জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

ঘরবাড়ি হারিয়ে বিপন্ন হচ্ছে শিশুদের জীবন

রায়হান আহমেদ
রায়হান আহমেদ রায়হান আহমেদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০১:৩৫ পিএম, ২৮ নভেম্বর ২০২৪

• জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বস্তিতে বসবাসরত জনসংখ্যা ১৮ লাখ ৪৮৬ জন
• বস্তিতে বসবাসকারী জনসংখ্যার প্রায় ১৩.৫ শতাংশ মানুষ বরিশালের, ময়মনসিংহের ৯.৩৪ শতাংশ
• কিশোরগঞ্জের ৭.৮২, কুমিল্লার ৬.৫২ ও নেত্রকোনা জেলার ৫.২৬ শতাংশ বস্তিতে বাস করে
• দারিদ্র্য ও নদীভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই মূলত পাঁচ জেলার মানুষ বেশি হারে বস্তিতে বসবাস করছে

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায় পাঁচ কাঠা জমি ছিল সোহান (৯) ও সিয়ামদের (৬)। বাবা হেলাল মিয়া যা আয় করতেন তা দিয়ে ভালোভাবেই চলে যেত সংসার। সোহান পড়ত স্থানীয় স্কুলে। সুখে-শান্তিতেই ছিলে তারা।

কিন্তু মেঘনা নদীর ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে সোহান ও সিয়াম চলে আসে ঢাকায়। আশ্রয় নেয় বনানীর বেদে বস্তিতে। বাবা কাজ করেন সবজির দোকানে। মা সালমা বেগম গৃহকর্মীর কাজ করেন। সোহান ও সিয়াম এখন পড়াশোনা করে বস্তিতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পরিচালিত স্কুলে।
সোহান জাগো নিউজকে বলে, ‘এই স্কুলে পড়তে আর ভালো লাগে না। বার বার একই পড়া। মন চায় বস্তির বাইরে কোনো স্কুলে পড়ি।’

বস্তির স্কুলে সোহান ও তার ছোট ভাই সিয়াম/জাগো নিউজবস্তির স্কুলে সোহান ও তার ছোট ভাই সিয়াম/জাগো নিউজ

সোহানের পাশেই ছিলেন তার মা সালমা বেগম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওদের ভালো কিছু খাওয়াতে পারি না। একটা ডিম চারজনে ভাগ করে খাই। এখানে একটা এনজিওর পাঠশালায় পড়ে। তারা বই, খাতা, কলম দেয়। জানি না, ওরা বড় হলে কোনো স্কুলে পড়াতে পারব কি না। স্কুলে ভর্তি হলে বেতন ও পড়াশোনার অন্য খরচ কীভাবে জোগাব? সেজন্য অন্য কোনো স্কুলে পড়াতে পারছি না।’

ঢাকায় কেন এলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সালমা বেগম বলেন, ‘বড় ছেলে সোহান ঢাকায় আসতে চায়নি। প্রতিবেশীরা নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কয়েক জায়গায় আবার ঘর করলেও চরফ্যাশনের কোথাও গিয়ে স্থায়ী হতে পারেনি। ভেবেছিলাম ঢাকায় এসে ভালো কাজ পাব। এখানে বস্তিতে এসে একটু স্থির হলেও প্রতি বছরই আগুন লাগে।’

সোহান ও সিয়ামের মতো অসংখ্য শিশু প্রতি বছর নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পারিবারিক কলহের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে ঢাকার বস্তিগুলোতে আশ্রয় নেয়। অভাব-অনটন মেটাতে ও মাথা গোঁজার ঠাই খুঁজতে গিয়ে শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন করতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবারগুলো।

বাস্তুচ্যুত হয়ে বস্তিবাসীর সংখ্যা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ প্রাথমিক প্রতিবেদন মোতাবেক দেশে বস্তিতে বসবাসরত জনসংখ্যা ১৮ লাখ ৪৮৬ জন, খানার সংখ্যা পাঁচ লাখ সাত হাজার ৪৮৬টি। এর আগে বিবিএসের ‘বস্তিতে শুমারি ও ভাসমান লোকগণনা ২০১৪’ এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বস্তির সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৯৩৮টি ও ১৯৯৭ সালে ছিল দুই হাজার ৯৯১টি। ২০১৪ সালে বস্তিতে সাড়ে ২২ লাখ মানুষ বসবাস করতো। এর মধ্যে পুরুষ সাড়ে ১১ লাখ ও নারী ১১ লাখ। ১৯৯৭ সালে দেশে বস্তিবাসীর সংখ্যা ছিল সাত লাখ।
‘বস্তিতে শুমারি ও ভাসমান লোকগণনা ২০১৪’-এর বরাত দিয়ে ২০১৯ সালের ১৬ জুন তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে জানান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মোট বস্তির সংখ্যা ১ হাজার ৬৩৯টি। মোট খানা এক লাখ ৩৫ হাজার ৩৪০টি। উত্তর সিটির বস্তিতে মোট জনসংখ্যা ৪ লাখ ৯৯ হাজার ১৯ জন। অপরদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মোট বস্তি ১ হাজার ৭৫৫টি। বস্তির খানার সংখ্যা ৪০ হাজার ৫৯১টি। জনসংখ্যা ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৬ জন।
দেশের শহরাঞ্চলের বস্তিগুলোতে মোট বসবাসকারী জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ মানুষ বরিশালের। ময়মনসিংহের মানুষ ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ, কিশোরগঞ্জের ৭ দশমিক ৮২, কুমিল্লার ৬ দশমিক ৫২ ও নেত্রকোনা জেলার জনসংখ্যা ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ।

চলতি বছরের ২৪ মার্চ বিবিএসের ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স ২০২৩’ -এর ফলাফলে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। দারিদ্র্য ও নদীভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই মূলত দেশের পাঁচ জেলার মানুষ বেশি হারে শহরের বস্তিতে বসবাস করছে বলে বিবিএসের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

