মাদক পাচারে শিশুদের ব্যবহার, ভাগের টাকা যায় ‘বাবুদের’ পকেটে

ইয়াসির আরাফাত রিপন
ইয়াসির আরাফাত রিপন ইয়াসির আরাফাত রিপন
প্রকাশিত: ১১:৫৪ এএম, ৩০ নভেম্বর ২০২৪
রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে মাদক বহন ও পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে শিশুদের/জাগো নিউজ গ্রাফিক্স

রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে প্রায় দেড় হাজার যৌনকর্মী রয়েছেন। তাদের শিশুসন্তান রয়েছে ৬০০’র মতো। চরম বৈষম্য, অনাদর-অবহেলা ও নির‌্যাতনে বড় হয় এই শিশুরা। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত অনেক শিশু জড়িয়ে পড়ে মাদকে, নয়তো মায়ের পেশায়। যৌনপল্লির শিশুদের সমস্যা ও দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইয়াসির আরাফাত রিপনের চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয়টি

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে চলে রমরমা মাদক ব্যবসা। এখানে মাদক বহন ও পাচারে ব্যবহার করা হয় শিশুদের। মাদক পাচারে যুক্ত থাকতে থাকতে একপর্যায়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তারা।

অন্যদিকে মেয়ে শিশুদের যৌন পেশায় বাধ্য করছেন পল্লির বাবু বা যৌনকর্মীর প্রেমিকরা। অথচ আইন অনুযায়ী শিশুদের কোনোভাবেই এ পেশায় বাধ্য করা যাবে না। আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের যৌনকর্মে নিয়োজিত করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সী মেয়েদের প্রতারণার মাধ্যমে এনে এবং পল্লির মেয়ে শিশুদের বাধ্য করছে যৌন পেশায়। মাদক আর যৌন পেশার বেশির ভাগ অর্থই চলে যাচ্ছে বাবুদের পকেটে। সম্প্রতি জাগো নিউজের অনুসন্ধানে এসব চিত্র উঠে এসেছে।

আরও পড়ুন

সম্প্রতি দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি দৌলতদিয়া সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, যৌনপল্লিতে জন্ম নেওয়া বেশির ভাগ শিশু-কিশোরই বর্তমানে মাদকাসক্ত। বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও মাদক ব্যবসা ও সেবনের সঙ্গে জড়িত। তাদের এ ব্যবসায় নামিয়ে ফায়দা লুটছেন প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ী ও নারী পাচারকারীরা।

দৌলতদিয়া পল্লিতে বর্তমানে অর্ধশত মদের দোকান, শতাধিক গাঁজার দোকান ও ভাসমান হেরোইন বিক্রেতা রয়েছে। তাছাড়া মদ ও ফেনসিডিল ব্যবসায়ী গড়ে উঠেছে প্রশাসনের চোখের সামনেই। যদিও মাঝেমধ্যে কড়া নজরদারি করা হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

শিশুদের নষ্ট করছে পল্লির বাবুরা। মাদক ব্যবসা ও পাচারে শিশুদের ব্যবহার করছে তারা। এ কারণে ছোট থেকেই মাদক নিচ্ছে শিশুরা।-পল্লির এক কর্মী

বড় বাবুদের হাতে নষ্ট হচ্ছে ছোট বাবুদের জীবন

সবচেয়ে বেশি মাদক বিক্রি হয় পল্লির আলেহার গলি, মেন্টাল গলি ও কবরস্থানের গলিতে। তুলনামূলক কম জনসমাগম থাকায় সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ দোকান, অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে মাদক। হাতের নাগালে মাদক আর শিশুদের দিয়ে পাচারের কারণে উঠতি বয়সীদের বেশিরভাগই মাদক সেবন করছে।

পল্লির বাসিন্দা এক নারীর ১০ বছরের ছেলে এখন মাদক সেবন করছে। প্রকাশ্যে সিগারেট খাচ্ছে আট বছরের ছোট ছেলে। মাদক বিক্রির টাকায় তারা এসব করছে।

শিশু দুটির মা জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটা সময় মনে হতো আমি যে পথেই থাকি না কেন, সন্তানদের মানুষ করবো। কিন্তু তারাও এখন মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। সেফ হোমে রাখতে চাইলেও তারা থাকে না।’

আরও পড়ুন

তার অভিযোগ, শিশুদের নষ্ট করছে পল্লির বাবুরা। মাদক ব্যবসা ও পাচারে শিশুদের ব্যবহার করছে তারা। এ কারণে ছোট থেকেই মাদক নিচ্ছে শিশুরা।

