প্রথম বর্ষপূর্তি

পদ্মা সেতুর ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ জনপদ

এন কে বি নয়ন এন কে বি নয়ন ফরিদপুর
প্রকাশিত: ০৭:১৭ পিএম, ২৫ জুন ২০২৩

স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালুর প্রথম বর্ষপূর্তি। সেতু চালুর এক বছর পর দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ভোগ করছে নানা সুবিধা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বদলে গেছে ফরিদপুরের জনপদের চিত্র। একসময়ের গ্রামীণ সড়কের দুইপাশে একের পর এক কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে। যেন শুরু হয়েছে এক ‘শিল্প বিপ্লব’। গত এক বছরে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের অন্যতম আকর্ষণ স্পট এখন ফরিদপুর।

গ্রামের সঙ্গে শহুরে মানুষের যোগাযোগ বেড়েছে। কারখানা স্থাপনের জন্য এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশ ছাড়াও মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে জমি কেনা হচ্ছে। চলছে অবকাঠামো নির্মাণের প্রস্তুতি।

jagonews24]

২০২২ সালের ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচন করা হয়। সেতু চালুর পর পর্যটন, শিল্পায়ন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষির আধুনিকায়ন, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়াসহ যোগাযোগব্যবস্থার সুফল পাচ্ছে ফরিদপুর তথা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। তবে এ সুফল পেতে আছে নতুন চ্যালেঞ্জও। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দরকার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহসহ দক্ষ জনবল। সরকারি সূত্র অবশ্য বলছে, বিষয়টি তারা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। এছাড়া রেল চালুর পর সবক্ষেত্রে সুফল পাবেন এ অঞ্চলের মানুষ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতু ও ঢাকা-ভাঙ্গা মহাসড়কে এক্সপ্রেসওয়ে চালুর ফলে এ রুটে যাতায়াতের সময় কমেছে। ফরিদপুর অঞ্চলের মানুষ খুব সহজে রাজধানীতে অফিস-আদালত, জরুরি কাজকর্ম করতে পারছেন। মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময়ে রাজধানীতে পৌঁছাতে পারছেন। এর আগে ফরিদপুর থেকে ঢাকা যেতে ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে। তবে পদ্মা সেতুতে যোগাযোগ চালুর পরে সময় বাঁচায় ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দ্বার খুলেছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য দক্ষিণ অঞ্চলের জেলা শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জে দ্রুত পরিবহন সম্ভব হবে, যা ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্য ত্বরান্বিত করবে এবং ক্রেতারা আগের তুলনায় কম সময়ের মধ্যে তাদের পণ্যসামগ্রী হাতে পাবেন।

jagonews24

রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষদের মতে, এ সেতুর কারণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এরইমধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। ফলে দেশ-বিদেশের অনেক শিল্পপতি বেশ কয়েকটি জেলা, বিশেষ করে ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, বরিশাল ও খুলনায় জমি কিনছেন।

ফরিদপুরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা এবং ১৩৩টি উপজেলাকে সরাসরি রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে এই সেতু। ফেরির জন্য অপেক্ষা, ভোগান্তি থেকে মুক্তি মিলেছে। ফেরি দুর্ঘটনা থেকে প্রাণহানি, সময়মতো ফেরি না পাওয়ায় অনেক রোগীর মৃত্যু আর শোনা যায়নি গত এক বছরে।
পদ্মা সেতু চালুর পর গত এক বছরে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী গ্রামের মানুষগুলো যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যখন মন চায় ছুটে আসছেন বাড়িতে। গ্রাম থেকে যারা এক প্রকার বিচ্ছিন্ন ছিলেন, সেই শহুরে মানুষের আসা-যাওয়া বেড়েছে গ্রামের বাড়িতে। বাড়ছে গ্রাম-শহরের মানুষের মেলবন্ধও। পাশাপাশি পরিবার-পরিজন রেখে কংক্রিটের নগরে একঘেয়েমি জীবনযাপন যারা করছেন, তাদের মনে প্রশান্তি জাগিয়েছে পদ্মা সেতু। ভোরে রাজধানী ঢাকা থেকে রওয়ানা দিয়ে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে তৈরি সকালের নাশতা করতে পারছেন অনেকে।

ভাঙ্গা উপজেলার কৃষক নজরুল মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, আমরা প্রচুর সবজি উৎপাদন করি। পদ্মা সেতু হয়েছে এরপর ট্রেন চালু হলে কম খরচে ঢাকা গিয়ে সবজি বিক্রি করতে পারবো। গত এক বছরে আমাদের জীবনযাত্রার মান ব্যাপক পরিবর্তনের পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দেশে প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে ও পদ্মা সেতু উপহার দিয়েছেন। ফলে গত এক বছরে যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হয়েছে।