২০২৪ সালের ১৪ মে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের ওয়েবসাইটে ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে ১ কোটি ৪৭ লাখ বার মানুষ বাসস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ১৭ লাখ ৯১ হাজার বার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ২০২২ সালে ১৫ লাখ ২৪ হাজার, ২০২১ সালে ৯৯ হাজার ও ২০২০ সালে ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার বার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রজেক্ট সার্ভিসের অর্থায়নে পরিচালিত ‘সিটিস অ্যালায়েন্স’র ২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু উপকূলীয় অঞ্চলে নদীভাঙন, লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ বসতি হারিয়ে শহরমুখী হয়। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ঢাকার বস্তিগুলোতে গিয়ে বসতি স্থাপন করে, যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ পরিবেশগত সমস্যার কারণে সেখানে এসেছে বলে ধারণা করছে সংস্থাটি।

২০২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ৩০ বছরে কৃষিতে জলবায়ুর প্রভাব, পানির সংকট এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণ অভিবাসী হতে পারে, যার মধ্যে নারীরা বেশি প্রভাবিত হবে।

‘নোয়াখালীতে শুধু একটা ঘরের জায়গা ছিল, সেটা নদী নিয়ে গেছে। এই দুই বাচ্চাকে নিয়ে আমার মেয়ের অনেক স্বপ্ন। কিন্তু তাদের পড়াশোনা করার সুযোগ নেই।’-মীনা বেগম।

ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস

সরেজমিনে কড়াইল ও গোডাউন বস্তি ঘুরে দেখা গেছে, সরু সরু গলি। ঘিঞ্জি পরিবেশে খুপড়ি ঘরগুলো ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে। দিনের বেলায়ও ঘরে ঢুকছে না সূর্যের আলো। কোথাও কোথাও মেঝেতে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ। এর মধ্যে বসবাস করছে বস্তির লাখ লাখ বাসিন্দা। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সব বয়সী মানুষের আশ্রয়ের ঠিকানা এ ঘরগুলো। টিনশেড বাড়ি কিংবা ছাদ বিল্ডিং। ঘরপ্রতি ভাড়া তিন থেকে ছয় হাজার টাকা। কিছু কিছু ঘরে একই পরিবারের পাঁচ থেকে আটজন বসবাস করছেন। অধিকাংশ জায়গায় নেই নিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা। ঘিঞ্জি পরিবেশের ঘরগুলোতে নেই শিশুদের পড়াশোনার পরিবেশও।

একই পরিবেশ রাজধানীর হাজারীবাগ বস্তি, কমলাপুর রেললাইন বস্তি, মোহাম্মদপুর বরকতের বস্তি, বেড়িবাঁধ মাস্টারের বস্তি, আগারগাঁও করিমের বস্তি, কুমিল্লা বস্তি ও বিএনপি বস্তিতে। এসব বস্তিতে শিশুদের শিক্ষার প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই।

কড়াইল বস্তির বেশ কয়েকজন বাসিন্দা জাগো নিউজকে বলেন, এমন পরিবেশ থেকে শিশুরা প্রায় অসুস্থ হয়ে যায়। তারা ঢাকায় এসে মানিয়ে নিতে পারলেও শিশুরা পারে না। শিশুদের পড়ালেখা নিয়ে তারা বেশি চিন্তিত। আশেপাশে সরকারি স্কুল নেই। তারা কাজে থাকলে শিশুরা বেশির ভাগ সময় ঘরে একাই থাকে। ওদের ন্যূনতম খাওয়ায় কষ্ট হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে দুধ-ডিম, মাংস খেতে চায়। তাদের ভাত দিতেই তো কষ্ট হয়, দুধ-ডিম জোগাড় করবেন কীভাবে? বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে পুষ্টিকর খাবার আসে। অনেকে তাদের নাম নেয়, কিন্তু পরে আর খাবার দেয় না। শিশুরা একটু বড় হলে টাকা চায়। নাহলে ওরা রাস্তায় গিয়ে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়। অসাধু ব্যক্তিরা তাদের অপকর্ম ও মাদকে যুক্ত করে।

মহাখালীর গোডাউন বস্তিতে নানি মীনা বেগমের সঙ্গে শিশু রাইসা ও রোজামনি/জাগো নিউজমহাখালীর গোডাউন বস্তিতে নানি মীনা বেগমের সঙ্গে শিশু রাইসা ও রোজামনি/জাগো নিউজ

গোডাউন বস্তি ঘুরে দেখা গেছে, ছয় বছর বয়সী শিশু রাইসা ও তার বোন আড়াই বছরের শিশু রোজামনিকে। তাদের দেখাশোনা করছেন নানি মীনা বেগম। মা লাকি বেগম গেছেন অন্যের বাসায় কাজ করতে।

মীনা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মেয়ে সারাদিন বাসায় কাজ করে। ওর স্বামী ঠিকমতো কাজ করে না। ঘরবাড়ি নদীতে ভাঙায় নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে ঢাকায় চলে আসছি আরও পাঁচ বছর আগে।’

‘নোয়াখালীতে শুধু একটা ঘরের জায়গা ছিল, সেটা নদী নিয়ে গেছে। এই দুই বাচ্চাকে নিয়ে আমার মেয়ের অনেক স্বপ্ন। কিন্তু তাদের পড়াশোনা করার সুযোগ নেই।’ বলছিলেন মীনা বেগম।

‘অনেকে বাচ্চাদের রাখতে চায় না। তারা বলে, বাচ্চা যদি হঠাৎ কোনো দিকে চলে যায়, এই দায় কে নেবে। সরকার যদি এখানে ডে কেয়ারের ব্যবস্থা করতো, আমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম।’-শাহিনুর

