দুটি আহত হৃদয়

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৩১ পিএম, ০৪ জুলাই ২০২৫

কবির হোসেন মিজি

শহরের ছোট্ট একটি গলির ভেতর নতুন একটি ক্লিনিক চালু হয়েছে। নাম ‘সহজ চিকিৎসাকেন্দ্র’। শহরের যত কোলাহল, তার বাইরে হালকা নীরবতা। পাশেই একটি পুরোনো আমগাছের নিচে ধুলা-বালির রাস্তা।

ডা. রাফিদ প্রথম দিন ক্লিনিকে এসেছে। শহরের কোনো এক বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি ছেড়ে ফিরে এসেছে নিজের শহরে। বয়স ত্রিশ ছুঁইছুঁই। চোখে সাদা চশমা কিন্তু চোখ দুটো কেমন ক্লান্ত। জানালার পাশে বসে বিকেলের রোদ গায়ে মেখে কফির কাপ হাতে যখন ভাবছিল, জীবনের সব জটিলতা যেন এই মেঘলা বিকেলে জমাট বেঁধে আসে। ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। রাফিদ বলল, ‘ভেতরে আসুন।’

দরজা খুলে একটি মেয়ে প্রবেশ করে। পরনে হালকা ছাইরঙা সালোয়ার কামিজ। চোখে কাচের ফ্রেম, হাতে পুরোনো একটি খাতা। রাফিদ চোখ তুলে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি মায়া চৌধুরী?’
মেয়েটি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জানালো। তারপর বসে পড়লো চেয়ারে। তার চোখে একটা ধোঁয়াশা। যেন অনেক কথা জমে আছে চোখে কিন্তু উচ্চারণের শক্তি নেই।

‘আপনার সমস্যা কী?’ প্রশ্ন করলো রাফিদ। মায়া অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আমি ঘুমাতে পারি না। ঠিকমতো খেতে পারি না। কারো সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না।’
‘এই অবস্থা কতদিন ধরে?’
‘আট মাস।’
‘কী কারণে এমনটা শুরু হলো বলে মনে হয়?’
মেয়েটি এবার গভীরভাবে তাকালো, ‘সবকিছু একসাথে ভেঙে পড়ে যখন; তখন মানুষ একটি শব্দ দিয়ে কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে না, ডাক্তার সাহেব।’
রাফিদ চুপ করে গেলো।

পরদিন আবার মায়া এলো ক্লিনিকে। আজ তার চোখে ঘুমের চিহ্ন নেই বরং ঘুমহীন রাতের নিঃসঙ্গতা। রাফিদ প্রশ্ন করলো, ‘আপনার পরিবারে কে কে আছেন?’
‘বাবা নেই। মা একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। আমি বাসায় একা থাকি।’
‘আপনি কি আগে কখনো কাউকে এসব বলেছেন?’
‘না। কাউকে বলার মতো সম্পর্কও ছিল না।’
‘কোনো বন্ধু আছে?’
‘বন্ধু ছিল একজন। এখন নেই।’
‘সে কি পুরুষ?’
‘হ্যাঁ।’
‘তার নাম বলবেন?’
‘নাম বলে কি আর কিছু হবে ডাক্তার সাহেব?’

মায়া চৌধুরীর কথা শুনে রাফিদ কিছু একটা নোট করে রাখলো। মায়া হঠাৎ বলল, ‘আপনি কি কখনো কাউকে এতটা বিশ্বাস করেছেন যে, নিজেকেই ভুলে গেছেন?’
রাফিদ চমকে গেলো। প্রশ্নটা তার নিজের জন্যও হতে পারতো। একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ, করেছি।’
‘আর এখন?’
‘বিশ্বাস ফিরে আসে না।’
মায়া মাথা নাড়লো। বলল, ‘ঠিক। কারো প্রতি একবার বিশ্বাস হারিয়ে গেলে, সেই মানুষটার প্রতি আর আগের মতো বিশ্বাস থাকে না।’

আরও পড়ুন

সপ্তাহ দুয়েক কেটে যায়। মায়া নিয়মিত ক্লিনিকে আসা-যাওয়া করে। তার চোখের নিচে কালি জমে আছে কিন্তু কণ্ঠের ভার কমে না। একদিন সে নিজে থেকেই বলতে শুরু করল—‘আমি আরাফকে ভালোবাসতাম। পাঁচ বছর ধরে। আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্কের নাম ছিল না। ছিল শুধু বোঝাপড়া, প্রতীক্ষা আর অভিমান। একদিন আমার মা অসুস্থ হলেন, আমি ছুটে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে। ফিরতে দেরি হয়েছিল। ফিরে এসে শুনি, ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’
রাফিদ চুপ হয়ে যায়।
‘আরাফ আমাকে কিছু বলেনি। শুধু লিখেছিল একটা ছোট্ট নোট, তুই দেরি করলি, ব্যস।’
‘তুমি কী করেছিলে?’ প্রশ্ন করলো রাফিদ।
‘কিছু না। মরে যেতে পারতাম কিন্তু বাঁচতে শিখলাম। তবে ভেতরটা আজও প্রতিদিন মরে যায় একটু একটু করে।’
রাফিদ তার ফাইল বন্ধ করে রাখলো।
‘তোমার এখন যা দরকার, সেটা হলো নতুন একটা পথ। কেউ একজন যার সঙ্গে তুমি নতুন করে হাঁটতে পারো।’
মায়া তাকালো, ‘সবাই কি পারে নতুন করে শুরু করতে?’
‘সবাই না কিন্তু কেউ কেউ পারে। চাইলে তুমিও পারবে।’