একই অভিযোগ পল্লির আরেক কর্মীর। নিজে মাদক নিলেও নিরাপত্তার কথা ভেবে পল্লির বাইরে সেফ হোমে রাখেন নিজ সন্তানকে। পরে তার বাবু (প্রেমিক) সন্তানকে সেফ হোম থেকে বাসায় এনে মাদক পাচারে যুক্ত করেছেন।

শিশুটির মা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি দিন ও রাতে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে থাকি। সন্তানকে ঠিকমতো দেখভাল বা সেবা-যত্ন করা হয় না। এ সুযোগে বাবু আমার সন্তানকে মাদকের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন। মূলত টাকার লোভে তিনি এমনটা করেছেন। এখন এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে, সেখান থেকে ছেলেকে ফেরানো কঠিন।’

‘বাবুরা বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা সংগ্রহ করে ঘাট এলাকায় নিয়ে আসে। সেখান থেকে আমরা পাড়ায় (যৌনপল্লি) নিয়ে আসি। এখানে শিশু, নারীসহ প্রায় সবাই মাদক নেয়, যা টাকা পাই তা দিয়ে চলি।’- পল্লির ১২ বছর বয়সী এক শিশু

যেভাবে মাদক পাচার করে শিশুরা

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাস, ট্রাক ও ট্রেনের মাধ্যমে মাদক পাচারকারীরা মাদক নিয়ে আসেন। এরপর এসব মাদক লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট বা রেলস্টেশন থেকে শিশুদের মাধ্যমে নেওয়া হয় যৌনপল্লির ভেতরে। মেন্টালগলি ও আলেহার গলির বাসাগুলোয় সেই মাদক মজুত করা হয়। এরপর তা পাইকারি বিক্রি করা হয় কবরস্থানের গলিসহ আশপাশের কয়েকটি গলিতে।

স্বস্তা শ্রম ও সহজে ব্যবহারের মাধ্যম হিসেবে এসব কাজে ব্যবহার করা হয় শিশুদের। এই শিশুরাই মাদক বিক্রি, বহন ও টাকা উত্তোলন করে। বিনিময়ে শিশুদের দেওয়া হয় সামান্য অর্থ ও মাদক। সেগুলো শিশুরা বিক্রির পাশাপাশি নিজেরা গ্রহণ করে।

পল্লির ১২ বছর বয়সী এক শিশু এই প্রতিবেদককে বলে, ‘বাবুরা বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা সংগ্রহ করে ঘাট এলাকায় নিয়ে আসে। সেখান থেকে আমরা পাড়ায় (যৌনপল্লি) নিয়ে আসি। এখানে শিশু, নারীসহ প্রায় সবাই মাদক নেয়, যা টাকা পাই তা দিয়ে চলি।’

আরও পড়ুন

মাদক পাচারে ছেলে শিশুদের পাশাপাশি মেয়ে শিশুরাও জড়িয়ে পড়েছে। তেমনই একজন সুরাইয়া (ছদ্মনাম)। দশের কাছাকাছি বয়স তার। পড়ালেখা বাদ দিয়ে এখন মায়ের কাছে থাকছে সে।

সুরাইয়া বলে, ‘অপরিচিত কিছু মানুষ আসেন পল্লির আশপাশে, তাদের (মাদক কারবারি) চেহারা ও ব্যাগ দেখলেই বুঝতে পারি। টাকা আগেই পরিশোধ করা থাকে, পরে আমরা সংগ্রহ করি।’

মাদক বহনকালে পুলিশের হাতে আটকের ঝুঁকি থাকে কি না এ বিষয়ে সুরাইয়া বলে, ‘চালকের (বাস-ট্রাক-সিএনজি) কাছ থেকে নেওয়ার সময় ঝুঁকি থাকে। তবে যাত্রীর কাছ থেকে সহজেই আনা যায়। বিশেষ করে ট্রেনে করে গাঁজা, ফেনসিডিল এলে সহজেই ভেতরে আনা যায়। কারণ রেললাইনের সঙ্গেই বাসা (পল্লি)। আটকের ঘটনাও ঘটে। তখন বাবুরা ছাড়িয়ে আনেন।’

