পুলিশের আইডি কার্ড দিয়ে বিক্রয় ডটকমে মোবাইল বিক্রির প্রতারণা
বিক্রয় ডটকমে বিজ্ঞাপন দিয়ে পুলিশের আইডি কার্ড ব্যবহার করে গ্রাহকের আস্থা অর্জন করে মোবাইল বিক্রির কথা বলে ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। এ চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ।
গ্রেফতাররা হলেন- সোজায়েত আহমেদ শিখন (২১), আল আমিন (২০) ও শাহিনুর রহমান বিপ্লব। তাদের কাছ থেকে ১২টি মোবাইল, ২৭৯টি সিম, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের ১৬টি বুকিং বই, বুকিংয়ের ১০টি সিল, ২টি ল্যাপটপ ও প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ৮টি মোবাইল জব্দ করা হয়।
রোববার (২১ নভেম্বর) রাতে ডিএমপির (সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) জুনায়েদ আলম সরকার জাগো নিউজকে এসব তথ্য জানান।
গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, গ্রাহকের বিশ্বাস অর্জন করতে প্রতারক চক্র দুটি অভিনব পথ বেছে নিয়েছিল। প্রথমত, পুলিশ সদস্য পরিচয় দিয়ে ক্রেতার কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র পাঠাতো। দ্বিতীয়ত, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের বুকিং স্লিপ পাঠানো হতো। জাতীয় পরিচয়পত্র তারা প্রতারণার মাধ্যমে সংগ্রহ করেছিল। আর সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের আসল বুকিং বই টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করেছিল। বিক্রয় ডটকমে বিজ্ঞাপন দিয়ে মোবাইল ফোন বিক্রির নামে মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চক্রের সদস্যদের ব্যবহৃত সব সিমই ভুয়া রেজিস্ট্রেশন করা। এসব সিম তারা বিভিন্ন উৎস ও ভাসমান সিম বিক্রয় প্রতিনিধির কাছ থেকে কিনেছেন। সিম বিক্রয় প্রতিনিধিরা চক্রের সদস্যদের কাছে বিক্রির উদ্দেশ্যেই সাধারণ মানুষের সিম রেজিস্ট্রেশন করার সময় একাধিকবার আঙুলের ছাপ নিয়ে রাখতেন। পরে তাদের নামে সিম তুলে প্রতারক চক্রের সদস্য আল আমিনের কাছে ৩৫০ টাকায় বিক্রি করতেন। আল আমিন চক্রের মূল হোতা সোজায়েত আহমেদ শিখন ও শাহিনুর রহমান বিপ্লবের কাছে এই সিম বিক্রি করতেন ৫০০ টাকায়। এছাড়া আল আমিন অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে কুরিয়ারটির বুকিং বই সংগ্রহ করতেন। প্রতিটি বইয়ের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৩৫ হাজার টাকা দিতেন তিনি। এ বইয়ের জন্য তিনি সোজায়েত ও শাহিনুরের কাছ থেকে নিতেন ৩৮ হাজার টাকা।

ভুয়া রেজিস্ট্রেশন করা সিম দিয়ে জিমেইল অ্যাকাউন্ট খুলতো চক্রের সদস্যরা। ভুয়া জিমেইল ও ভুয়া রেজিস্ট্রেশন করা ফোন নম্বর ব্যবহার করে বিক্রয় ডটকমে অ্যাকাউন্ট খোলা হতো। বিভিন্ন সময় ৭২০টি ভুয়া জিমেইল অ্যাকাউন্ট খুলেছে এ চক্র। বিক্রয় ডটকমের প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন মোবাইল ফোনের ছবি আপলোড করে বিক্রির বিজ্ঞাপন দিতেন তারা। এসব পোস্ট দ্রুত ও বেশি প্রচারের উদ্দেশ্যে ওই প্রতিষ্ঠানকে পোস্টপ্রতি ২০৯ টাকা দিতেন অধিক প্রচারের তালিকায় রাখার জন্য। ক্রেতার কাছে চক্রের সদস্যদের কেউ পুলিশ সদস্য সাজতো, কেউ সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী পরিচয় দিতো।