একই বস্তিতে শাহিনুরের ঘরে গিয়ে দেখা যায় তিন শিশুকে। ছোট ছোট সন্তানদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

শাহিনুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভোলা থেকে এসেছি ২০১৮ সালে। পরিচিত পাড়া-পড়শি অনেকে আসছেন ভোলা থেকে। নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড় আর সহ্য হচ্ছিল না। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু-মোরার আঘাতে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। ঢাকায় এসে আজ এখানে তো কাল সেখানে। আত্মীয়দের কাছে শুনেছি, কড়াইলে ভোলাপট্টি আছে। পরে এখানে এসে রুম ভাড়া করছি। চার মাসের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে কাজ করছি। কারও কাছে দিয়ে গেলে তো খরচ দেওয়া লাগবো। আবার কাজ না করলে চলব কীভাবে? অনেকে বাচ্চাদের রাখতে চায় না। তারা বলে, বাচ্চা যদি হঠাৎ কোনো দিকে চলে যায়, এই দায় কে নেবে। সরকার যদি এখানে ডে কেয়ারের ব্যবস্থা করতো, আমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম।’

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুতরা থাকেন যেখানে

অভিবাসী ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করা গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যারা বাস্তুচ্যুত হয়, তাদের মধ্যে ৪১ শতাংশ ঢাকায় বিভিন্ন বস্তিতে বসবাস করে। ২২ দশমিক ১ শতাংশ চট্টগ্রামে, ৬ দশমিক৭ শতাংশ খুলনায়, ৬ দশমিক৪ শতাংশ নোয়াখালীতে, ৩ দশমিক৭ শতাংশ বরিশালে, ২ দশমিক ২ শতাংশ কুমিল্লায়, ১ দশমিক ৫ শতাংশ সাতক্ষীরায়, ১ দশমিক ১ শতাংশ লক্ষ্মীপুর জেলা শহরে বসবাস করে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঘরবাড়ি হারিয়ে ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, সাতক্ষীরা, কুড়িগ্রাম, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী ও পিরোজপুর জেলা থেকে বেশি মানুষ বস্তিতে আসে।

রামরুর রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর মাহমুদুল হাসান রকি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখেছি, প্রায় প্রতিটি পরিবারে ১৮ বছরের নিচে শিশুরা রয়েছে। এর মধ্যে দুই থেকে আট বছর বয়সীদের সংখ্যা অনেক। এদের মধ্যে খুব সংখ্যক পড়াশোনার সঙ্গে যুক্ত।’

ঘরবাড়ি হারিয়ে বিপন্ন হচ্ছে শিশুদের জীবন

স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না শিশুরা

বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাস্তুচ্যুতদের বেশিরভাগ ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় আসায় একটা পরিবারের ওপর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব ধরনের প্রভাব পড়ে। সেই সঙ্গে তাদের শিশুরা দরিদ্রতার শিকার হয়ে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নানা ঝুঁকির মধ্য দিয়ে বড় হয় এই শিশুরা। এমন শিশুর সংখ্যা হাজার হাজার। উদ্বাস্তু হয়ে যারা আসে তারা এখানে সন্তানও প্রসব করেন। ফলে দরিদ্রতার প্রভাব তাদের ওপরও পড়ে।

জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘উপকূল কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা জেলাগুলোর নিম্নআয়ের মানুষ দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে তাদের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তারা এই পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারেন না। তখন তারা বিকল্প চিন্তা করেন। এর মধ্যে একটা চিন্তা হলো অনেকে পেশা পরিবর্তন করেন, অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে যান। বেশিরভাগ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়েন, পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় আসার পর সবচেয়ে সমস্যায় পড়ে শিশুরা। তারা বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টিকর খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে থাকে। নতুন পরিবেশে এসে বাবা-মায়েরা কিছুটা মানিয়ে নিলেও শিশুদের হিমশিম খেতে হয়। শিশুরা আবশ্যকীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তারা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না।’

‘বস্তির মানুষগুলো মাসে গড়ে ১৫ হাজার কিংবা তার কিছু কম বেশি টাকা আয় করে। মুদ্রাস্ফীতির বাজারে এই টাকা একটি পরিবারের জন্য খুবই সামান্য। ফলে এই পরিবারগুলোতে শিশুরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়। শিশুদের পড়ালেখা হয় না, পুষ্টিকর খাবার পায় না, তারা সোসাইটিতে হীনমন্যতায় ভোগে। তারা মা-বাবার নার্সিং পায় না। চালচলনে ও তাদের সুস্থ জীবন বিকশিত করতে গিয়ে তারা সামাজিক ভাবে বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে বড় হয়। পরে শিশুরা বড় হতে হতে বিভিন্ন অপরাধ কিশোর গ্যাং, মাদকাসক্ত, ভবঘুরে হয়ে যায়। অনেকে শিশুশ্রমে যুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে তাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠাটা আর সম্ভব হয় না।- যোগ করেন এই পরিবেশ বিশেষজ্ঞ।

‘বস্তির শিশুদের পুষ্টিকর খাদ্য ও সুপেয় পানির অভাব। মশা-মাছি, ধুলাবালি ও নোংরা পরিবেশে তাদের বড় হতে হয়। যে কোনো সময় তাদের ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া হয়। বড়দের তুলনায় শিশুরা যে কোনো রোগের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকে।’- ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম

