ওকাপের গবেষণা

ফ্রি ভিসা প্রতারণায় অভিবাসীদের এক বছরে ক্ষতি ৩০ হাজার কোটি টাকা

কূটনৈতিক প্রতিবেদক কূটনৈতিক প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:১২ পিএম, ১৯ অক্টোবর ২০২৫
উপসাগরীয় দেশগুলোতে কর্মরত বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকরা ফ্রি ভিসা পদ্ধতির নামে অনৈতিক ও প্রতারণামূলক নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণে ক্ষতির শিকার হন/ছবি: সংগৃহীত

উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থার (জিসিসি) অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে কর্মরত বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকরা ২০২২ সালে তথাকথিত ফ্রি ভিসা পদ্ধতির নামে অনৈতিক ও প্রতারণামূলক নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণে আনুমানিক ৩০ হাজার কোটি টাকা হারিয়েছেন। এটি ছিল ওই বছরের বাংলাদেশের মোট জিডিপির শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশের সমান।

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচি (ওকাপ) পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনটি রোববার (১৯ অক্টোবর) রাজধানীর একটি হোটেলে প্রকাশ করা হয়।

গবেষণা অনুযায়ী, এ আর্থিক ক্ষতির মূল কারণ হচ্ছে প্রবাসে পৌঁছানোর পর নানা ধরনের চাঁদাবাজি, অতিরিক্ত নিয়োগ ফি ও ফ্রি ভিসার নামে লুকানো বিভিন্ন খরচ। ওই ৩০ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত ব্যয় মূলত গন্তব্য দেশগুলোতেই স্থানান্তর করা হয়েছে, যা অভিবাসন খরচের চেয়ে তিন থেকে ছয় গুণ অতিরিক্ত ছিল। এ বিপুল আর্থিক ক্ষতি দেশের প্রবাসী আয় ও বিনিয়োগ সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে।

গবেষণাটি ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে অভিবাসীপ্রবণ আটটি জেলায় এক হাজার ৮৪ জন প্রবাসীর ওপর পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ৫১ শতাংশ অংশগ্রহণকারী তথাকথিত ফ্রি ভিসা নিয়ে জিসিসি দেশগুলোতে গিয়েছিলেন।

ওকাপের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ফ্রি ভিসাধারী শ্রমিকদের ৫৭ শতাংশ পরবর্তীতে কোনো অতিরিক্ত টাকা না দিয়েই কাজের আনুষ্ঠানিক অনুমতিপত্র পেয়েছেন। তবে ২১ শতাংশ শ্রমিককে গড়ে এক লাখ ৪৮ হাজার ৮৮০ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়েছে অনুমতির জন্য। আরও চার শতাংশকে চাকরি পেতে অতিরিক্ত ৪৪ হাজার টাকা এবং প্রায় সমপরিমাণকে চাকরি হারানোর পর দেশে ফেরার বিমানের টিকিট বাবদ ৪৮ হাজার ৮৮৯ টাকা গুনতে হয়েছে। সব শ্রমিককেই প্রথম বেতনের আগে খাদ্য, বাসাভাড়া ও অন্যান্য জীবিকায় গড়ে ৩০ হাজার টাকা খরচ বহন করতে হয়েছে। এভাবেই তথাকথিত ফ্রি ভিসার কারণে বিদেশে গিয়ে কাজের পেছনে আরও অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয় কর্মীদের। ফলে মূল অভিবাসন ব্যয়সহ ফ্রি ভিসার বাণিজ্যে অতিরিক্ত যায় প্রায় ১৮ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। 

গবেষণার সামগ্রিক হিসাবে দেখা যায়, ২০২২ সালে জিসিসি দেশগুলোতে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের বহন করা মোট অতিরিক্ত খরচের পরিমাণ ছিল ৩০০ দশমিক ২৭ বিলিয়ন টাকা। বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৫৫ দশমিক ২২ ট্রিলিয়ন টাকার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, এ ক্ষতি দেশের অর্থনীতির প্রায় অর্ধ শতাংশেরও বেশি।

ফ্রি ভিসা প্রতারণায় অভিবাসীদের এক বছরে ক্ষতি ৩০ হাজার কোটি টাকা

ওকাপ চেয়ারম্যান ও প্রধান গবেষক শাকিরুল ইসলাম বলেন, অভিবাসন ব্যয়ের পেছনে বাংলাদেশের কর্মীদের সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। গবেষণায় এক হাজার ৮৪ জন অভিবাসীর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে ৫১ শতাংশ কর্মী তথাকথিত ফ্রি ভিসা এবং ৪৯ শতাংশ কর্মী কাজের ভিসা নিয়ে বিদেশ গেছেন। ফ্রি ভিসা শব্দটি বিভ্রান্তিকর। এটি বিনামূল্যে বা আইনগতভাবে স্বীকৃত নয়। এর পরিবর্তে এটি শোষণমূলক নেটওয়ার্কের জন্য একটি সরঞ্জাম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, অভিবাসন ব্যয় বাড়িয়ে তুলেছে, পরিবারগুলোকে ঋণের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে এবং জাতীয় রেমিট্যান্স প্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে।

