ফারুকী হত্যা

পরিবারের সন্দেহ ইসলামী ছাত্রসেনা, সম্পৃক্ততা পায়নি সিআইডি

রাসেল মাহমুদ
রাসেল মাহমুদ রাসেল মাহমুদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:১৯ পিএম, ২০ ডিসেম্বর ২০২২
মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী/ ফাইল ছবি

২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে নিজ বাসায় খুন হন সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদের খতিব ও একাধিক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী। পরদিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় ফারুকীর ছেলে ফয়সাল ফারুকী বাদী হয়ে হত্যা ও ডাকাতির অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় অজ্ঞাতনামা নয় জনকে। হত্যার ঘটনার ৮ বছর ৩ মাস পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি মামলার বিচার কাজ। এমনকি চূড়ান্ত প্রতিবেদনই দিতে পারেনি পুলিশ। দিন যত গড়িয়েছে বিষয়টি যেন ততটাই ঘোলাটে হয়েছে। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে ফারুকীর পরিবার। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হত্যার ঘটনায় এখনো এই ধরনের কোনো তথ্য পাননি তারা।

নূরুল ইসলাম ফারুকীর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ফারুকীর ভক্ত থাকায় তাকে বিভিন্ন মাহফিলে নিয়ে যেতেন ইসলামী ছাত্রসেনার নেতারা। তাদের সংগঠনের পরিচিতি বাড়ানোর জন্য বেশ কয়েক বছর ফারুকীকে এভাবে ব্যবহার করেছেন বলে দাবি ফারুকীর পরিবারের। তবে একসময় এটা বুঝতে পেরে সংগঠনটির মাহফিলে যাওয়া বন্ধ করে দেন ফারুকী। ঘটনার (হত্যাকাণ্ডের) আগের দিন ইসলামী ছাত্রসেনার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসাইন তুষার ফারুকীর বাসায় যান। একপর্যায়ে তিনি ফারুকীকে হত্যার হুমকির কথা জানান বলে দাবি তার পরিবারের।

আরও পড়ুন: মাওলানা ফারুকী হত্যা রহস্যের জট খোলেনি

এদিকে, ফারুকী হত্যার ঘটনায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে আরেকটি মামলা হয়। জামায়াত নেতাসহ ৬ জনকে আসামি করে ওই মামলা করেন ইসলামী ছাত্রসেনার সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসাইন তুষার। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে একটি হোটেলে বসে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় বলে দাবি ফারুকীর পরিবারের। এ পরিকল্পনার কথা ফারুকীকে ইসলামী ছাত্রসেনার সাধারণ সম্পাদক জানান দাবি করে তারা বলেন, হত্যার পরিকল্পনাকারীরা বিভিন্ন টেলিভিশনের উপস্থাপক এবং ফারুকী ও তুষারের মতাদর্শের বিরোধী বলে তুষার জানিয়েছিলেন।

এ অবস্থায় ফারুকীর পরিবারের প্রশ্ন, কারওয়ান বাজারে যদি ফারুকী বিরোধীদের মিটিং হয় তাহলে ছাত্রসেনার সাধারণ সম্পাদক তুষার সেখানে কীভাবে গেলেন? কেন গেলেন বা তিনি এসব তথ্য কীভাবে জানতে পারলেন? এতে সন্দেহ হয় দলীয় স্বার্থে তারা হয়তো কোনো ঘটনা ঘটাতে পারেন। কারণ হত্যার হুমকি থাকতে পারে এমন তথ্য জানানোর পরদিনই ফারুকী খুন হন। ফলে সন্দেহ তৈরি হয়, এ হত্যাকাণ্ডে ইসলামী ছাত্রসেনার রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য বা তাদের সংশ্লিষ্টতা আছে কি না?

