অ্যাপসে হুন্ডির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা পাচার

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:০৯ পিএম, ২৮ মার্চ ২০২৪

‘জেট রোবোটিক’ একটি অ্যাপস। এ অ্যাপের অ্যাডমিন কুমিল্লার শহিদুল ইসলাম ওরফে মামুন। তিনি ২০২০ সাল থেকে দুবাইতে আছেন। মধ্যপ্রাচ্যে বসে নিজস্ব এজেন্টের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স পাঠানোর দায়িত্ব নিতেন তিনি। গত তিন থেকে সাড়ে ৩ মাসে তিনি ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছেন জেট রোবোটিক অ্যাপের মাধ্যমে।

তবে তিনি ঠিকই চাহিদা অনুযায়ী গন্তব্যে টাকা পাঠিয়েছেন। এজন্য ব্যবহার করা হয়েছে চট্টগ্রামের মোবাইল ব্যাংকিং ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটসকে। প্রতিষ্ঠানটির ৪৮টি মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট সিমে আগে থেকেই সমপরিমাণ বা বেশি অনলাইনে টাকা সংগ্রহ করে রাখা হয়। এরপর সংগ্রহ করা টাকা এজেন্ট সিম থেকে অ্যাপের ব্যবহার করে প্রবাসীদের আত্মীয়দের নম্বরে অর্থ পাঠিয়ে দিয়ে আসছিল সংঘবদ্ধ একটি চক্রটি।

জেট রোবোটিক অ্যাপসের ব্যবহারকারী ও মূলহোতা মামুনের দুই সহযোগীসহ পাঁচজনকে গ্রেফতারের পর এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

সার্বক্ষণিক অনলাইন মনিটরিংয়ের সময় মাসখানেক আগে এ অ্যাপস ও মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট সিমে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য জানতে পারে সিআইডি। এরপর বুধবার (২৭ মার্চ) দিনগত রাতে চট্টগ্রামে অভিযান পরিচালনা করে এ ডিজিটাল হুন্ডি কার্যক্রমে সরাসরি জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার।

গ্রেফতাররা হলেন- তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটসের মালিক নাসিম আহমেদ (৬২), এজেন্ট সিমের টেরিটোরি সেলস ম্যানেজার ফজলে রাব্বি সুমন (৩২) ও মো. কামরুজ্জামান (৩৩) এবং জেট রোবোটিক অ্যাপসের বাংলাদেশের প্রতিনিধি জহির উদ্দিন (৩৭) এবং খায়রুল ইসলাম ওরফে পিয়াস (৩৪)।

এসময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৬টি মোবাইল, ১৮টি সিমকার্ড, একটি ল্যাপটপ, ৬টি মডেম ও ২৮ লাখ ৫১ হাজার ২০০ টাকা।

হুন্ডির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা পাচার

সিআইডি বলছে, এ ধরনের ডিজিটাল হুন্ডি কার্যক্রমের কারণে বাংলাদেশ রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ কার্যক্রম থেকে মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি কোনোভাবে দায় এড়াতে পারে না। কারণ যেসব সিম ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট সিম। তাছাড়া অস্বাভাবিক লেনদেন হলে সেটা দেখার দায় মোবাইল ব্যাংকিংয়েরই।

বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) বিকেলে মালিবাগে নিজ কার্যালয়ে সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী বলেন, গত তিন মাসে ৪০০ কোটি টাকা বাংলাদেশে আসতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে জেট রোবোটিক অ্যাপসের মাধ্যমে। অভিনব কৌশলে এ অ্যাপস ব্যবহারকারী পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছি। ডিভাইসগুলো জব্দ করেছি।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামের মোবাইল ব্যাংকিং ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটস। প্রতিষ্ঠানটির কাছে রয়েছে এক হাজার ১০০ মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট সিম। এসব এজেন্ট সিমের তাদের পারফর্ম ভালো না সেসব এজেন্টের সিমগুলো ডিএসওরা নিয়ে জেট রোবোটিক অ্যাপস ব্যবহারকারীদের সরবরাহ করে।

এজেন্ট সিম নেওয়ার পর মোবাইল ব্যাংকিং থেকে ই-মানি এজেন্ট সিমে আনা হয়। এ এজেন্ট সিমের কয়েকটি ভাড়া নেয় এ রোবোটিক অ্যাপস। হুন্ডি চক্রটির মূলহোতা শহিদুল ইসলাম ওরফে মামুন। দুবাই বসে মামুন যখন অ্যাপসের মাধ্যমে এজেন্ট সিমের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যায়। সে তখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রুট পর্যায়ে চাহিদা অনুযায়ী পাঠাতে পারে। তখন আর বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের প্রয়োজন হয় না। কারণ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট সিমগুলো গ্রহণ করে শুধু ই-মানি ট্রান্সজেকশনের জন্য।

সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী বলেন, শুধু এ জেট রোবোটিক অ্যাপসই নয়, এরকম বেশকিছু অ্যাপস বাংলাদেশে চলমান। আমরা বেশকিছু এমন অ্যাপসের সন্ধান পেয়েছি। এরই মধ্যে আমাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম চলমান। চট্টগ্রাম ও কুমিল্লাতে এ কার্যকম চলছে।

