শাহজালাল বিমানবন্দরে লাগেজ পেতে ঘণ্টা পার, কমছে না ভোগান্তি

মুসা আহমেদ
মুসা আহমেদ মুসা আহমেদ
প্রকাশিত: ০৮:১৪ এএম, ০৪ এপ্রিল ২০২৪
শাহজালাল বিমানবন্দরের লাগেজ বেল্ট/সংগৃহীত

• শাহজালালে এককভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স
• একসঙ্গে চার-পাঁচটি ফ্লাইট অবতরণ করলে হিমশিম খান বিমানের কর্মীরা
• চলতি বছরের শেষ দিকে তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে ভোগান্তি থাকবে না: বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের লাগেজ নিয়ে বিড়ম্বনা পুরোনো। দিনের পর দিন বিষয়টি নিয়ে যাত্রীরা অভিযোগ করে আসছেন। ফ্লাইট অবতরণের পর লাগেজ পেতে যাত্রীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময় লেগে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে ক্ষুণ্ন হচ্ছে দেশের সুনাম। তবু খুব হেলদোল কখনো দেখা যায়নি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের।

যাত্রীদের অভিযোগ, শাহজালাল বিমানবন্দরে লাগেজ অব্যবস্থাপনা দূর করতে তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না বিমান। প্রায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের যাত্রীদের বিমানবন্দরে নেমে লাগেজ পেতে ঘণ্টা পার হয়। কিছু ক্ষেত্রে লাগেজ পেতে দুই থেকে তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। অথচ দেশের প্রধান বিমানবন্দরে এ ধরনের ভোগান্তি লাঘবে কোনো উদ্যোগ নেই।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, অনেক সময় একসঙ্গে চার-পাঁচটি বড় ফ্লাইট অবতরণ করে। প্রতিটি ফ্লাইটে চার থেকে পাঁচশ করে যাত্রী থাকে। তখন লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ে কিছুটা অসুবিধা হয়। শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে এ সমস্যা আর থাকবে না।

আমি যখন লাগেজের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখন বেল্টের চারপাশে আরও শত শত যাত্রী অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সবাই বিমানের সংশ্লিষ্টদের কাছে লাগেজের তথ্য চাচ্ছিলেন, কিন্তু তারা লাগেজ দেবেন বলে ঘণ্টা পার করেন।-ভুক্তভোগী যাত্রী

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের সব বিমানবন্দরে এককভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের (লাগেজ সরবরাহসহ গ্রাহকসেবা) কাজ করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। শাহজালালে দিনে গড়ে ৩০টি এয়ারলাইন্সের প্রায় ১৭০টি ফ্লাইট ওঠানামা করে। এসব ফ্লাইটে দিনে প্রায় ২২ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন।

২‌‌১ মার্চ বিকেলে তার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে জার্মানি থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন ঢাকার ধানমন্ডির বাসিন্দা শামসুল আলম। ইমিগ্রেশন শেষ করে দ্রুত যান লাগেজ আনতে। বেল্টে গিয়ে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর তিনি লাগেজ পান।

শাহজালাল বিমানবন্দরে লাগেজ পেতে ঘণ্টা পার, কমছে না ভোগান্তি

টার্মিনাল-২ এর নিচতলা দিয়ে বের হওয়ার সময় শামসুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘জার্মানি থেকে তুরস্ক ট্রানজিট দিয়ে ঢাকা ফিরতে গড়ে ১৪ ঘণ্টা সময় লেগেছে। দীর্ঘ এই ভ্রমণে অনেক ক্লান্ত লাগছে। দেশের বিমানবন্দরে লাগেজের জন্য এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। অথচ ঢাকা থেকে যখন জার্মানি গেলাম, ইমিগ্রেশন শেষ করার আগেই দেখি বেল্টে লাগেজ চলে আসছে।’

একই সময় এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে দুবাই থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এই ফ্লাইটে দুবাই থেকে ঢাকা আসেন চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণের কামাল মজুমদার। আলাপকালে তিনিও লাগেজ পেতে এক ঘণ্টা ১০ মিনিট অপেক্ষার কথা জানান।

আরও পড়ুন

কামাল মজুমদার বলেন, ‘আমি যখন লাগেজের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখন বেল্টের চারপাশে আরও শত শত যাত্রী অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সবাই বিমানের সংশ্লিষ্টদের কাছে লাগেজের তথ্য চাচ্ছিলেন, কিন্তু তারা লাগেজ দেবেন বলে ঘণ্টা পার করেছেন।’

