাকা ফ্লাইটে ক্যাপ্টেনে দিলদার আহমেদ তোফায়েলের বেশি কিছু সময় ককপিটের বাইরে থাকা, বেবিচকের ফ্লাইট অপারেশন্স ইন্সপেক্টরের ক্যাপ্টেন মো. ফরিদুজ্জামান পাইলট সিটে আসনগ্রহণ করা এবং ওই ফ্লাইটে একজন রোগীর মৃত্যু নিয়ে বেবিচক এবং বিমান তদন্ত করে। পরে অবহেলার কারণে তার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে।

ষোল. এ ঘটনায় ক্যাপ্টেন আলী রুবিয়াত চৌধুরী এবং ফার্স্ট অফিসার রাফি উজ জামানকে সতর্কতামূলক চিঠি দেওয়া হয়েছে।

এফএইচ/এমএএইচ/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।