কিস্তি পরিশোধের আয় দিয়ে পদ্মা সেতুর মূল্যায়ন করা যাবে না

মফিজুল সাদিক
মফিজুল সাদিক মফিজুল সাদিক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:১৭ পিএম, ২৭ জুন ২০২৩

আগামী ৩৫ বছরে অর্থাৎ ২০৫৭ সাল পর্যন্ত এক শতাংশ সুদসহ ১৪০টি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পদ্মা সেতুর ঋণের টাকা সরকারকে পরিশোধ করবে সেতু বিভাগ। এরই মধ্যে চার কিস্তিতে মোট ৬৩৩ কোটি ১ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক মো. মনজুর হোসেন কিস্তির টাকার চেক অর্থ বিভাগে হস্তান্তর করেন। প্রতি অর্থবছরে চার কিস্তিতে মোট ১৪০টি কিস্তিতে সুদ-আসলে ৩৬ হাজার ৩৯৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা পরিশোধ করা হবে। সেতু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী দিনে পদ্মা সেতুর আয় তথা টোল আদায় আরও বাড়বে। তারা মনে করেন, বছরে চার কিস্তির টাকা পরিশোধ করার তথ্য দিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ অবকাঠামো পদ্মা সেতুর অবদান বিচার করা যাবে না।

দেখতে দেখতে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এক বছর পূর্ণ হলো। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাবে গত এক বছরে আয়ের দিক থেকে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে না পারলেও লোকসান গুনতে হয়নি। এসময়ে সেতু থেকে আয় হয়েছে ৭৭৪ কোটি টাকা। তবে সামাজিক, অর্থনৈতিক বিচারে এ সেতুর অবদান পরিমাপ করা কঠিন। সার্বিক বিচারে পদ্মা সেতুর আয় আরও বেশি বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা-ভাঙ্গায় সেপ্টেম্বরে চলবে ট্রেন

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমরা যা টার্গেট করেছিলাম সে অনুযায়ী পদ্মা সেতুতে আয় হচ্ছে। বছরে চারটি কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে। সামনেও কিস্তি পরিশোধে কোনো সমস্যা হবে না। তবে বছরে চারটি কিস্তি পরিশোধের আয় দিয়ে পদ্মা সেতুর বিচার করা যাবে না। এ সেতু নানাভাবে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। একজন মানুষ সহজেই চার ঘণ্টায় বরিশাল থেকে ঢাকায় আসতে পারছেন, এ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর কল্যাণে মানুষ অল্প সময়ে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারছেন। এটির কোনো মূল্য বিচার করা যাবে না। পদ্মা সেতুর কল্যাণে দেশের অনেক এলাকায় শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে, মানুষের কর্মসংস্থানও বাড়ছে। ঢাকা হয়ে ফরিদপুর-বরিশাল রেল যোগাযোগ সৃষ্টি হচ্ছে একমাত্র পদ্মা সেতুর কল্যাণে।

jagonews24

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মিত। এর পুরোটাই সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ঋণ হিসেবে নিয়েছে। চুক্তির অনুচ্ছেদ ২ মোতাবেক ঋণের অর্থ প্রকল্প সমাপ্তির পর বার্ষিক ১ শতাংশ হারে সুদসহ ৩৫ বছরে ১৪০ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া নকশা প্রণয়নের সময় নেওয়া ২১১ কোটি টাকার বিপরীতে ৩৪০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে।

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতুর ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ জনপদ

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, পদ্মা সেতু পারাপারে মোটরসাইকেলের টোল ১০০ টাকা, বড় বাসের টোল ২ হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি ধরনের বাসের টোল ২ হাজার টাকা, কার ও জিপের ৭৫০ টাকা, চার এক্সেল টেইলারের ৬ হাজার টাকা, মাইক্রোবাস ১ হাজার ৩০০ টাকা এবং মিনিবাসের (৩১ সিট বা তার কম) টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪০০ টাকা।