স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে শিশুরা

বস্তির নোংরা ও ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যে চরম স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে থাকে শিশুরা। অর্থাভাবে নিয়মিত চিকিৎসাসেবাও তারা পায় না।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বস্তির শিশুদের পুষ্টিকর খাদ্য ও সুপেয় পানির অভাব। মশা-মাছি, ধুলাবালি ও নোংরা পরিবেশে তাদের বড় হতে হয়। যে কোনো সময় তাদের ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া হয়। বড়দের তুলনায় শিশুরা যে কোনো রোগের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। পুষ্টির অভাবে তাদের মায়েরাও দুধ খাওয়াতে পারেন না। শিশুরাও বাড়তি ফলমূল ও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে ভোগে। এতে ছোট থেকে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা নিয়ে তারা বেড়ে ওঠে।’

jagonews24

‘অন্যদিকে এসব শিশু অর্থের অভাবে ভালো চিকিৎসা পায় না। সরকারি হাসপাতালে তো অনেক রোগী, সেখানে জায়গা পাওয়াও কষ্টকর। সরকার যদি তাদের দায়িত্ব নেয়, বিনামূল্যে ওষুধের ব্যবস্থা করে আমরাও বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতে চাই।’ বলছিলেন ডা. জাহাঙ্গীর আলম।

‘আমার এখানে শিশুরা দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণির সমমানের পড়াশোনা করতে পারে। এরপর অধিকাংশ শিশু টাকার অভাবে বাইরের স্কুলে পড়তে পারে না। অনেক শিশুর মেধা আছে, ইচ্ছাশক্তি আছে। কিন্তু সামর্থ্য না থাকায় বাবা-মা বাইরের স্কুলে পড়াতে পারেন না। অধিকাংশই শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে যায়।’- এনজিওকর্মী জুলিয়া সুবর্ণা

বস্তিতে শিক্ষা বলতে শুধু এনজিও স্কুল

বস্তিগুলোতে সরকারি-বেসরকারি কোনো স্কুল নেই। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) শিশুদের কিছুটা পড়াশোনা করায়।

বনানীর গোডাউন বস্তিতে এনজিওকর্মী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের বিনামূল্যে পড়ান জুলিয়া সুবর্ণা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার এখানে শিশুরা দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণির সমমানের পড়াশোনা করতে পারে। এরপর অধিকাংশ শিশু টাকার অভাবে বাইরের স্কুলে পড়তে পারে না। অনেক শিশুর মেধা আছে, ইচ্ছাশক্তি আছে। কিন্তু সামর্থ্য না থাকায় বাবা-মা বাইরের স্কুলে পড়াতে পারেন না। অধিকাংশই শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে যায়।’

জুলিয়া সুবর্ণা বলেন, ‘আমার এখানকার অ আ ক খ তাদের জীবনের শেষ শিক্ষা। একপর্যায়ে তারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। কেউ রাস্তাঘাটে বুট, বাদাম, চা-সিগারেট বিক্রি করে। অনেকে নানা অপরাধে জড়ায়।’

বনানীর গোডাউন বস্তির স্কুলে পড়ছে শিশুরা/জাগো নিউজবনানীর গোডাউন বস্তির স্কুলে পড়ছে শিশুরা/জাগো নিউজ

বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে মেয়েরা

২০১৪ সালের ২২ মে ‘নগরায়নের প্রবণতা ও শিশুদের ওপর প্রভাব’ এবং ‘রাজধানীর নির্বাচিত পাঁচটি বস্তির অবস্থা বিশ্লেষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন। এর মধ্যে ‘নগরায়নের প্রবণতা ও শিশুদের ওপর প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে বলা হয়, বস্তিতে বসবাসকারী কন্যাশিশুদের ৮০ শতাংশই বাল্যবিবাহের শিকার, ছেলেদের মধ্যে এই হার ৪৬ শতাংশ।

গবেষণায় বলা হয়, এসব বস্তিতে বসবাসকারী অভিভাবকদের ৫২ শতাংশ জানিয়েছেন ‘ভালো পাত্র’ পাওয়ায় কন্যাশিশুদের বিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া ২০ শতাংশ অভিভাবক দরিদ্রতা ও ১৯ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পেতে কন্যাশিশুদের বাল্যবিবাহ দিয়েছেন।

২০২৪ সালে এসেও বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে বস্তির মেয়েরা। গোডাউন বস্তির শিশু রক্ষা কমিউনিটি হাব ও কিশোরী ক্লাবের সদস্য সাদিয়া (১৬)। নরসিংদী থেকে পারিবারিক কলহে মায়ের সঙ্গে চলে আসে ঢাকার এই বস্তিতে। অর্থাভাবে বেশিদূর পড়ালেখা করাতে না পারায় সাদিয়াকে বিয়ে দেন তার মা।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শিক্ষক জুলিয়া সুবর্ণা জাগো নিউজকে বলেন, ‘নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় সাদিয়ার বিয়ে হয়। বাচ্চা হওয়ার পর সাদিয়া ও তার বাচ্চা দুজনেই অসুস্থ। দুজনই শরীর ভালো রাখতে পারেনি।’

‘শিশুদের বেড়ে ওঠা এবং মানসিক বিকাশের জন্য নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সাহচর্য প্রয়োজন। উদ্বাস্তু হয়ে আসা শিশুরা সেই সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হয় বলে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। গ্রামীণ মুক্ত পরিবেশ থেকে শহুরে বদ্ধ পরিবেশে এসে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।’- সেন্টার ফর পিপল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের পরিচালক মুহম্মদ আবদুর রহমান

বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মানসিক বিকাশ

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে নগরে আসা শিশুরা নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হয়। বাধাগ্রস্ত হয় তাদের মানসিক বিকাশ।

এই যেমন ঘরবাড়ি হারিয়ে এখন গোডাউন বস্তির বাসিন্দা শিশু সামাদ। পড়ছে গোডাউন বস্তি শিশু সুরক্ষা কমিউনিটি হাব স্কুলে। সাত বছর বয়সী সামাদ বলে, ‘মন চাইলে খেলতে পারি না। এখানে খেলার মাঠ অনেক দূরে। মা মাঠে যাইতে দেয় না, যদি হারিয়ে যাই।’

