শিশুর শরীরে অতিরিক্ত চিনি যেসব ক্ষতি করে

লাইফস্টাইল ডেস্ক
লাইফস্টাইল ডেস্ক লাইফস্টাইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:৫৩ পিএম, ০৩ আগস্ট ২০২৫
শিশুর শরীরে অতিরিক্ত চিনি যেসব ক্ষতি করে

বাচ্চারা অনেক সময় সাধারণ খাবার খেতে চায় না, কিন্তু চকলেট বা অন্য মিষ্টিজাতীয় যেকোন খাবার দিলে চটপট সেটি খেয়ে ফেলে। বেশিরভাগ বাবা-মা জানেন যে, অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার গ্রহণ করা খারাপ। কিন্তু কতটা খারাপ? কোন খাবারে কতটুকু চিনি আছে? বাচ্চারা কতটুকু খাচ্ছে? এগুলো অনেকেই জানেন না।

প্রথমে কথা বলি চিনি নিয়ে। বর্তমান বাজারে আমরা যেসব চিনি পাই, তার বেশিরভাগ পরিশোধিত বা প্রক্রিয়াজাত চিনি। এগুলো দেখতে সাদা ও চকচকে। এতে প্রাকৃতিক ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান কম থাকে ও ক্যালরির পরিমাণ বেশি থাকে যা শরীরের জন্য অস্বাস্থ্যকর। শিশুর শরীরে এগুলোর প্রভাব সম্পর্কে জানিয়েছেন পুষ্টিবিদ লিনা আকতার

শিশুর শরীরে অতিরিক্ত চিনি যেসব ক্ষতি করে

১. ইনসুলিনের মাত্রা


চিনি শরীরের ইনসুলিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে ও চর্বিতে রুপান্তরিত করতে পারে। ইনসুলিন বৃদ্ধি শিশুকে অলস, ক্লান্ত ও বিরক্ত করে তোলে।

২. ওজন বৃদ্ধি ও স্থুলতা


চিনিতে ক্যালরি বেশি ও পুষ্টিগুণ কম থাকে। এর ফলে চিনিযুক্ত মিষ্টি খাবার বেশি খেলে শিশুর দৈনিক ক্যালরির চাহিদার চেয়ে ক্যালরি শরীরে যায়, যা তাদের ওজন বাড়াতে শুরু করে। চিনি শুধু শক্তি দেয়, প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান না থাকায় শিশু অপুষ্টিতেও ভুগতে পারে।

৩. ফ্যাটি লিভার


গবেষণা অনুসারে, বর্তমানে ১৩ শতাংশের বেশি শিশুর নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার রয়েছে। লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমলে আরও গুরুত্বর অবস্থার দিকে চলে যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এই চর্বি লিভারে প্রদাহ, ফুলে যাওয়া, লিভার সিরোসিস এবং লিভার ড্যামেজের কারণ হতে পারে।

শিশুর শরীরে অতিরিক্ত চিনি যেসব ক্ষতি করে

৪. টাইপ-টু ডায়াবেটিস


ব্যস্ত সময়সূচীর কারণে বাবা-মায়েরা অনেক সময় সন্তানের খাবারের পুষ্টিগুণ খেয়াল করতে পারেন না। কাজ সামলানোর জন্য অনেক সময় তারা সন্তানকে বাইরে থেকে খাবার কিনে খেতে দেন। এতে শিশুর স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়। প্রায় প্রতিটি প্যাকেটজাত খাবারেই বিভিন্ন ধরনের চিনি থাকে। এটি সরাসরি শিশুর শরীরে চিনির মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং টাইপ-টু ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়া পরিবারে কারও ডায়াবেটিস থাকলে বাচ্চার খাবারে কী দিচ্ছেন সে সম্পর্কে আরও বেশি সতর্ক থাকা উচিত।

৫. দাঁতের ক্ষয়


আমরা সকলে জানি চিনি দাঁতের ক্ষতি করতে পারে। এছাড়া বাচ্চাদের দাঁত ও মাড়ি বড়দের থেকে অনেক বেশি সংবেদনশীল। তাহলে ভাবুন চিনি তাদের দাঁতের স্বাস্থ্যের উপর কতটা প্রভাব ফেলে। আমাদের মুখের ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া চিনিকে অ্যাসিডে পরিণত করে যা দাঁতের এনামেল নরম করে তোলে। ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া আমাদের লালার পিএইচ মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়।

আরও পড়ুন 

৬. পেটের সমস্যা


যখন কেউ অতিরিক্ত চিনি জাতীয় খাবার খায় তখন অন্ত্রে খারাপ ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে যায়। আর অন্ত্রে খারাপ ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে গেলে পরিপাকতন্ত্রে গ্যাস, পেট ফাঁপা, ডায়রিয়া জাতীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে।

৭. স্মতিশক্তি হ্রাস


অতিরিক্ত পরিমানে চিনি গ্রহণ করলে শিশুর স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং মনোযোগের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

শিশুর শরীরে অতিরিক্ত চিনি যেসব ক্ষতি করে

৮. হৃদরোগ


গবেষণা থেকে জানা গেছে, অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ শিশুর হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে, যার ফলে মেদবৃদ্ধি ও ডিসলিপিডেমিয়া হয়। আজকাল শিশুরা ফোনে বেশি সময় দেয় এবং শারীরিক কার্যকলাপ কম। এই কারণে শিশুদের হৃদযন্ত্রের পেশীগুলো যতটা শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিলো ততটা শক্তিশালী নয়, তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে খারাপ খাদ্যাভাস। এসব কারণে হৃদরোগসহ শিশুর নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিতে পারে।