ভাঙ্গা উপজেলার পুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সোহাগ মাতুব্বর জাগো নিউজকে বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলেও রেলপথ চালুর পর আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পুরোপুরি পরিবর্তন হবে। তবে রাতারাতি কিছু পরিবর্তন হয় না, বিভিন্ন ধরনের কলকারখানা গড়ার জন্য সময়ের প্রয়োজন। পদ্মা সেতুকে ঘিরে ভাঙ্গায় জমির দাম এখন আকাশচুম্বী। অনেক ক্ষেত্রে ঢাকার অভিজাত এলাকার জমির দামকেও ছাড়িয়ে গেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।

jagonews24

ফরিদপুর শহরের মো. আকবর হোসেন রাজু জাগো নিউজকে বলেন, এখন ইচ্ছা হলেই বাড়ি চলে আসি। বৃহস্পতিবার অফিস করে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই গ্রামে আসা হয়। আবার শনিবার বিকেলে অথবা রোববার সকালে গিয়ে অফিস করি। গত এক বছরে অসংখ্যবার গ্রামে যাওয়া হয়েছে, যা একমাত্র সম্ভব হয়েছে স্বপ্নের সেতুর কারণে।

ওষুধ কোম্পানিতে চাকরিরত ফরিদপুর সদর উপজেলার বাসিন্দা রাকিবুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর ঈদে কর্মস্থল রাজধানী থেকে বাড়ি ফেরার সেই ভোগান্তি আর নেই। এক বছর আগে নৌপথের ভোগান্তির কথা মাথায় এলেই ঢাকা ছাড়তে ইচ্ছে করতো না। এখন বৃহস্পতিবার বিকেল হলেই ঢাকায় কর্মরত অসংখ্য মানুষ ছুটে আসে বাড়িতে। শনিবার বিকেলে অথবা রোববার সকালে চলেও আসা হয়। এ কারণে গত এক বছর হলো ফরিদপুর জেলার মানুষের গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বেড়েছে।

আলফাডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিশিষ্ট ঠিকাদার মাহবুবুর রহমান কচি জাগো নিউজকে বলেন, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে শুধু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের দুর্ভোগেরই অবসান হয়নি। এ অঞ্চল তথা দেশে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নেও এটি ভূমিকা রাখছে।

ভাঙ্গা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম হাবিবুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের অহংকারের প্রতীক। ভাঙ্গাসহ ফরিদপুরবাসীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। পদ্মা সেতুর ফলে ভাঙ্গাসহ উন্নয়ন অবহেলিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলায় উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। শিল্পায়ন হচ্ছে। কৃষিজাত পণ্যের বাজার প্রসারিত হয়েছে। ভাঙ্গার কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে ভালো দাম পাচ্ছেন। তাদের ভাগ্যের উন্নতি ঘটেছে।

ফরিদপুর নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রবীর কান্তি বালা পান্না জাগো নিউজকে বলেন, দক্ষিণাঞ্চল তথা ফরিদপুরের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেকটাই গত এক বছরে পূর্ণ হয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থা, কৃষি, শিল্প সবদিক দিয়েই মানুষ সুফল ভোগ করছেন। এ অঞ্চলে কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। আরও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে মানুষ পরিপূর্ণ সুফল ভোগ করবে।

jagonews24

বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোশারেফ হোসাইন বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর এ অঞ্চলের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। এ অঞ্চল ঘিরে একটি ইকোনমিক জোন গড়ে উঠছে। প্রধানমন্ত্রী ভাঙ্গায় পদ্মা সেতু জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া ভাঙ্গায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক মানমন্দির ও তাঁতপল্লিসহ নানাবিধ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। গত এক বছরে মানুষ নানাবিধ সুফল ভোগ করেছেন।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও দি মীর গ্রুপের চেয়ারম্যান মীর নাসির হোসেন বলেন, পদ্মা সেতু দেশের মর্যাদার প্রতীক। গত এক বছরে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনের পাশাপাশি এটি প্রায় ক্ষেত্রেই সুফল এনেছে।

ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এ কে এইচ গ্রুপের পরিচালক শামীম হক জাগো নিউজকে বলেন, পদ্মা সেতু ফরিদপুরসহ দক্ষিণবঙ্গের বিশাল পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ সেতু ব্যবসায়ী, কৃষক থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষের জন্য উন্নয়নের দ্বার খুলে দিয়েছে। যানবাহন চলাচল ও অর্থনীতিতে সুফল আনছে গত এক বছরে। এক কথায় দক্ষিণাঞ্চল তথা ফরিদপুরের মানুষ অর্থনৈতিক, সামাজিক, কৃষি, যোগাযোগব্যবস্থা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবদিক দিয়ে পদ্মা সেতুর সুফল ভোগ করছেন।

এ বিষয়ে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন,
স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য একটি অসাধারণ অর্জন। গত এক বছরে সেতুটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল তথা ফরিদপুরের পাশাপাশি পুরো দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও শিল্পায়নে বিরাট ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। যোগাযোগ, বাণিজ্য, শিল্প, কৃষি ও পর্যটনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আব্দুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু ঘিরে এ অঞ্চলে গড়ে উঠছে বড় শিল্পকারখানা। যোগাযোগের মাধ্যম ছাড়াও শিল্প, সংস্কৃতি, কৃষি, পর্যটন শিল্পসহ নানা ব্যবসা-বাণিজ্যর প্রসার ঘটিয়ে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে এই স্বপ্নের সেতু। অবহেলিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের জীবনযাত্রায় লেগেছে সমৃদ্ধির ছোঁয়া। কৃষিপণ্য বোঝাই গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সকে ফেরির সিরিয়ালের জন্য আর দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয় না। এক কথায় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের বড় স্বপ্ন পূরণ করেছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

এমআরআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।