গ্রামে কাদের সঙ্গে খেলতে? জবাবে সামাদ বলে, ‘গ্রামের বন্ধুরা ছিল। এখানে কাউরে চিনি না।’
‘মা আমারে পড়তে দিয়া কাজে গেছে। সে আইলে এখান থেকে বাসায় যামু।’ বলছিল সামাদ।

সেন্টার ফর পিপল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের পরিচালক মুহম্মদ আবদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিশুদের বেড়ে ওঠা এবং মানসিক বিকাশের জন্য নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সাহচর্য প্রয়োজন। উদ্বাস্তু হয়ে আসা শিশুরা সেই সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হয় বলে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। গ্রামীণ মুক্ত পরিবেশ থেকে শহুরে বদ্ধ পরিবেশে এসে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তাছাড়া শিশুদের শিক্ষার ওপর বড় প্রভাব পড়ে। শিশুকালের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বন্ধু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন স্থানে খাপ খাওয়াতে না পেরে শিক্ষা থেকে ছিটকে যায় অনেক শিশু। মেয়ে শিশুদের বাল্যবিবাহ হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো অপরাধে জড়িয়ে পড়া। যে কারণে শিশু-কিশোর গ্যাংয়ের মতো অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) খুলনা জেলার সমন্বয়ক বাবুল হাওলাদার বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ যখন মারাত্মকভাবে হয়, তখন আশেপাশের অসংখ্য মানুষ রাজধানী ঢাকা কিংবা খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল জেলা শহরে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। এতে স্বাভাবিকভাবে তারা বস্তিতে কিংবা ভাসমান জায়গায় থাকে। আমাদের জেলা শহরগুলোতে দেখেছি পরিবারগুলো ভেঙে গিয়ে শিশুরা নিদারুণ যন্ত্রণায় দিন কাটায়। অনেকে ঢাকায় চলে গেলেও আট-দশ বছর বয়সীদের তাদের নানা-নানি কিংবা নিকটাত্মীয়দের কাছে রেখে যায়। মেয়ে শিশুদের অনেকে বাল্যবিবাহের শিকার হয়। অনেক শিশুই ভবঘুরে হয়ে যায়, অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।’

গোডাউন বস্তিতে থাকে রুমা বেগমের ছেলে ফিরোজ। পড়ে বস্তির শিশু রক্ষা কমিউনিটি হাব স্কুলে। সকালে অন্য শিশুদের সঙ্গে তাদের মা-বাবা এলেও ছয় বছর বয়সী শিশু ফিরোজ আসে একা। মা-বাবা কোথায় জানতে চাইলে ফিরোজ বলে, ‘মা কাজে। বাবা নেই। এখানে প্রতিদিন পড়ি।’ পাশে থাকা শিশু সহপাঠীরা বলে, ‘ও মোবাইল চালায়।’

মোবাইল পেল কোথায় প্রশ্নের জবাবে প্রতিবেশীরা বলেন, ওর মা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এ সময় ছেলেটা একাই থাকে। ও যেন হারিয়ে না যায়, এজন্য ওর মা হাতে মোবাইল দিয়ে গেছে। যেন ওকে কল দিয়ে পাওয়া যায় আর সময়ও কেটে যায়। ফিরোজ এ সময় স্কুলেও থাকে, মাঝেমধ্যে আমরা দেখে রাখি। অনেক সময় ও খেলতে চায় না কারও সঙ্গে। বিষণ্ণ হয়ে থাকে।

ঘরবাড়ি হারিয়ে বিপন্ন হচ্ছে শিশুদের জীবন

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘যারা সম্পত্তি হারিয়েছে, এলাকা হারিয়েছে, একটা সমাজ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নিজ গোত্র থেকে সরে আসায় তারা ঢাকায় উদ্বাস্তু হয়ে গেলো। ঢাকায় এসে তারা এক প্রকার মানসিক হীনমন্যতায় ভোগে। এখানে বেশিরভাগ শিশু ভালো পরিবেশ ও খাবার না পাওয়ায় তাদের শারীরিক বৃদ্ধি কম হচ্ছে। ফলে তাদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা হচ্ছে, তাদের ব্রেইন ডেভেলপমেন্টস ত্বরান্বিত হয় না। যেহেতু দরিদ্র পরিবার, মা-বাবাকে কাজ করতে হবে, এজন্য এ সময় বাচ্চারা একা থাকে।’

‘অন্যদিকে উঁচু শ্রেণি কিংবা উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিশুরা শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বিকাশ লাভের সুযোগ পায়, পড়াশোনায় এগিয়ে যায়। বস্তির শিশুরা নানাবিধ সংকটের কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিজেদের বিকশিত করতে পারে না। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তারা সমাজের মূলধারা কিংবা উঁচু শ্রেণির শিশুদের সঙ্গে টিকতে পারে না। এতে অনেকে সারা জীবনের মতো পিছিয়ে পড়ে।’

ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বস্তির এই শিশুগুলো তাদের মায়ের সঙ্গে কাজে গেলেও খুব বেশি সুবিধা পায় না, তাদের বাসস্থানে রেখে গেলেও একা একা থেকে হেয়প্রতিপন্ন হয়, বিষণ্ণতায় ভোগে। শিশুরা হীনমন্যতায় ও উদ্বেগের মধ্য দিয়ে বড় হয়। যেসব শিশু উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকায় চলে আসে, গ্রামে তাদের একটা সংঘ থাকতো, খেলার সঙ্গী থাকতো, হঠাৎ ঢাকায় এসে তারা একা হয়ে যায়। সংঘবদ্ধ জীবন থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শিশুরা অবরুদ্ধ জীবনযাপন করে, তারা অবিকশিত মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে। একটা সময় খারাপ ছেলেদের পাল্লায় পড়ে এরা অটোমেটিক অপরাধপ্রবণ হয়।’