চক্রটির মূলহোতা শহিদুল ইসলাম ওরফে মামুনের কথা উল্লেখ করে সিআইডি প্রধান বলেন, গত ২০২০ সাল হতে মামুন দুবাই থাকেন। সেখানে মামুনসহ আরও পাঁচজন জেট রোবোটিক অ্যাপস নিয়ন্ত্রণ করে। মালয়েশিয়ান সফটওয়্যার ডেভেলপারের মাধ্যমে তৈরি করা এ অ্যাপস কাস্টমাইজ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে এ চক্রটি। তখন এজেন্ট সিমগুলো বাংলাদেশে থাকলেও এর নিয়ন্ত্রণ তারা দুবাই বসে করতে পারে। দুবাই বসেই তারা দেশের বিভিন্ন নম্বরে ক্যাশ-ইনের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে পারে।

হুন্ডির কাজে তারা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ বৈদেশিক মুদ্রা তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে সংগ্রহ করে। এ সংগ্রহ করা অর্থ কোনো নম্বরে বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠাতে হবে তা জেনে নেয় চক্রটি। তখন বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করা এজেন্ট সিম থেকে অ্যাপস ব্যবহার করে প্রবাসীদের আত্মীয়দের নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেয়। চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও অবস্থিত মোবাইল ব্যাংকিং ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটের ১৫০টি এজেন্ট সিম এ কাজে ব্যবহার করেছে। এরমধ্যে সিআইডির অনুসন্ধানে সরাসরি ৪৮টি সিমে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কোটি টাকা হুন্ডি করেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

চট্টগ্রামের মোবাইল ব্যাংকিং ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটস যে ভাড়ায় এজেন্ট সিম ব্যবহারে মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি দায় এড়াতে পারে কি-না? জানতে চাইলে সিআইডি প্রধান বলেন, অবশ্যই মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি দায় এড়াতে পারে না। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট সিম, শুধু এজেন্টরাই পাবে, যারা ভেরিফাইড শুধু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নয়, মোবাইল ব্যাংকিং ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটসেরও ভেরিফাইড। যদি তারা এজেন্টদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে তার দায়-দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তায়। আমরা তাসমিয়ার মালিককেও তুলে এনেছি। গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে যে তথ্য পেলাম এক কথায় তা ভয়াবহ।

মোহাম্মদ আলী মিয়া আরও বলেন, যেসব এজেন্ট তাদের লিমিট টার্গেট পূরণ করতে পারে না, তাদের বাদ দেওয়া হয়। ছাঁটাই করা এজেন্ট সিম এই জেট রোবোটিক অ্যাপসে ভাড়া দেওয়া হয়। একটা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত। ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ তাসমিয়ার এসও (সেলস অফিসার) ও ডিএসও (ডিস্ট্রিবিউশন সেলস অফিসার) তারা পারসেন্টেজ পেতো। এ কারণে এটা খুব গোপনভাবেই চলছিল। এ কার্যক্রম যাতে বন্ধ হয় সেজন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) জানিয়েছি।

নতুন নতুন অ্যাপসের মাধ্যমে কৌশলে এ ধরনের ডিজিটাল হুন্ডি কার্যক্রম চলতে পারে উল্লেখ করে সিআইডি প্রধান বলেন, এ ধরনের কার্যক্রমরোধে সিআইডিসহ সব দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠানকে ইন্টেলিজেন্স, মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে।

তিন মাস ধরে অস্বাভাবিক লেনদেন, রেমিট্যান্স ব্লক হলো অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক টের পেল না? তাদের তো একটা শক্তিশালী মনিটরিং সেল আছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতা কি-না জানতে চাইলে সিআইডিপ্রধান বলেন, ব্যর্থতা বলবো না, সার্ভিলেন্স সিস্টেমকে কতটা পেট্রলিং করছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের পেট্রলিংয়ে এটা ধরতে পেরেছি। এর দায়িত্ব শুধু সিআইডি’র নয়, ডিবি, র‌্যাব, বাংলাদেশ ব্যাংকেরও।

হুন্ডিতো আগেও হতো, এটাকে ডিজিটাল হুন্ডি বলছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ সিস্টেম আসলেই ডিজিটাল হুন্ডি। আগে ফোন করে বলে দিতো অমুকের টাকা অমুককে দিয়ে দাও। এটা ম্যানুয়াল সিস্টেমে। কিন্তু এখন এসবের দরকার নেই। ফোন বা লোকাল এজেন্ট অথবা ডিস্টিবিশন হাউজ দরকার পড়ে না। অ্যাপস যেভাবে ইনস্ট্রাকশন দেবে সেভাবে নম্বরে নম্বরে টাকা চলে যায়।

তাহলে বাংলাদেশে কীভাবে পেমেন্টটা হচ্ছে জানতে চাইলে সিআইডি প্রধান বলেন, জেট রোবোটিক অ্যাপসে বেশকিছু এজেন্ট বাংলাদেশে আছে। তারা টাকা সংগ্রহ করে। তারপর তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটসকে দেয়। তাসমিয়া মোবাইল ব্যাংকিং থেকে ই-মানি সংগ্রহ করে। সেটি অ্যাপস ব্যবহার করে।

মোবাইল ব্যাংকিং যাদের এজেন্টশিপ দিচ্ছে, তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে কি-না বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মনিটরিং ব্যর্থতা আছে কি-না জানতে চাইলে অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, বেআইনি কার্যক্রম হলে এটা দেখার দায়িত্ব মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিটির। টেরিটরি ফিল্ড অফিসার সবাই মামলার আসামি হবে। কারণ ৪০০ কোটি টাকা সমমূল্যের রেমিট্যান্স ব্লক করে লোকাল টাকায় লেনদেন যে এজেন্ট সিমে করা হয়েছে সেটি মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিটির। সংখ্যাটি একেবারে কম নয় ৪৮টি সিম ব্যবহার করা হয়েছে এ অবৈধ কাজে।

টিটি/এমএএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।