‘মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ বানাতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। আমার বাবু মানসিক চাপ দিয়ে সেফ হোম থেকে মেয়ে নিয়ে এসেছেন। শিক্ষকদের বাধার মুখেও আটকাতে পারিনি। এখন মেয়ের টাকায় বাবু চলছে, বাড়তি আয়ে সচ্ছলতাও এসেছে। তবে এটা জীবন না, বাবুকে এটা বললেই নির্যাতন করে আমাকে।’ যৌনকর্মী সোনিয়া (ছদ্মনাম)

বাবুর চাপে বাধ্য করা হচ্ছে যৌন পেশায়

কুষ্টিয়ার একটি মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশোনা করতেন সোনিয়া (ছদ্মনাম)। পড়ার সময় স্থানীয় এক যুবকের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। বছর খানেক প্রেম চলার পর বিয়ে করার কথা বলে তাকে দৌলতদিয়ার যৌনপল্লিতে বিক্রি করেন ওই যুবক। সেই থেকে এ পল্লিতেই আছেন তিনি। আর গ্রামে ফেরা হয়নি। পল্লির বাড়িওয়ালি সে সময় নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে সার্টিফিকেটে তার বয়স ১৮ বছর করে দেন।

শিশু বয়সে এলেও বয়স পেরিয়েছে ৩০’র কোটায়। একটি মেয়ে রয়েছে সোনিয়ার। মেয়েকে একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছেন। ইচ্ছে ছিল বড় কিছু হবে মেয়ে। তবে বাড়ির বাবুর চাপে মাধ্যমিকে পড়ুয়া মেয়েকে এখন পল্লির ভেতরেই রাখছেন তিনি। ১৮ এর নিচে বয়স হলেও মেয়েটিকে যুক্ত করা হয়েছে যৌন পেশায়।

সোনিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি শিশুকালের স্মৃতি আর আনতে চাই না, মনেও করতে চাই না। আমার সেই কাল ফিরে আসবে না। মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ বানাতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। আমার বাবু মানসিক চাপ দিয়ে সেফ হোম থেকে মেয়ে নিয়ে এসেছেন। শিক্ষকদের বাধার মুখেও আটকাতে পারিনি। এখন মেয়ের টাকায় বাবু চলছে, বাড়তি আয়ে সচ্ছলতাও এসেছে। তবে এটা জীবন না, বাবুকে এটা বললেই নির্যাতন করা হয় আমাকে।’

আরও পড়ুন

একই অবস্থা বর্ণনা করেন শেফালি (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘আমার বাবু অনেক ভালো ছিলেন। আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে স্ত্রী-সন্তান থাকলেও আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। আমার মেয়েকে নিজের মেয়ে হিসেবে দেখতেন। তার আশ্বাসে আমার আয়ের সবটুকু তাকে দিয়েছি। এখন টাকা আয় কম হলেই নির‌্যাতন করেন।’

শেফালি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার মেয়ের বয়স ১৫ বছর। তার লেখাপড়া করার কথা। তবে আমি বেশি আয় করতে পারি না দেখে বাবু মেয়েকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে এই পেশায় নামিয়েছেন। অথচ মেয়েটা ভালো পড়াশোনা করতো। কলেজে পড়বে, বড় হবে, সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। বাবু আমাকে আর্থিকভাবে নিঃস্ব করেছেন, আবার মেয়েকেও এ পথে নিয়ে এলেন।’

‘আমরা পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করেছি। তাকে বলেছি কোনো নেত্রী চাই না, যে কি না পল্লির কাজ না করে টাকা আয়কে মুখ্য হিসেবে দেখেন। আমরা নিজেরাই নিজেদের উন্নয়নে কাজ করতে চাই।’- অসহায় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার সভানেত্রী ফরিদা পারভীন

বাবুদের পাশাপাশি চলে নারী নেত্রীদের দাপট

পল্লির বাসিন্দারা জানান, টাকা পেলে ১৮ বছরের নিচের শিশুদেরও প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে সনদ দেয় পুলিশ। এক্ষেত্রে সহযোগী হিসেবে কাজ করেন বাবুরা। এ কাজে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেন দৌলতদিয়ার অবহেলিত মহিলা সমিতির সভাপতি ঝুমুর আক্তার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ে প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন ঝুমুর। হাবিবুর রহমানের আশীর্বাদে ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সহযোগিতায় শিশুদের মাদক ও যৌন পেশায় যুক্ত করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তিনি। সাভারে বানিয়েছেন সাততলা বাড়ি, দৌলতদিয়ায় গড়েছেন ব্যবসা।

