দিন যায় বৈঠক হয়, স্থানান্তর হয় না কারওয়ান বাজার
#সম্প্রতি কারওয়ান বাজার স্থানান্তরে সাত সদস্যর কমিটি অনুমোদন দিয়েছে ডিএনসিসি
#কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীদের আপত্তি, চান ক্ষতিপূরণসহ ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন
#শহরের মধ্যে পাইকারি বাজার থাকতে পারে না: মেয়র আতিক
ঢাকার ফার্মগেট, তেজগাঁও, শাহবাগসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকার যানজট ও জনভোগান্তির অন্যতম কারণ কারওয়ান বাজার। এই বাজার কেন্দ্র করে বিপুল সংখ্যক মানুষ ও যানবাহনের আনাগোনা দেখা যায় প্রতিদিন। ভোগান্তি কমাতে দুই যুগের বেশি সময় ধরে কারওয়ান বাজার স্থানান্তরের চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। যাত্রাবাড়ী, মহাখালী, আমিনবাজারে তিনটি আড়তও নির্মাণ করা হয়েছে। দফায় দফায় বৈঠক করেও ব্যবসায়ীদের স্থানান্তরে রাজি করাতে পারেনি সিটি করপোরেশন। তবে মেয়র বলছেন, স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টদের দাবি, কারওয়ান বাজার থেকে আড়ত ও কাঁচাবাজার স্থানান্তরে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন রয়েছে। এরই মধ্যে তৎপরতা শুরু করেছেন তারা। সম্প্রতি এই বাজার স্থানান্তরে সাত সদস্যের কমিটি অনুমোদন দিয়ে অফিস আদেশ জারি করেছে ডিএনসিসি। যদিও মহাখালী কাঁচাবাজারটি এখন ডিএনসিসি করোনা হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এটি জেনারেল হাসপাতাল করতেও উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসিসি।
আরও পড়ুন>> তেজগাঁওয়ে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান না রাখার অঙ্গীকার
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, কারওয়ান বাজারের আড়তগুলো এক তলা ভবন এবং টিনশেড ঘরের মধ্যে পরিচালনা করা হয়। এখন যাত্রাবাড়ী ও আমিনবাজারে আড়ত এবং কাঁচাবাজারের জন্য যে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে দোকানপাট স্থানান্তর করলে ব্যবসা চলবে না। কারণ, বহুতল ভবনে মালামাল ওঠানো-নামানো কষ্টসাধ্য। পাইকারি ও খুচরা ক্রেতারাও সেখানে যাবেন না। ফলে বেচাবিক্রি কমে যাবে। ব্যবসায়ীদের পথে বসতে হবে।
স্থানান্তরের বিষয়ে ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, একটা শহরের মধ্যে এ ধরনের পাইকারি বাজার থাকতে পারে না। আমরা কারওয়ান বাজারে অত্যাধুনিক বিজনেস হাব সেন্টার করবো। সেই পরিকল্পনাও আমরা করে রেখেছি। এখন কারওয়ান বাজারকে আমিনবাজার, যাত্রাবাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা শেষ পর্যায়ে।
আরও পড়ুন>> ‘ট্রাক ড্রাইভাররা রিকশা চালাতে চায়’
কিন্তু ঠিক কবে কারওয়ান বাজার আড়তমুক্ত হবে তার দিনক্ষণ ঠিক করে বলতে পারেননি ডিএনসিসি মেয়র।
ডিএনসিসির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র জানায়, অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সময় ২০০৬ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ‘ঢাকা শহরের তিনটি পাইকারি কাঁচাবাজার নির্মাণ প্রকল্প’ অনুমোদন দেয়। কৃষিপণ্যের বাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়নের পাশাপাশি কারওয়ান বাজারের যানজট কমাতে প্রকল্পটি নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন>> ফের ট্রাকের দখলে মেয়র আনিসুল হক সড়ক
এ প্রকল্পের মাধ্যমে যাত্রাবাড়ী, আমিনবাজার ও মহাখালী এলাকায় তিনটি বহুতল কাঁচাবাজার (ছয় তলা) নির্মাণ করা হয়েছিল। ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ হওয়ার পর কারওয়ান বাজার ডিএনসিসির অধীনে পড়ে। তখন এই বাজার স্থানান্তরের দায়িত্ব পড়ে উত্তর সিটির ওপর। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক দায়িত্ব গ্রহণের পর কাঁচাবাজার স্থানান্তরে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর আর এ বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি।
পরে গত বছরের ৩ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তি (এপিএ) অনুষ্ঠানে কারওয়ান বাজার স্থানান্তরের নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনে কাঁচপুরেও বাজার বসাতে বলেছেন। প্রয়োজনে কেরানীগঞ্জ ও আমিনবাজারে এই বাজার হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনার পর গত বছরের ২০ জুলাই ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে নিয়ে যাত্রাবাড়ী আর গাবতলীর পাইকারি কাঁচাবাজার পরিদর্শন করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। পরে এ বিষয় নিয়ে মন্ত্রণালয়ে সভাও করেছেন মন্ত্রী।