গণমাধ্যমের তথ্য পর্যালোচনায় জানা গেছে, ফারুকী হত্যার পরই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ইসলামী ছাত্রসেনা বেশ আলোচনায় আসে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংগঠনটির প্রচারণা, নাম-ডাক বেড়ে যায়। ফারুকী হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে সারা দেশে অর্ধদিবস ধর্মঘটও পালন করে সংগঠনটি। এসব বিষয় তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছিল দাবি করে ফারুকীর পরিবার বলছে, তারা (তদন্তকারী কর্মকর্তারা) আমলে নিয়েছেন কি না তা তারা জানেন না।

ফারুকীর পরিবারের এসব অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসাইন তুষার জাগো নিউজকে বলেন, নুরুল ইসলাম ফারুকী স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের প্রেসিডিয়াম সদস্যের দায়িত্ব নেন। হত্যাকাণ্ডের আগপর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। দলের প্রচারের স্বার্থে তাকে ব্যবহার করার অভিযোগটি ভিত্তিহীন। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার প্রধান ও দেশের প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট কারও ব্যক্তি ইমেজের ওপর ভিত্তি করে চলে না।

কারওয়ান বাজারের সভায় উপস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, ঢাকা ট্রেড সেন্টারে বৈঠকটি ছিল ইসলামিক ঘরানার মিডিয়াকর্মী ও কলাককুশলীদের একটা সংগঠনের। আমি এই সংগঠনের একজন সদস্য। খোদ ফারুকী সাহেবও ওই সংগঠনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। তিনি সেদিন সভায় ছিলেন না। ফারুকী সাহেব আমাকে ফোন দিয়ে বললেন সভা শেষে বাসায় চলে এসো। আমি তখন বাসায় গিয়ে সভায় যেসব কথাবার্তা হয়েছে এবং উনাকে (ফারুকী) নিয়ে যেসব নেতিবাচক কথাবার্তা হয়েছে তা জানালাম। সেখানে উনাকে সমর্থন দিয়ে আমি ও আরেকজন ছাড়া কেউ প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তখন তিনি বললেন আমার ওপর এর আগেও হামলা হয়েছে।

আরও পড়ুন: সালমান শাহ অধ্যায় শেষ, কূলকিনারা হয়নি সাগর-রুনি-ফারুকী হত্যার

মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী হত্যা মামলাটি প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করে। পরে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশকে। ২০১৫ সালে মামলাটি ডিবি থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) হস্তান্তর করা হয়। ৮ বছরেরও বেশি সময়ে মামলাটি তদন্ত করেছেন ৭ থেকে ৮ জন তদন্ত কর্মকর্তা। এরমধ্যে প্রায় ৭ বছরই তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা। আর এই ৭ বছরেও ফারুকী হত্যার তদন্ত শেষ করতে পারেনি সিআইডি। গত কয়েক মাস আগে তদন্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জিসানুল হক সিআইডি থেকে বদলি হওয়ায় মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির আরেক কর্মকর্তা অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কাশেম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফারুকী হত্যা মামলায় গ্রেফতার আসামি হাদিসুর রহমান সাগর ও আব্দুল্লাহ আল তাসনীম জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে এর মধ্যে আরও অন্তত ৫ জন তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। এরপরও গত ৮ বছরে এখনো তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি সিআইডি। মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এখন পর্যন্ত ৬১ বার সময় নিয়েছে তদন্তকারী সংস্থাটি। সর্বশেষ গত ১৭ নভেম্বর আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও তা দিতে পারেনি। পরে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ২০ ডিসেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে পরিচিত শায়খ মোযাফফর বিন মুহসিনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। শায়খ মোযাফফর বিন মুহসিনসহ আনসারুল্লাহর তিনজন এ মামলায় গ্রেফতার হন। এছাড়াও নব্য জেএমবির ছয়জন ও হরকাতুল জিহাদের তিন সদস্যসহ ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এরমধ্যে বর্তমানে গ্রেফতার রয়েছেন ৯ জন। বাকি ৭ জন জামিনে রয়েছেন। মামলায় গ্রেফতার হয়ে এখন আটক আছেন- হাদিসুর রহমান সাগর, আবু রায়হান, মো. আব্দুল গাফফার, মিঠু প্রধান, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. জাহিদুল ইসলাম সোহাগ, মো. বাপ্পী মিয়া, আব্দুল্লাহ আল তাসনীম ও রাইসুল ইসলাম। এ মামলার আসামিদের মধ্যে সবশেষ জামিনে ছাড়া পান কাজী মো. ইব্রাহীম ও মোযাফফর হোসেন। এছাড়াও এ মামলায় এখন জামিনে আছেন- খোরশেদ আলম, রিয়াজ ওরফে ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজ, আলেক ব্যাপারী, মো. তরিকুল ইসলাম মিঠু ও মোস্তফা আহামদ রাসেল।

আরও পড়ুন: সংগঠন চিহ্নিত হলেও খুনিরা ‘উধাও’