ঝুমুরের স্বামী দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুল জলিল ফকির। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে গেছেন তারা। এ নিয়ে ঝুমুরের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েও পাওয়া যায়নি।

রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায় রেললাইনের পাশেই যৌনপল্লি। মাদক আনা যায় সহজেই/জাগো নিউজরাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায় রেললাইনের পাশেই যৌনপল্লি। মাদক আনা যায় সহজেই/জাগো নিউজ

এখন ঝুমুর না থাকলেও আরও অনেক নারী তার মতো নেত্রী হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন। কেউ নেত্রী হলেই পল্লিতে নির‌্যাতন চালান। এজন্য এবার বাধ সাধছেন অনেকে।

নারী কর্মীরা জানান, তারা কোনো নেত্রী নন বরং সমাজসেবক হলেই তাদের জন্য ভালো।

আরও পড়ুন

পল্লিতে নানা সুবিধা আর সচেতনতামূলক কাজ করছে অসহায় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন সংস্থা। এটি যৌনকর্মীদের নিজস্ব সংস্থা। এর সভানেত্রী ফরিদা পারভীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করেছি। তাকে বলেছি কোনো নেত্রী চাই না, যে কি না পল্লির কাজ না করে টাকা আয়কে মুখ্য হিসেবে দেখেন। আমরা নিজেরাই নিজেদের উন্নয়নে কাজ করতে চাই।’

জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রুবাইয়াত মো. ফেরদৌস জাগো নিউজকে বলেন, ‘যৌনপল্লিতে এনজিওর মাধ্যমে কাজ করছি। আমরা বয়স্ক ভাতা ও শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে সেখানে কাজ করছি। চেষ্টা করছি প্রতিটি শিশু ও শিশুর পরিবারের কাছে যেন সরকারি সহায়তা পৌঁছে যায়। তাছাড়া শিশুদের বিষয়টা প্রশাসনের নজরে আসছে, ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে সেখান থেকে।’

‘এখানকার মেয়েরা আসলে নিরাপত্তাহীনতা ও একাকীত্বে থাকেন। তাদের অসুস্থতা বা সন্তানদের দেখাশোনার প্রয়োজন পড়ে। আবার সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পল্লির বাইরে তারা চলে যেতে চান। এ কারণে তারাই ছেলেদের প্রেমের প্রস্তাব দেন। আমরাও চাই তাদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক করে মূল সমাজে ফিরিয়ে নিতে।’- বাবুল আহম্মেদ

যৌনপল্লির ‘বাবু’ কারা

যৌনপল্লিতে বসবাসরত নারী কর্মীদের প্রত্যেকের একটা করে ছেলে বন্ধু থাকে, যারা রাতে ওই মেয়ের পাশে থাকেন। ভালোবাসার মানুষ হিসেবে যৌনকর্মীরা তাদের বেছে নেন। এরা বাবু হিসেবে পরিচিত। ভবিষ্যতে টাকা-পয়সা জমিয়ে তাকে নিয়ে সমাজের মূল ধারায় ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন কর্মীরা।

এ কারণে উপার্জনের সব টাকা বাবুকে দেন যৌনকর্মীরা। এ টাকা নিয়ে বাবুরা বাইরে কোনো ব্যবসা করেন বা গ্রামে বাড়ি-জমি কেনেন। কেউ কেউ মাদকের পেছনে টাকা উড়িয়ে দেন। কোনো কোনো নারীর পল্লি ও পল্লির বাইরে মিলিয়ে দুজন বাবু থাকে। একজন চলে গেলে অন্যজনকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

পল্লির একজন নারী খুব সহজেই বাবুর খপ্পরে পড়েন। ভালোবেসে তার সব টাকা-পয়সা ওই বাবুকে দেন। বাবু ওই নারীকে ততক্ষণ পর্যন্তই ভালোবাসেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি টাকা দিতে পারেন। টাকা-পয়সা আয় করতে না পারলে শুরু করেন নির‌্যাতন। যৌনপল্লির বাড়িওয়ালি বা সর্দারনিদের অত্যাচার এখন তেমন না থাকলেও এই বাবুদের অত্যাচার রয়েছে। বাবুদের হাতে নির্ভর করে নারীদের স্বাধীনতা।