শাহজালাল বিমানবন্দরে লাগেজ পেতে ঘণ্টা পার, কমছে না ভোগান্তি

সোমবার (১ মার্চ) বিকেল সাড়ে ৩টা। সরেজমিনে দেখা যায়, শাহজালাল বিমানবন্দরের আলাদা চারটি বেল্ট রয়েছে। এসব বেল্ট থেকে নিজ নিজ লাগেজ সংগ্রহ করছেন যাত্রীরা। তবে এই সময় ফ্লাইট অবতরণের চাপ কম থাকায় লাগেজ পেতে কারও তেমন দেরি হয়নি।

শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আমরা টার্মিনালের দায়িত্ব বুঝে নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিমানবন্দরে যেসব সংস্থা যাত্রীসেবা দেয় তাদের লোকবল বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। শাহজালাল বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নিয়োগ প্রক্রিয়াও চলমান। এছাড়া তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনায় জাপানি সংস্থা যুক্ত, যারা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কাজ করবে। আশা করি চলতি বছরের শেষ দিকে এ কাজ শেষ করতে পারবো।- বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম

টার্মিনাল-২ এর সামনে বড় দুটি এবং ছোট একটি লাগেজ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন মালয়েশিয়া থেকে আসা প্রবাসী গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘দুপুরে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকা আসি। সঙ্গে আরও প্রায় তিনশ যাত্রী ছিল। সবার লাগেজ একই বেল্টে দেওয়া হয়েছিল। ফলে ছোট একটা বেল্টের চারপাশে যাত্রীদের দাঁড়ানোরই জায়গা ছিল না। পরে এক ঘণ্টা পর লাগেজ হাতে পেয়েছি।’

গত ১ মার্চ দুপুর আড়াইটায় শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট। এই ফ্লাইটের যাত্রী ছিলেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাসিন্দা ওমর ফারুক। তাকে রিসিভ করার জন্য গ্রাম থেকে বিমানবন্দরে যান তার মা আলেয়া বেগম ও বাবা জয়নাল মিয়া। আলাপকালে তারা জানান, তার ছেলে বিমানবন্দরে নামার পরপরই তাদের কল দিয়েছে। কিন্তু ৪০ মিনিট হয়ে গেলেও ছেলে এখনো বের হয়নি। কারণ লাগেজ পেতে দেরি হচ্ছে। একটা বিমানবন্দরে বছরের পর বছর এমন অব্যবস্থাপনা চলতে পারে না।

২০২২ সালের ১৬ জুন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মাসিক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে লাগেজ ডেলিভারির অনিয়ম নিয়ে আলোচনা হয়। তখন সাবেক বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী হ্যান্ডলিং কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনে জনবল ও ইক্যুইপমেন্ট বাড়াতে নির্দেশনা দেন। লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে সবশেষ সময়সীমা ৬০ মিনিটের নিচে রাখার নির্দেশনাও দেওয়া হয়।

শাহজালাল বিমানবন্দরে লাগেজ পেতে ঘণ্টা পার, কমছে না ভোগান্তি

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে চার্জ দেয়। এটি বিমানের আয়ের অন্যতম বড় খাত। কিন্তু এ খাতে পর্যাপ্ত জনবল ও সরঞ্জাম নেই। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য তদারকি টিম নেই। ফলে বিমানবন্দরে যখন একসঙ্গে একাধিক ফ্লাইট আসে, তখন দায়িত্বে থাকা কর্মীদের হিমশিম খেতে হয়। এতে যাত্রী ও বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ক্ষুব্ধ হয়। কারণ, লাগেজ বিড়ম্বনায় এয়ারলাইন্সগুলোকে ইমেজ সংকটে পড়তে হচ্ছে।

তবে ভিন্ন কথা বলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক (গ্রাহকসেবা) মতিউল ইসলাম চৌধুরী। তিনি জানান, তারা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বা লাগেজ ব্যবস্থাপনা ভালোভাবেই পরিচালনা করছেন। এর বেশি তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

শাহজালালে তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে যাত্রীসেবার মান অনেক বাড়বে বলে জানান বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম। গত ২১ মার্চ তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আমরা টার্মিনালের দায়িত্ব বুঝে নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিমানবন্দরে যেসব সংস্থা যাত্রীসেবা দেয় তাদের লোকবল বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। শাহজালাল বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নিয়োগ প্রক্রিয়াও চলমান। এছাড়া তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনায় জাপানি সংস্থা যুক্ত, যারা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কাজ করবে। আশা করি চলতি বছরের শেষ দিকে এ কাজগুলো শেষ করতে পারবো।’

এমএমএ/এএসএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।