নূরুল ইসলাম ফারুকীর ছেলে মামলার বাদী ফয়সাল ফারুকী জাগো নিউজকে বলেন, শুরুতে মামলাটি ডাকাতির মামলা হিসেবে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত তদন্তের বিষয়ে কিছু গাফিলতি রয়েছে। শুরু থেকেই যদি তারা গুরুত্ব সহকারে নিতো তাহলে হয়তোবা এত সময় লাগতো না। এত ব্যস্ততম একটি এলাকায় এত বড় একটি ঘটনা হয়ে গেলো, অথচ এত বছরেও হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বের করতে পারছে না! বিষয়টি রহস্যজনক। শুরুতে মামলার তদন্ত হয়েছিল কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব বহুবার পরিবর্তন হয়ে এখন সিআইডিতে আছে। শুরু থেকে তদন্তে অগ্রগতি না হওয়ায় এখন সিআইডির জন্য সেটি বেশি কঠিন হয়ে গেছে বলেই মনে হয়। আমরা চাই যতদ্রুত সম্ভব হত্যায় জড়িতদের সামনে আনা হোক। মামলাটির একটা সমাধান হোক এটাই চাই এখন।

আসামি পক্ষের আইজীবীরা বলছেন, মামলাটির তদন্ত প্রক্রিয়া খুবই ধীর গতিতে এগোচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য একের পর এক তারিখ পরিবর্তন হচ্ছে। এতে আসামিরাও বিচার না পেয়ে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। তাদের আদালতে হাজিরা দিতে হয়। এদের অনেকের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। যার কারণে তারাও মামলার বিচারের জন্য উচ্চ আদালতে যেতে পারছেন না। মামলার তদন্তে পুলিশ যদি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ না পায়, তাহলে তারা মামলা থেকে অব্যাহতি পাবেন এবং ভোগান্তির শিকার হতে হবে না।

গত ৭ বছর ধরে মামলাটির তদন্তের দায়িত্বে রয়েছে সিআইডি। তদন্ত প্রতিবেদন ও ইসলামী ছাত্রসেনার সম্পৃক্ততার বিষয়ে মামলার তদারকি কর্মকর্তা বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আনিসুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। তদন্তাধীন মামলার বিষয়ে কিছু বলা যায় না। তদন্ত শেষ হলে বলতে পারবো কে জড়িত আর কে জড়িত নয়।

মামলার তদন্তের বিষয়ে জানতে তদন্তকারী কর্মকর্তা অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কাশেমের সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোনো সাড়া দেননি।

এদিকে, মামলাটিতে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বে ছিলেন সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জিসানুল হক। আলোচিত এই মামলার সাবেক এ তদন্ত কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকার সময়ে সর্বশেষ তদন্ত পর্যন্ত হত্যার ঘটনায় ইসলামী ছাত্রসেনার কোনো সম্পৃক্ততা পাইনি। তবে জেএমবির সম্পৃক্ততার বিষয়ে আমরা স্বীকারোক্তি পেয়েছি।

 

আরএসএম/কেএসআর/এমএস

কারওয়ান বাজারে একটি হোটেলে বসে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় বলে দাবি ফারুকীর পরিবারের। এ পরিকল্পনার কথা ফারুকীকে ইসলামী ছাত্রসেনার সাধারণ সম্পাদক জানান দাবি করে তারা বলেন, হত্যার পরিকল্পনাকারীরা বিভিন্ন টেলিভিশনের উপস্থাপক এবং ফারুকী ও তুষারের মতাদর্শের বিরোধী বলে তুষার জানিয়েছিলেন।

ফারুকীর পরিবারের প্রশ্ন, কারওয়ান বাজারে যদি ফারুকী বিরোধীদের মিটিং হয় তাহলে ছাত্রসেনার সাধারণ সম্পাদক তুষার সেখানে কীভাবে গেলেন? কেন গেলেন বা তিনি এসব তথ্য কীভাবে জানতে পারলেন? এতে সন্দেহ হয় দলীয় স্বার্থে তারা হয়তো কোনো ঘটনা ঘটাতে পারেন।

ফারুকী হত্যার পরই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ইসলামী ছাত্রসেনা বেশ আলোচনায় আসে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংগঠনটির প্রচারণা, নাম-ডাক বেড়ে যায়। ফারুকী হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে সারা দেশে অর্ধদিবস ধর্মঘটও পালন করে সংগঠনটি।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।