আরও পড়ুন

পল্লির বাবুদের বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় সাংবাদিক ও সমাজকর্মী শেখ রাজিবের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘পল্লির মেয়েদের সব টাকা-পয়সা বাবুরা নিয়ে যাচ্ছেন, মেয়েদের নিঃস্ব করে দিচ্ছেন। টাকা-পয়সা, আয় কমে গেলে বাবুরা অন্য মেয়ে ধরেন অথবা শিশু মেয়েদের আবারও মায়ের পেশায় নামিয়ে দেন। এটা করেন টাকার লোভে। একটা সময় বাবুরা তাদের (মা-মেয়ে) ছেড়ে চলে যান। এটা নিয়ে যৌনকর্মীদের সচেতন করা হলেও তারা কারও কথা শোনেন না। বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করছে, তবে ভালো ফলাফল আসছে না।’

এ বিষয়ে বাবুল আহম্মেদ নামের এক বাবু জাগো নিউজের কাছে দাবি করেন, ‘এখানকার মেয়েরা আসলে নিরাপত্তাহীনতা ও একাকীত্বে থাকেন। তাদের অসুস্থতা বা সন্তানদের দেখাশোনার প্রয়োজন পড়ে। আবার সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পল্লির বাইরে তারা চলে যেতে চান। এ কারণে তারাই ছেলেদের প্রেমের প্রস্তাব দেন। আমরাও চাই তাদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক করে মূল সমাজে ফিরিয়ে নিতে। প্রতিটি বাবুই চান এখানকার মেয়েদের বিয়ে করে নিজ গ্রামে নিয়ে যেতে।’

শিশুদের নির‌্যাতন বিষয়ে আমিনুল ইসলাম নামের এক বাবু জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখানে ছোট থেকেই শিশুরা দুষ্টু হয়, নেশা-পানি করে। এ কারণে শাসন করি, কোনো মারধর করি না। এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না।’

‘অনেকে শিশুদের পেশায় নিয়ে থাকে, ইয়াবা বিক্রির দোকান খুলে বসে। এতে শত্রু বাড়ে। এখন ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই চলে গেছেন। আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও চলে যেতে বাধ্য হবেন। তখন বিএনপি করা লোকজনই বাবু হবেন।’-পারভেজ

পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাবুর পরিবর্তন

স্থানীয় বাসিন্দা, পল্লির কর্মী ও এনজিও’র তথ্য বলছে, দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে ৮০০ মেয়ের বাবু রয়েছেন ৮৫০’র বেশি। এর মধ্যে কোনো কোনো মেয়ের দুজন করে বাবু রয়েছে। তবে ৫ আগস্টের পর ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাবুদের দেখা মিলতো কম। এটা নিয়ে অনেকে স্বস্তি প্রকাশ করলেও এখন উল্টো চিত্র হয়েছে। পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাবুর পরিবর্তন এসেছে। তিন শতাধিক বাবুর পরিবর্তন হয়েছে। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে আরও পাঁচ শতাধিক বাবু পরিবর্তন হতে পারে। নতুন বাবুরা এলে নির‌্যাতনের ঝুঁকি তৈরি হবে শিশুদের ক্ষেত্রে, এমনটা বলছে পল্লীর একাধিক সূত্র।

আরও পড়ুন

পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাবু পরিবর্তনের বিষয়ে পল্লির পারভেজ নামের এক বাবু জাগো নিউজকে বলেন, ‘বেশি দলাদলি করলে তো বিপদে পড়তেই হবে। অনেকে শিশুদের পেশায় নিয়ে থাকে, ইয়াবা বিক্রির দোকান খুলে বসে। এতে শত্রু বাড়ে। এখন ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই চলে গেছেন। আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও চলে যেতে বাধ্য হবেন। তখন বিএনপি করা লোকজনই বাবু হবেন।’

‘পল্লির শিশুদের নিরাপদ বাসস্থান ও গর্ভবতী মায়েদের নিরাপদে না রাখতে পারলে মায়ের পেশায় লিপ্ত হবে মেয়ে শিশুরা। একইভাবে মাদকাসক্তসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়বে ছেলে শিশুরা। বর্তমানে যৌনপল্লির চিত্র কিন্তু এটাই। পাশাপাশি বাবুদের নির‌্যাতন থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হবে। এটা না হলে সমাজ আরও কলুষিত হবে।’- মজিবুর রহমান জুয়েল