• দেশজুড়ে ৫-১৭ বছর বয়সী প্রায় ৪৮ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত, যাদের বড় একটি অংশ ঢাকায় বসবাস করে
• ঢাকায় বস্তিবাসী শিশু শ্রমিকরা সপ্তাহে গড়ে ৬৪ ঘণ্টা কাজ করে
• দেশে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুশ্রম বেড়েছে ৪৫ শতাংশ
• ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুশ্রম বেড়েছে ছেলেদের ক্ষেত্রে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ, মেয়েদের ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ

শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে বাড়ছে শিশুশ্রম

বিশ্লেষকরা বলছেন, দারিদ্র্য ও পরিবেশগত দুর্যোগের ফলে বাস্তুচ্যুত পরিবারের সন্তানরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। পড়াশোনা থেকে ঝরে গিয়ে তারা শ্রমে যুক্ত হয়ে যায়।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশজুড়ে ৫-১৭ বছর বয়সী প্রায় ৪৮ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত, যাদের বড় একটি অংশ ঢাকায় বসবাস করে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন অনুসারে, শিশুশ্রমের মধ্যে ঢাকার বস্তি থেকে আসা শিশুর সংখ্যা বেশি। ঢাকার প্রায় এক কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যার একটি বড় অংশ বস্তিতে বাস করে। এই বস্তিগুলোর শিশুশ্রমিকদের বেশিরভাগই গৃহস্থালি কাজ, ছোট কারখানা, রাস্তার দোকান ও পরিবহন খাতে কাজ করে।

আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও মানবকল্যাণ বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের (ওডিআই) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় বস্তিবাসী শিশু শ্রমিকরা সপ্তাহে গড়ে ৬৪ ঘণ্টা কাজ করে। বাংলাদেশে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের শিশুশ্রমের পরিমাণ বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। আর ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে শিশুশ্রমের পরিমাণ বেড়েছে ছেলেদের ক্ষেত্রে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং মেয়েদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে এসব শিশু চরম গ্লানিকর অভিজ্ঞতা অর্জন করে।

কড়াইল বস্তির ‘ক’ ব্লকের পাঠশালা সংলগ্ন গলি দিয়ে একটু এগিয়ে হাতের বাঁ পাশ দিয়ে এগোলেই দেখা মিলবে চার দেওয়ালের একটি ছোট্ট রুম। সেখানে বসবাস করছেন ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা রাবেয়া বেগম ও তার কিশোর ছেলে আকবর হোসেন।

কড়াইল বস্তিতে থাকে আকবর হোসেন ও তার মা/জাগো নিউজকড়াইল বস্তিতে থাকে আকবর হোসেন ও তার মা/জাগো নিউজ

আকবর হোসেন জাগো নিউজকে বলে, ‘সাত কাঠা জমি ছিল আমাদের। তিনবারে পুরো জমি ভেঙে নদীর সঙ্গে মিশে গেছে। তখন আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তাম। সব হারিয়ে মায়ের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসি। এসে আর পড়াশোনা করতে পারিনি। পড়ার অনেক ইচ্ছে ছিল। এখন পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে কাজে লেগে গেছি।’
রাবেয়া বেগম বলেন, ‘ঢাকায় শুনছি ভোলাপট্টি আছে, এই বস্তিতে। এখানে এসে অনেক সংগ্রাম করে টিকে আছি। ছেলেটাকে আর পড়াতে পারিনি। এখন তিন বছর ধরে ভ্যান গাড়িতে করে সবজি-ফল বিক্রি করে।’

কড়াইল বস্তি ও গোডাউন বস্তি সংলগ্ন মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি কলোনি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু সাইয়েদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাধারণত বস্তির মধ্যে বিভিন্ন এনজিওর পাঠশালায় পড়াশোনা শেষে আমাদের এখানে ভর্তি হয়। এখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই বস্তিতে থাকে। তবে বস্তিতে যে পরিমাণ ছেলে-মেয়ে আছে, তাদের ৩০ শতাংশও আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায় না। এটা একটা শঙ্কার দিক। চেষ্টা থাকে কম মূল্যে তাদের পড়ানো। এদের অনেকে আবার দু-তিন শ্রেণিতে পড়লেও পরে আবার ঝরে যায়। তবে সরকার থেকে ভর্তুকি দিলে স্কুলে শিশুদের অংশগ্রহণ বাড়বে।’

• বস্তির প্রায় ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ শিশু কোনো না কোনোভাবে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত
• শিশুরা মূলত চুরি, মাদক পাচার ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধে জড়ায়
• ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু নেতিবাচক সহপাঠী বা বন্ধুবান্ধব দ্বারা প্রভাবিত হয়
• ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ শিশু দারিদ্র্যের কারণে অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে

অপরাধে ঝুঁকছে শিশুরা

ঢাকার বস্তির শিশুদের মধ্যে অপরাধে জড়িত হওয়ার সংখ্যা অনেক। বার্লিনভিত্তিক রিসার্চগেটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় বস্তির শিশুরা প্রায়ই সংগঠিত অপরাধ চক্রের শোষণের শিকার হয়, যা মূলত দারিদ্র্য ও মৌলিক প্রয়োজনীয়তার অভাবের কারণে ঘটে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। বস্তির প্রায় ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ শিশু কোনো না কোনোভাবে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। শিশুরা মূলত চুরি, মাদক পাচার ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধে জড়ায়। ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু নেতিবাচক সহপাঠী বা বন্ধুবান্ধব দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ শিশু দারিদ্র্যের কারণে অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে।