ওকাপ চেয়ারম্যান জানান, এ ক্ষতি শুধু ব্যক্তিগত বা পারিবারিক নয়, এটি একটি বড় ম্যাক্রো ইকনমিক লিকেজ, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ পরিস্থিতির তিনটি বড় প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতে। প্রথমত, জাতীয় বিনিয়োগের ক্ষতি হচ্ছে। যে বিপুল অর্থ স্থানীয় ব্যবসা, শিক্ষা বা উন্নয়নে কাজে লাগতে পারত, তা অনিয়ন্ত্রিত চ্যানেলের মাধ্যমে বিদেশে চলে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে। কারণ ভুয়া নিয়োগ ফি দিতে নেওয়া সুদের ওপর ঋণ পরিশোধে প্রবাসীরা তাদের উপার্জনের বড় অংশ ব্যয় করছেন। ফলে দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, মূলধন পাচার ঘটছে। কারণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার এ প্রতারণামূলক লেনদেন মূলত অবৈধভাবে অর্থ পাচারের সমান। যা দেশের আর্থিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতাকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

গবেষণার তথ্য বলছে, নিয়মিত ভিসার চেয়ে তথাকথিত ফ্রি ভিসায় অভিবাসন ব্যয় বেশি। উদাহরণসরূপ বলা যায়, কুয়েতে সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় এক লাখ ছয় হাজার ৭৮০ টাকা। কিন্তু ফ্রি ভিসাতে কুয়েতের অভিবাসন ব্যয় সাত লাখ ৩৩ হাজার ৩০৩ টাকা এবং নিয়মিত কাজের ভিসায় খরচ করতে হয় ছয় লাখ ১৯ হাজার ১৬৭ টাকা। একইভাবে সৌদি আরব, ওমান, কাতার ও দুবাইয়ের ক্ষেত্রেও নির্ধারিত ব্যয়ের তিন-চার গুণ খরচ করতে হয় কর্মীদের।

তথ্য বলছে, তথাকথিত ফ্রি ভিসায় বিপুল অর্থ খরচ করে গন্তব্য দেশে যাওয়ার পরও আরও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয় কর্মীদের। সব মিলিয়ে কাজ নিশ্চিত করতে একজন কর্মীর মোট খরচ হয় সাত লাখ ২২ হাজার ৭০০ টাকা। তাতে করে গড়ে অভিবাসন ব্যয় দাঁড়ায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা।

গবেষণায় জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী বলা হয়, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১১ লাখ ৩৫ হাজার শ্রমিক বিদেশে গিয়েছিলেন, যার মধ্যে ৯ লাখ ৩৮ হাজার যান জিসিসি দেশগুলোতে।

ওকাপ চেয়ারম্যান জানান, প্রায় ৫৪ শতাংশ নিয়োগ অবৈধ সাব-এজেন্টদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে, যা খাতটিকে আরও স্বচ্ছ কাঠামোর আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।

ওকাপের গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে স্ট্রেনদেনড অ্যান্ড ইনফরমেটিভ মাইগ্রেশন সিস্টেমস প্রকল্পের আওতায়। এতে বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ড দূতাবাস অর্থায়ন এবং হেলভেটাস সুইস ইন্টারকো-অপারেশন বাংলাদেশ সহযোগিতা করেছে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া। তিনি তথাকথিত ফ্রি ভিসা সম্পর্কিত আর্থিক প্রভাব নিয়ে গবেষণার তথ্য তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ জানান।

অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক ছিলেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রকল্প ব্যবস্থাপক রাহনুমা সালাম খান, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মাইগ্রেশন পলিসি ও সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইউনিটের হেড অব প্রোগ্রাম শ্রুতি ইশিতা এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সটি অব বাংলাদেশের অধ্যাপক ড. কাজী মাহমুদুর রহমান।

এছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার প্রশাসক মো. আশরাফ হোসেন, সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান, সাবেক সহ-সভাপতি নোমান চৌধুরী, ঢাকার সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজিয়া হায়দার, ওকাপের নির্বাহী পরিচালক ওমর ফারুক এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ওকাপের প্রোগ্রাম সমন্বয়ক এ এ মামুন নাসিম।

জেপিআই/একিউএফ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।