সেফ হোমের বিকল্প নেই

বেসরকারি সংস্থা ‘পায়াক্ট বাংলাদেশ’র দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ম্যানেজার মজিবুর রহমান জুয়েল জাগো নিউজকে বলেন, ‘যৌনপল্লিতে অবস্থানরত শিশুদের রক্ষা করতে সেফ হোমের বিকল্প নেই। কারণ নিরাপদ আবাসন শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সহায়ক। পল্লির শিশুদের নিরাপদ বাসস্থান ও গর্ভবতী মায়েদের নিরাপদে না রাখতে পারলে মায়ের পেশায় লিপ্ত হবে মেয়ে শিশুরা। একইভাবে মাদকাসক্তসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়বে ছেলে শিশুরা। বর্তমানে যৌনপল্লির চিত্র কিন্তু এটাই। পাশাপাশি বাবুদের নির্যাতন থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হবে। এটা না হলে সমাজ আরও কলুষিত হবে।’

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘যৌনতার সঙ্গে মাদকের সংযোগ রয়েছে। এর সঙ্গে শিশুদের জড়ানো হলে সে মাদক নেবে, মাদক বহন করবে কিংবা মাদক গুদামজাত করবে। এখানে সমাজ ও সরকারের ভূমিকা রয়েছে। যৌনপল্লির শিশুদের নিরাপদ বাসস্থান, শিক্ষার পরিবেশ দিতে হবে। শিশুদের স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত ব্যবস্থা করতে পারলে তারাও সমাজের মূলধারার সঙ্গে মিশতে পারবে। এটা না হলে মাদক যৌনপল্লি পেরিয়ে সমাজের মূলধারায় সয়লাব হয়ে যাবে।’

‘অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বয়স বেশি দেখিয়ে যৌন ব্যবসা করানো নিঃসন্দেহে অপরাধ। কেউ এমন কাজ করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আবার কম বয়সীরা স্বেচ্ছায় নাকি জোর করে সে পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে সেটা দেখতে হবে। পল্লির কন্যা সন্তানকে বাধ্য করা হচ্ছে বা করছে, কারা এর পেছনে রয়েছে? যৌনপল্লির পেছনে নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি যারা রয়েছেন তারা মাসোয়ারা নেন।’- ড. তৌহিদুল হক

আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন

ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বয়স বেশি দেখিয়ে যৌন ব্যবসা করানো নিঃসন্দেহে অপরাধ। কেউ এমন কাজ করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আবার কম বয়সীরা স্বেচ্ছায় নাকি জোর করে সে পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে সেটা দেখতে হবে। পল্লির কন্যাসন্তানকে বাধ্য করা হচ্ছে বা করছে, কারা এর পেছনে রয়েছে? যৌনপল্লির পেছনে নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি যারা রয়েছেন তারা মাসোয়ারা নেন। কম বয়সীদের আনলে কী হবে, সে বিষয়ে সচেতন করতে হবে।’

আরও পড়ুন

যৌনপল্লির শিশুদের মানবাধিকার নিয়ে কথা হয় মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) চিফ এক্সিকিউটিভ ও সিনিয়র আইনজীবী সাইদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিশুদের যৌন পেশায় নিয়োজিত এবং তাদের দিয়ে মাদক পাচার দণ্ডনীয় অপরাধ। আইনগতভাবে আমাদের দেশে ১৮ বছরের নিচে কোনো শিশুকে এ ধরনের কাজে যুক্ত করার ক্ষেত্রে আইনি বাধা আছে, যৌনকর্ম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ১৮ এর নিচের শিশুদের স্বেচ্ছায় হলেও তা ধর্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হবে। সুতরাং ধর্ষণ ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে অপরাধী।’

সাইদুর রহমান বলেন, ‘এসব অপরাধে যারা নিয়োজিত, তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। স্বার্থান্বেষী চক্রের অর্থের লোভে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বয়স বেশি দেখিয়ে যা করছে, তা ঠিক নয়। এ বিষয়ে আইনের আশ্রয় চাইলে আমরা তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।’

শিশুদের মাদক পাচারে ব্যবহার ও যৌন পেশায় যুক্ত করা প্রসঙ্গে রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) শরীফ আল রাজীব জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা জেলার থানাসহ বিভিন্ন ইউনিটে নতুন সেটআপ এনেছি। শিশুদের যৌন পেশায় সহযোগিতা বা তাদের দিয়ে মাদক পাচারের কোনো তথ্য পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশের কেউ জড়িত হলে আইনগত ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। প্রতিদিনই গ্রেফতার, মাদক উদ্ধার হচ্ছে। এ বিষয়ে পুলিশ তৎপর।’

চতুর্থ ও শেষ পর্ব পড়ুন: রঙিন জীবনের করুণ সমাপ্তি

ইএআর/এমএমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।