গোডাউন বস্তি সংলগ্ন বাজারের দোকানি খোকন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এই এলাকায় থাকি। বেচাকেনার সূত্রে অনেকের সঙ্গে পরিচয়। এখানকার শিশুরা অভাবে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে ধীরে ধীরে খারাপের দিকে ধাবিত হয়। চুরি করার ঘটনাও ঘটে। যত বড় হয় অপরাধ বাড়তে থাকে। অনেকে টাকার জন্য মা-বাবার সঙ্গে মারামারি করে। নেশাগ্রস্ত হয়। অনেক রাজনৈতিক নেতা তাদের ব্যবহার করেন। এই বস্তির কেউ রাস্তায় চা বিক্রি করে, কেউ বাসে হেলপারি করে। ঢাকার ছোটখাটো অনেক হোটেলের মালিক এখানে এসে চাকরির অফার দেন। সেখানে ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী অনেক শিশু ওয়েটার ও ক্লিনার হিসেবে কাজ করে।’

ঘরবাড়ি হারিয়ে বিপন্ন হচ্ছে শিশুদের জীবন

সমাজ ও অপরাধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে যারা বাস্তুচ্যুত হয়, তারা আদি নিবাস ছেড়ে সাধারণত বড় শহর বেছে নেয়। তাদের বিশ্বাস এখানে ভালো কর্মসংস্থান পাওয়া যাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের সঙ্গে থাকা শিশুরা। এখানে শিশুদের সামাজিকীকরণের প্রতিটি ধাপেই তারা বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ তারা যে পরিবেশে থাকে, সেখানে বিভিন্ন প্রসঙ্গ থাকে। এই প্রসঙ্গের সঙ্গে শিশুরা জড়িয়ে পড়ে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। তারা কিশোর গ্যাংয়ে যুক্ত হয়, মাদকাসক্ত হয়, মাদক কেনাবেচা ও বহনের কাজে নিয়োজিত হয়। এছাড়া চোরা কারবারিতে জড়িয়ে পড়ে। কিছু কিছু মেয়ে শিশু একটা সময় যৌনকর্মী হিসেবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। এদের অধিকাংশই বাধ্য হয়ে জড়িয়ে পড়ছে। কেউবা আয় উপার্জনের উৎস হিসেবে এটাকে বেছে নেয়।’

‘বাস্তুচ্যুত হয়ে ঢাকায় আসার পর একটি পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকরা যেভাবে বিভিন্ন সংকট মোকাবিলা করতে পারে, শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ের পক্ষে সেটি সম্ভব হয় না। ফলে এসব শিশু বস্তি কিংবা খোলা আকাশের নিচে যে ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে এসব প্রক্রিয়াগত কারণে তারা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। এজন্য আমরা নানাজনকে দায়ী করতে পারি, কিন্তু এর দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।’-যোগ করেন ড. তৌহিদুল হক।

তৌহিদুল হক বলেন, ‘পরিবার যখন শিশুর দায়-দায়িত্ব বহন করতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই শিশুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যায়। এখানে রাষ্ট্রের দায়টা আরেকটু জোরালো করতে হবে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে স্থায়ী কর্মসূচির মাধ্যমে আবাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। যেন তাদের সন্তানদের নিয়ে এলাকা ছাড়তে না হয়।’

শহরে বাড়বে চাপ, কর্মসংস্থানেরও সংকট

রামরুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি জলবায়ু দুর্যোগের কারণে এক কোটি ৬০ লাখ থেকে দুই কোটি ৬০ লাখ মানুষ জন্মগত বাসস্থান থেকে বাস্তুচ্যুত হবে। যাদের অধিকাংশ কর্মসংস্থানের আশায় ঢাকায় আশ্রয় নেবে।

২০২৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইসিসিসিএডি) এক প্রতিবেদনে বলেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলের মানুষের ঘরবাড়ি ও জীবিকা বিপন্ন হওয়ার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় নয় লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে কারণ সমুদ্রের পানি বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১২ থেকে ১৮ শতাংশ ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সীমিত সম্পদ ও জনসংখ্যাবহুল বাংলাদেশে জলবায়ু-উদ্বাস্তুরা সবকিছু হারিয়ে বাড়তি সমস্যা তৈরি করবে। শিশুরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে। লাখ লাখ শিশু মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণেই ঢাকায় মাইগ্রেটেড হয়ে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ আসে। এখানে আসার পরে তাদের আরও বংশবৃদ্ধি হয়। ২০০০ সাল কিংবা তার আগে পরে যারা এসেছে তারা স্থায়ী হয়ে বংশবিস্তার করছে। মাইগ্রেটেড হয়ে যারা ঢাকায় আসে, তাদের খুবই কম জন্মস্থানে ফিরে যায়। ফলে নগরীতে ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে।’

jagonews24

‘বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা দেখেছি, আরবান ডেভেলপমেন্ট মডেলে বড় বড় রাস্তাঘাট, দালানের পরিকল্পনা হলেও বস্তিবাসী এবং এখান থেকে যে প্রজন্ম গড়ে উঠছে তাদের নিয়ে কোনো প্রকার চিন্তা করা হয় না, তাদের উন্নয়নের অংশীদার করা হয় না। এই উদ্বাস্তুদের জন্য যদি শহরে অ্যাফোর্ডেবল হাউজ গড়ে তোলা যায়, তাহলে নির্দিষ্ট একটা অর্থ দিয়ে তাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা যায়। এতে কর্মজীবী মা-বাবারা কাজে গেলেও শিশুরা নিরাপদে থেকে বেড়ে উঠতো। এসডিজি-১১ তে বলা আছে, নির্দিষ্ট এই শ্রেণিকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন হয় না।’ বলছিলেন আদিল মুহাম্মদ খান।

জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য বরাদ্দ নেই বললেই চলে

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ঢাকা জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুর্যোগজনিত বাস্তুচ্যুতদের জন্য আমাদের সেরকম বরাদ্দ নেই। ঢাকা শহরে আমাদের কোনো কার্যক্রম নেই। কারণ সব সম্পত্তি সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার। ঢাকা জেলার অন্যান্য থানায় দুর্যোগে যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের জন্য পুনর্বাসন কার্যক্রম রয়েছে।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বস্তি উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণ কর্মকর্তা মুবাশ্বির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বস্তি উন্নয়ন কিংবা শিশুদের শিক্ষা বাসস্থান, চিকিৎসা নিয়ে সিটি করপোরেশনে কোনো বাজেট নেই। বিভিন্ন এনজিও ঢাকার বস্তিগুলোতে যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, তারা সিটি করপোরেশনের সাহায্য নেয়।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে সমন্বয় করে বস্তিতে শিক্ষামূলক বিভিন্ন প্রোগ্রাম রয়েছে। আমাদের বিভিন্ন ফান্ড রয়েছে। তবে ফান্ডের ফিগার বলা সম্ভব হচ্ছে না।’

তবে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বস্তিতে নির্দিষ্ট কোনো কার্যক্রম নেই। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, গাজীপুর ও টঙ্গীতে পথশিশু কিংবা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুল হাব ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে। তবে বস্তির শিশুদের জন্য কোনো বাজেট নেই বলে জানান তারা।

বস্তির শিশুদের জন্য কোনো কার্যক্রম রয়েছে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির সহকারী পরিচালক দেলোয়ারা খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বস্তিতে শিশুদের জন্য বিভিন্ন এনজিও রয়েছে। আমাদের ওরকম কোনো উদ্যোগ নেই। পথশিশুদের নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে।’

‘কখন, কীভাবে, কোন স্থান থেকে কারা জলবায়ু দুর্যোগজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে ঢাকায় আসছে তার বাস্তবসম্মত তথ্য বা পরিসংখ্যান প্রয়োজন। সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব এসব বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু তাদের জন্য সেভাবে তহবিল বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন দেখি না। এটা সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব।’ জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ এম জাকির হোসেন খান

সমাধান কোথায়?

বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতীয় কৌশলপত্র বাস্তবায়নে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা-২০২২ এ বলা আছে, যেসব পরিবার নদীভাঙন ও বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে ভূমিহীন, আশ্রয়হীন ও বাস্তুচ্যুত হয়েছে, সেসব পরিবারকে স্বল্পমেয়াদি আশ্রয়ণ/আদর্শপল্লী নীতিমালা ২০০১ অনুযায়ী পুনর্বাসন করা। এছাড়া শহরতলিতে আবাসন সৃষ্টির ক্ষেত্রে ও স্বয়ংসম্পূর্ণ কমিউনিটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়া। ছেলে-মেয়েদের জন্য শিক্ষার অবাধ সুযোগ তৈরি করা। বহুতল বিশিষ্ট দালান নির্মাণ করে সেখানে নিচে দোকান করে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা। সেখানে ডাক্তারের চেম্বার, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র ও ফার্মেসি স্থাপন করা।

প্রতিবেদনে আরও বলা আছে, বাস্তুচ্যুতদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য বড় কারখানাগুলোতে তাদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা। এছাড়া তাদের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা। প্রাপ্তবয়স্ক হলে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম করে গড়ে তোলা। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিনামূল্যে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।

ঘরবাড়ি হারিয়ে বিপন্ন হচ্ছে শিশুদের জীবন

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘এখানে সমাধানের বিষয় হলো আমাদের সংবিধানে বলা আছে, শিশুদের জন্মের কারণে বৈষম্য করার কোনো সুযোগ নেই। এজন্য রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শিশুদের জন্য যে অ্যাফোর্ডেবল হাউজ দরকার, সেটি সরকার করছে না। ফলে শহরে মানহীন বসবাস অযোগ্য বস্তি গড়ে উঠেছে। জাতীয় গৃহায়ন নীতিতে থাকলেও সরকার এখন পর্যন্ত এই প্রান্তিক মানুষগুলোর জন্য কোনো রূপরেখা তৈরি করেনি। সরকার শিশুদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা করলে রাজনৈতিক দলগুলোও সেটা অনুসরণ করতো। উদ্বাস্তুদের জন্য বিচ্ছিন্নভাবে শুধু এনজিও ও আইএনজিও দিয়ে সহায়তা কখনোই সম্ভব নয়। এখানে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।’

জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জামাল উদ্দীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকায় আসে, তারা দুটি সমস্যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত। একটি হলো খাওয়া-দাওয়া, দ্বিতীয়টি হলো তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই। এই দুটি বিষয় জোগাড় করতে গিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষ হিমশিম খায়। কোনোভাবে এ চ্যালেঞ্জ পূরণ করার পরে তারা শিশুর লেখাপড়া, স্বাস্থ্য কিংবা ন্যূনতম চাহিদা নিয়ে চিন্তা করে। যারা বাসস্থান ও খাবারের জন্য যুদ্ধ করে, তারা শিশুর পড়াশোনা কিংবা তার সুস্থ বিকশিত ধারায় বেড়ে ওঠার প্রতি মনোযোগ দিতে পারে না। তাই এখানে এই দুটি বিষয়ের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে।’

অধ্যাপক জামাল বলেন, ‘যারা বাস্তুচ্যুত হয়ে আসবে প্রথমেই তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই আর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে পরে তারা শিশুদের পড়াশোনা ও সুস্থ বিকাশের দিকে মনোযোগ দিতে পারবে। কিন্তু আমাদের সরকার ব্যবস্থায় এসব পদক্ষেপ নেই। ফলে দেশে একটা শ্রেণি বঞ্চিত হয়ে বেড়ে উঠছে, একটা সময়ে দেশের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।’

জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কখন, কীভাবে, কোন স্থান থেকে কারা জলবায়ু দুর্যোগজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে ঢাকায় আসছে তার বাস্তবসম্মত তথ্য বা পরিসংখ্যান প্রয়োজন। সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব এসব বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু তাদের জন্য সেভাবে তহবিল বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন দেখি না। এটা সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব।’

আরএএস/এমএমএআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।