কারওয়ান বাজারে ডিএনসিসির আলাদা চারটি মার্কেট রয়েছে। মার্কেটগুলো হলো- কিচেন মার্কেট, ১ নম্বর ভবন মার্কেট, ২ নম্বর ভবন মার্কেট ও কাঁচামালের আড়ত মার্কেট। এসব মার্কেটে দেড় হাজারের বেশি দোকান রয়েছে। এর বাইরে রাস্তা ও ফুটপাতে আরও এক হাজারের বেশি হকার পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন। ফলে এই এলাকার রাস্তাঘাটে নিয়মিত লেগে থাকে যানজট। বিশেষ করে পেট্রোবাংলার সামনে থেকে পূর্ব তেজকুনিপাড়া পর্যন্ত সড়কে যানজট বেশি দেখা যায়।
আরও পড়ুন>> ঢাকায় আনিসুল হকের নামে সড়ক
যাত্রাবাড়ী ও আমিনবাজারে নির্মিত বহুতল ভবন দুটি ফাঁকা দেখা যায়। মহাখালীর এক লাখ ৮০ হাজার ৫৬০ বর্গফুট আয়তনের কাঁচাবাজারের ভবনটিতে চলছে করোনা ও ডেঙ্গুরোগীর চিকিৎসা। এটি জেনারেল হাসপাতাল করার জন্য প্রস্তুতি চলছে বলে জাগো নিউজকে জানিয়েছেন ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান।
কারওয়ান বাজার থেকে আড়ত ও কাঁচাবাজার স্থানান্তর করা হলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন জানিয়ে কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেট ইসলামিয়া শান্তি সমিতির সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, উন্নত বিশ্বের মতো আধুনিক কোনো ব্যবস্থা করে আমাদের এখানেই ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হোক। আর আমাদের যদি যেতেই হয়, তাহলে অবশ্যই ক্ষতিপূরণসহ ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন রেজ্যুলেশন আকারে করতে হবে। তাহলে ব্যবসায়ীরা তা মেনে নেবে।
কারওয়ান বাজার স্থানান্তরে ডিএনসিসির কমিটি গঠন
ডিএনসিসির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র জানায়, কারওয়ান বাজার স্থানান্তরে দুই যুগের বেশি সময় ধরে আলোচনা চলছে। গত ৮ ডিসেম্বর ডিএনসিসির দ্বিতীয় পরিষদের ১৮তম করপোরেশন সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক কারওয়ান বাজার স্থানান্তরের জন্য সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে অফিস আদেশ জারি করেন ডিএনসিসির সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক। সাত সদস্যের এই কমিটিতে ডিএনসিসির ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে সভাপতি, অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব এবং ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে সহ-সভাপতি করা হয়েছে।
এছাড়া কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (টিইসি), প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা এবং ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এই কমিটি মূলত কারওয়ান বাজার স্থানান্তর করতে সার্বিক বিষয়গুলো পরিচালনা করবে।
ডিএনসিসির ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শামীম হাসান জাগো নিউজকে বলেন, কারওয়ান বাজারের দোকানগুলোর কিছু সরিয়ে রাজধানীর আমিনবাজারে নেওয়া হবে। বাকি অংশ স্থানান্তর করে নেওয়া হবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন যাত্রাবাড়ীতে। মূলত স্থানান্তর প্রক্রিয়ার কাজ সহজভাবে পরিচালনার জন্যই এ কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। এখন কোন দোকানগুলো কোথায় স্থানান্তর করা হবে বা কে কোথায় যেতে চায়, তার একটি তালিকা করবে কমিটি। সে অনুযায়ীই কারওয়ান বাজার স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হবে।
সম্প্রতি কারওয়ান বাজার স্থানান্তর নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এখন কারওয়ান বাজার থেকে পুরো ঢাকায় খুচরা বাজারগুলোতে পণ্য ডিস্ট্রিবিউশন হয়। এতে কারওয়ান বাজারে যারা পণ্য নিয়ে আসেন তাদের যেমন কষ্ট হয়, তেমনি ঢাকা অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় খুচরা বাজারে পৌঁছাতে যানজট ও সমস্যার সৃষ্টি হয়। ঢাকায় আসা শাক-সবজি, মাছসহ অন্য পণ্য সহজ ও সাশ্রয়ীমূল্যে যেন নগরবাসী পায়, সেজন্য ঢাকার চারপাশে আমরা পাইকারি কাঁচাবাজার চালু করবো।
এমএমএ/এএসএ/এএসএম