আঘাতপরবর্তী মানসিক চাপ যেভাবে শিশুর জীবন পাল্টে দেয়
একটা দুর্ঘটনা, প্রিয়জনের মৃত্যু, সহিংসতা, বা বড় ধরনের জীবনের ধাক্কা – এই ধরনের ঘটনার পর আমাদের শুধু শরীর না, মনেও বড় ধাক্কা লাগে। এই মানসিক ধাক্কাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় আঘাতপরবর্তী মানসিক চাপ বা ট্রমা। এটা হঠাৎ ক্ষণিকের অনুভূতি না, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদে জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে।
ট্রমা কীভাবে কাজ করে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ট্রমা হলো এমন এক অভিজ্ঞতা, যা একজন মানুষের নিরাপত্তা, জীবনের স্থিরতা ও মানসিক স্থিতিশীলতার উপর বড় প্রভাব ফেলে। এটি আমাদের মস্তিষ্কে ভয়ের কেন্দ্র অ্যামিগডালা এবং স্মৃতির অংশ হিপোক্যাম্পাসকে সরাসরি প্রভাবিত করে। বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরীদের ওপর এর প্রভাব বিশেষভাবে মারাত্মক হতে পারে।
সম্প্রতি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটা বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া এমন অনেক শিশু ও কিশোর-কিশোরী এখন ভয়াবত মানসিক আঘাতের মোকাবেলা করছে। ভয়াবহ শারীরিক আঘাতের সঙ্গেই তারা চোখের সামনে পুড়ে ঝলসে যেতে দেখেছে তাদের বন্ধুদের ও প্রিয় শিক্ষকদের। তাই শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি এখন তাদের মানসিক অবস্থার দিকে মনোযোগী হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
এজন্য অভিভাবকদের এখন এ বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। জেনে নিন ট্রমা কীভাবে আপনার সন্তানকে প্রভাবিত করতে পারে-
ট্রমা কিশোর-কিশোরীদের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলে?
১. মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে ব্যাঘাত
মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালে মস্তিষ্কের যে অংশগুলো সিদ্ধান্ত নেওয়া, আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে, তা তখনো পুরোপুরি পরিপক্ব হয়নি। ট্রমা এই বিকাশে ব্যাঘাত ঘটিয়ে কিশোরকে মানসিকভাবে দুর্বল ও আবেগপ্রবণ করে তোলে।
২. আত্মপরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি
এই বয়সে ছেলেমেয়েরা নিজের পরিচয় ও আত্মমর্যাদা গড়ে তোলে। ট্রমাটিক ঘটনা তাদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে, এবং নিজেকে 'ভুল' বা 'দোষী' ভাবতে শেখায়। ফলে আত্মপরিচয়ের বিকাশ ব্যাহত হয়।
ছবি/প্রতীকী
৩. আচরণগত পরিবর্তন
অনেক সময় দেখা যায়, তারা হঠাৎ অত্যন্ত চুপচাপ বা অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে পড়ে। কারও প্রতি অতিরিক্ত সন্দেহ, হঠাৎ রেগে যাওয়া, নিজের প্রতি ক্ষতিকর আচরণ (যেমন হাত কাটা), অথবা আত্মহত্যার চিন্তাও দেখা যেতে পারে।
৪.সম্পর্কে বিচ্ছিন্নতা
তারা অনেক সময় বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে, বিশ্বাস হারায়, কারও সঙ্গে অনুভূতি শেয়ার করতে চায় না। এতে একাকীত্ব, বিষণ্নতা এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা বাড়ে।
৫. নিরাপত্তাহীনতা
ভয়াবহ দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতার কারণে তারা দীর্ঘদিন পর্যন্ত নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে পারে। অল্পতে ভয় পেয়ে যাওয়া, বারবার চমকে ওঠার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
বিশেষ সতর্কতা কেন দরকার?
বয়ঃসন্ধিকাল এমন একটি সময়, যা ভবিষ্যতের মানসিক স্বাস্থ্যের ভিত্তি তৈরি করে। এই সময়ে ট্রমার চিকিৎসা না পেলে তা ভবিষ্যতে ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, আসক্তি, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, এমনকি সিজোফ্রেনিয়া-র মতো গুরুতর মানসিক রোগে রূপ নিতে পারে।
ছবি/প্রতীকী
যা করবেন-
>> আচরণে পরিবর্তন দেখলে বিশেষজ্ঞ শিশু মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
>> কাউন্সেলর বা মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শদাতা এ সময় শিশুর বিকাশে অসামান্য ভূমিকা রাখতে পারে।
>> কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি শিশুদের জন্য বিশেষ কার্যকর, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে।
>> পরিবারের সচেতন সমর্থন খুব জরুরি। পরিবার থেকে শিশুকে বারবার আশ্বস্ত করুন যে, সে একা নয়।
>> শিশুর আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন দেখলে তা অবহেলা করবেন না।
>> ওদের সঙ্গে খোলামেলা ও সমবেদনাপূর্ণভাবে কথা বলুন।
>> তাদের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিন, মনোযোগ দিয়ে কথা শুনুন।
সূত্র: আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডলোসেন্স সাইকিয়াট্রি, চাইল্ড মাইন্ড ইন্সটিটিউট, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
এএমপি/এএসএম