২০২২ সালের ২৫ জুন এক জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু। দেশি-বিদেশি কূটনীতিক, রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে ওইদিন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের একদিন পর অর্থাৎ ২৬ জুন থেকে সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হয়।

সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, গত এক বছরে পদ্মা সেতু থেকে আয় হয়েছে ৭৭৪ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এসময়ে সেতু দিয়ে ৪৭ লাখের বেশি যানবাহন পারাপার করেছে। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন পদ্মা সেতু থেকে প্রায় ২ কোটি ১৮ লাখ টাকা টোল আদায় হচ্ছে। গড়ে প্রতিদিন সেতু দিয়ে ১৬ হাজার ২২৩টি যানবাহন পারাপার হচ্ছে।

দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ এ সেতু নির্মাণে ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পের মূল ব্যয় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকায়।

কিস্তি পরিশোধের আয় দিয়ে পদ্মা সেতুর মূল্যায়ন করা যাবে না

পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের করা সম্ভাব্যতা জরিপে বলা হয়েছিল, সেতুটি নির্মিত হলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে। সেতু থেকে হওয়া আয় এবং সেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২০টির বেশি জেলায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন হবে। আর সেতুতে যানবাহন থেকে আদায় করা টোলের মাধ্যমে আসা অর্থ দিয়ে সেতুর নির্মাণ ব্যয় এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা হবে।

আরও পড়ুন: দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনা

সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় বলা হয়েছিল, দৈনিক গাড়ি পারাপারের হিসাব অনুযায়ী ২৫ থেকে ২৬ বছরের মধ্যে টোলের আয় থেকে সেতুর নির্মাণ ব্যয় তুলে আনা সম্ভব হবে।

পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, পদ্মা সেতুতে আশানুরূপ টোল আদায় হচ্ছে। আশা করি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেতুর খরচ তুলে আনা সম্ভব হবে।

২০০৭ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্প নেওয়া হয়। শুরুতে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। পরে ২০০৯ সালে প্রথম সংশোধনীতে তা বাড়িয়ে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আরেক দফা বাড়িয়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। সবশেষ বিশেষ সংশোধনী নামে আরেক দফা ব্যয় বাড়ালে তা ৩০ হাজার ১৯৩ কোটিতে উন্নীত হয়।

কিস্তি পরিশোধের আয় দিয়ে পদ্মা সেতুর মূল্যায়ন করা যাবে না

পদ্মা সেতুর প্রাক–সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা হয় বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ১৯৯৮-৯৯ সময়ে। ২০০৩-০৫ সময়ে নিজস্ব অর্থায়নে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষ করে জাপান সরকারের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়। ২০০৯-১১ সময়ে প্রণয়ন করা হয় বিস্তারিত নকশা। নিউজিল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মনসেল এইকম সেতুর পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরি করে। এরপর শুরু হয় জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে অর্থায়ন করে এডিবি ও বাংলাদেশ সরকার।

আরও পড়ুনবিএনপির ১৪ বছরের আন্দোলন এক পদ্মা সেতুতে ম্লান 

২০১২ সালের জুনে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ বাতিল করে। একই বছরের জুলাইয়ে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৪ সালের ১৭ জুন মূল সেতু নির্মাণকাজের জন্য চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়। ওই বছরের ২৬ নভেম্বর শুরু হয় সেতুর মূল নির্মাণকাজ। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন।

কিস্তি পরিশোধের আয় দিয়ে পদ্মা সেতুর মূল্যায়ন করা যাবে না

২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুর প্রথম স্প্যান বসানো হয়। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর বসানো হয় শেষ স্প্যান। সবশেষ ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের দিন ২৬ জুন সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। মূল সেতুর কাজ করেছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এর অ্যাপ্রোচ সড়ক ১২ দশমিক ১১৭ কিলোমিটার। ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ১৪৮ কিলোমিটার (সড়ক) এবং ৫৩২ মিটার (রেল)।

আরও পড়ুন: অর্ধেকে নেমেছে বিমানের যাত্রী, কমেছে ফ্লাইট-ভাড়াও 

এমওএস/এমকেআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।