একদিন দুপুরে হঠাৎ করেই বৃষ্টি নামলো। শহরটা ভিজে একাকার। ক্লিনিক বন্ধ। মায়া এলো না। রাফিদ কফির কাপ হাতে একা জানালার ধারে বসে আছে। মায়ার কথা ভাবছে। ইদানীং মেয়েটাকে নিয়ে অদ্ভুত এক টান অনুভব করে। চিকিৎসার বাহিরে একজন মানুষ হিসেবে।
সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো রাফিদের। অপর প্রান্ত থেকে মায়ার মা বললেন, ‘আপনি ডা. রাফিদ?’
‘জি।’
‘মায়া আজ হাসপাতালে ভর্তি। হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়েছে। প্রেসার খুব কম।’
রাফিদের বুক ধক করে উঠলো। রাত দশটায় ছুটে গেলো শহরের জেনারেল হাসপাতালে। মায়া চোখ বুজে শুয়ে আছে। মাথার ওপর স্যালাইন ঝুলে আছে। পাশে বসা মা বললেন, ‘কিছু খাচ্ছিলো না কয়েকদিন। আপনি তো তার খুব আপন হয়ে গেছেন মনে হয়।’
রাফিদের বুকে মোচর দিয়ে উঠলো। একটি মেয়ে, যার পৃথিবীটা খুব ছোট হয়ে গিয়েছিল। সেই পৃথিবীতে সে হয়তো একটু জায়গা করে নিয়েছে।

দুই সপ্তাহ পর মায়া কিছুটা সুস্থ। ক্লিনিকে আবার দেখা হলো।
‘আপনি কেন এত করলেন আমার জন্য?’ মায়া জিজ্ঞেস করলো।
‘কারণ আমি বুঝি, নীরব কষ্ট কী জিনিস। কারণ আমিও একসময়...’
‘কী হয়েছিল আপনার?’
‘বিয়ে হয়েছিল আমারও। খুব ভালোবাসতাম তাকে। কিন্তু ও আমাকে রেখে নতুন কাউকে খুঁজে নিয়েছে। আজ চার বছর আমি একা।’
মায়ার চোখে জল। দুজন মানুষ। দুজন আহত আত্মা। এক বিকেলে একসাথে বসে আছে। তারা কেবল চুপচাপ তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকে।

রাফিদ একদিন চিঠির মতো একটি কাগজ মায়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো।
‘এটা কী?’
‘একটা প্রস্তাব। তবে চিকিৎসকের নয়, একজন মানুষের পক্ষ থেকে।’
মায়া খুলে পড়লো—
‘মায়া,
আমি জানি তুমি কাউকে আর বিশ্বাস করো না। আমিও করতাম না। কিন্তু যদি আমরা একসাথে বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করি? হয়তো খুব ধীরে ধীরে আমরা নতুন করে নতুন দিগন্তে হাঁটতে পারবো।
রাফিদ।’

পড়ে মায়া চুপ করে রইলো। কেবল দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, ‘চেষ্টা করে দেখতে পারি। তবে এক শর্তে।’
‘কী শর্ত?’
‘আমরা এক বিকেল চুপচাপ থাকবো। কোনো কথা বলবো না। শুধু নীরব থাকবো। যদি সেই নীরবতাও সুন্দর মনে হয়, তবে নতুন করে শুরু করবো।’
রাফিদ হেসে বলল, ‘চলো, আজই সেই বিকেলটা কাটাই।’
বিকেলে তারা দুজন শহরের বাইরে নদীর পাড়ে হাঁটছিল। বাতাসে হালকা কচুরিপানার গন্ধ। আকাশের নিচে ভেসে বেড়ানো ফেলে-আসা বিকেল। কেউ কিছু বলছে না, শুধু হাতে হাত রেখে হাঁটছে।
হঠাৎ মায়া থেমে বলল, ‘তোমার ওপর একটু ভরসা করতে ইচ্ছা করছে।’
রাফিদ বলল, ‘তাহলে আর চুপচাপ নয়, এবার একটু একটু করে ভালোবাসা হোক আমাদের মাঝে।’
রাফিদের চোখে তাকিয়ে মায়া হাসলো। সেই হাসি যেন কয়েক বছরের গুমোট কান্নাকে সরিয়ে এক নতুন বিকেলের দরজা খুলে দিলো।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।