কোন কোন খাবারে চিনি থাকে

চিনি অনেক ধরনের হয়। যেমন ফ্রুক্টোজ, এটি ফলে থাকে। ম্যাল্টোজ পাওয়া যায় অঙ্কুরোদগম শস্যে, এটি মিল্কশেক ও ক্যান্ডিতেও যোগ করা হয়। দুধের মধ্যে পাওয়া যায় ল্যাকটোজ। ডেক্সটোজ তৈরি হয় ভুট্টা থেকে। ভুট্টার স্টার্চ থেকে কৃত্রিমভাবে এটি নিষ্কাষিত হয়। আর সুক্রোজ হল পরিশোধিত চিনি, যা আখ থেকে বের করা হয়।

ফ্রুক্টোজ, সুক্রোজ, ডেক্সটোজ – নামগুলো হয়তো আপনি প্যাকেটজাত পণ্যের গায়ে লেখা দেখেছেন। আবার আমরা যেসব খাবার খাই তার অনেক কিছুর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে চিনি। সেগুলি পুষ্টিকর হলেও তাতে চিনি থাকে, যেমন – মিষ্টি দই, পাস্তা, সস, সিরিয়াল, জুস, পিনাট বাটার, প্যাকেটজাত সিরাপ, বিস্কুট, কেক, পেস্টি, চকলেট ইত্যাদি। পাশাপাশি এগুলোতে থাকে কার্বোহাইড্রেট, যা ভেঙ্গে গ্লুকোজে পরিণত হয়।।

যেভাবে শিশুর খাবারে চিনি এড়িয়ে চলবেন

১. ঘরের তৈরি করা খাবার অভ্যাস করুন


শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস গড়ে তুলতে প্রথমত পিতামাতাকে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস গ্রহণ করতে হবে। কারণ বাবা মায়েরা যা করে শিশুরা তাই অনুকরণ করে। ঘরের তৈরি খাবারের চেয়ে ভালো কিছুই হতে পারে না। আর এটি অভ্যাস করে ফেললে ধীরে ধীরে আর কোন সমস্যা হবে না।

২. রস নয়, ফল খাওয়ান


যদিও ঘরে তৈরি তাজা ফলের রস ভালো, তবে নিয়মিত নয়। এর পরিবর্তে গোটা ফল খাওয়াবেন। কারণ এতে ভালো ফাইবার থাকে যা ফ্রুক্টোজ শোষণের প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়।

শিশুর শরীরে অতিরিক্ত চিনি যেসব ক্ষতি করে

৩. খাবারের লেবেল পড়ার অভ্যাস করুন


যদি আপনার সন্তানের জন্য বাইরের প্যকেটজাত করা খাবার কিনতে চান অবশ্যই প্যাকেট এর গায়ে লেবেল দেখে নিবেন। এতে কতটুকু চিনি, সোডিয়াম, কোলেস্টেরল আছে তা দেখে নিতে ভুলবেন না।

আপনারা শুনে অবাক হবেন যে ফল, শাকসবজি, দুগ্ধজাত দ্রব্য, গোটা শস্য, সিরিয়াল, ওটস ইত্যাদিতে চিনি থাকে। কিন্তু এগুলো প্রাকৃতিক চিনি, পুষ্টিকর উপাদান।

কতটুকু চিনি খাবে আপনার বাচ্চারা

  • >> শিশুদের প্রতিদিনের চিনির পরিমাণ ১২ থেকে ২৪ গ্রাম হওয়া উচিত, যা ৩ থেকে ৬ চা চামচ চিনির সমান। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন শিশুদের প্রতিদিন ২৫ গ্রামের কম চিনি খাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে, যা প্রায় ৬ চা চামচ। কিন্তু আজকাল শিশুরা প্রতিদিন প্রায় গড়ে ১৬ চা চামচ চিনি খাচ্ছে। এই অতিরিক্ত চিনি শিশুকে স্থূলতাসহ নানারকম স্বাস্থ্যসমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
  • >> আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স সতর্ক করে বলেছে যে, দুই বছরের শিশুদের খাদ্যতালিকায় চিনি দৈনিক ক্যালরির মাত্র ১০ শতাংশ থাকা উচিত। কেননা অতিরিক্ত চিনি শিশুর অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। শিশুর খাদ্যতালিকা থেকে স্পোটস ড্রিংকস বা সোডা এবং চিনিযুক্ত পানীয় বাদ দেয়া উচিত। কারন একটি সোডায় প্রায় ৯ গ্রাম পর্যন্ত চিনি থাকে।

শিশুকে অল্প বয়সে চিনিযুক্ত খাবার খাওয়ানো হলে পরবর্তীতে স্থূলতা, কার্ডিওভাস্কুলার রোগ, দাঁত ক্ষয় হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এছাড়া মিষ্টিজাতীয় খাবার খেলে বড় হলে সেই খাবারের প্রতি আসক্তি বেড়ে যেতে পারে।

বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, চিনিযুক্ত খাবারে ক্যালরি বেশি থাকলেও এটি ক্ষুধা নিবারণ করে না। এছাড়া মিষ্টি খাবারের এই অভ্যাস বড় হলেও থেকে যায়, তখন মস্তিষ্কে ডোপামিন নিংসরণ করে। এটি ভালো লাগার রাসায়নিক যা অল্প সময়ে জন্য তৃপ্তিবোধ করতে পারে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরে ক্ষুধা আবার ফিরে আসে, ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়।

লেখক: লিনা আকতার, পুষ্টিবিদ, রাইয়ান হেলথ কেয়ার হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, দিনাজপুর।

এএমপি/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।