এর ফলে প্রতারকরা দ্রুত কাস্টমারদের সাড়া পেতো। কাস্টমাররা প্রতারকদের পোস্টের ইনবক্সে মোবাইল কেনার জন্য আগ্রহ জানালে বিস্তারিত যোগাযোগের জন্য প্রতারক চক্রের সদস্যের ভুয়া রেজিস্ট্রেশন করা সিমের নাম্বার দিতো এবং ওই নাম্বারের ইমোতে যোগাযোগ করতে বলতো। মোবাইল হস্তান্তরের মাধ্যম হিসেবে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস ও টাকা লেনদেনের জন্য ই-ট্রানজেকশন ব্যবহার করার কথা কাস্টমারকে জানাতো। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মোবাইল পাঠানোর আগে ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে মোবাইল মূল্যের ৫০ শতাংশ টাকা অগ্রিম প্রদান করতে হবে ও বাকি ৫০ শতাংশ টাকা মোবাইল পাঠানোর জন্য সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে বুকিং দেওয়ার পর বুকিং স্লিপ প্রদর্শনের পর পরিশোধ করতে হবে বলে জানাতো।
কাস্টমার অগ্রিম টাকা পাঠানোর প্রস্তাবে রাজি না হলে কাস্টমারের বিশ্বাস অর্জনের জন্য নিজেকে পুলিশ দাবি করতো ও ইমো মেসেজ ইনবক্সে পুলিশের আইডি কার্ডটি পাঠাতো। ফলে কাস্টমাররা মোবাইলের মূল্যের ৫০ শতাংশ টাকা ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে অগ্রিম দিয়ে দিতো ও মোবাইল পাঠানোর জন্য তাদের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর ইমোতে দিয়ে দিতো। এরপর মোবাইল মূল্যের বাকি ৫০ শতাংশ টাকা আত্মসাৎ করার জন্য তারা অসৎ উপায়ে কুরিয়ার সার্ভিসের বুকিং বই ব্যবহার করে কাস্টমারের দেওয়া নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর ইত্যাদি লিখে প্রতারক চক্রের তৈরি করা কুরিয়ার সার্ভিসের সিলমোহরযুক্ত একটি বুকিং স্লিপ তৈরি করতো।
ওই স্লিপে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের যোগাযোগ নাম্বার হিসেবে প্রতারক চক্র সদস্যদের ভুয়া রেজিস্ট্রেশন করা সিম নাম্বার দিয়ে বুকিং স্লিপ তৈরি করতো। কাস্টমারের আরও বিশ্বাস অর্জনে ওই সিম থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি সেজে প্রতারক চক্রের সদস্যরাই কথা বলতো। কাস্টমাররা বুকিং স্লিপে দেওয়া নাম্বারে কল করে তার বুকিং বিষয়ে পুনরায় নিশ্চিত হওয়ার পর মোবাইলের মূল্য বাবদ বাকি ৫০ শতাংশ টাকা ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে পাঠাতেন ক্রেতা।
সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারি সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও কুরিয়ার সার্ভিস থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় বুকিং স্লিপে উল্লিখিত মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে কাস্টমাররা নাম্বারটি বন্ধ দেখতে পেত ও বিক্রয় ডটকমে পোস্টদাতার মোবাইল নাম্বারটিও বন্ধ পেতো। ভুক্তভোগীরা একের অধিক রিপোর্ট করলে বিক্রয় ডটকম পোস্ট ডিলিট করে দিতো। অনেক সময় নিজেরাই পোস্ট ডিলিট করে দিতো চক্রটি। এরপর মোবাইল কেনা কাস্টমাররা বুঝতে পারে যে তারা সংঘবদ্ধ একটি প্রতারক চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছে। পরে ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা করেন।
মামলার তদন্তভার গোয়েন্দা ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের কাছে আসার পর তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতারক চক্রের তিন সদস্যকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা এলাকা হতে গ্রেফতার করা হয়।
টিটি/এআরএ