তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়ন হয়নি

জুলাই সনদের ভাগ্যে কী আছে?

মোস্তফা হোসেইন
মোস্তফা হোসেইন মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশিত: ০৯:৫৬ এএম, ১১ আগস্ট ২০২৫

মত-ভিন্নমত আশঙ্কা-আশাবাদ সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে জুলাই সনদ প্রণয়ন হয়েছে। যদিও নোট অব ডিসেন্টকেও সঙ্গে নিতে হচ্ছে জুলাই সনদকে। এবার চলছে বাস্তবায়ন বিষয়ে আলোচনা। এখানেও মুখোমুখি রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান। ধর্মভিত্তিক কিছু দল এবং এনসিপির সঙ্গে জাতীয়তাবাদী দলের ফারাকটা একটু বেশিই বলতে হবে এবারও। বিএনপি বরাবরই বলে আসছে নির্বাচিত সংসদই হবে ক্ষমতাধর। সংবিধান সংশোধন,সনদ বাস্তবায়ন এর কাজটি করবে নির্বাচিত সংসদ। এখানে ধর্মভিত্তিক কিছু দল এবং এনসিপির সঙ্গে বিএনপির শতভাগ বিপরীত অবস্থানে।জুলাই সনদ এবং এর বাস্তবায়ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীত অবস্থানকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন ধরেই টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।পরিস্থিতির জটিলতা সম্পর্কেও সংশ্লিষ্টরা সচেতন।অন্তত প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম যখন বলেন আগামী কয়েকদিন রাজনীতির জন্য ক্রুশিয়েল টাইম তখনই এর গুরুত্ব সম্পর্কে অনুমান করা যায়।

যে মুহূর্তে জুলাই সনদ স্বীকৃতি পাওয়ার পথে, ঠিক ওই সময় সরকারের একজন উপদেষ্টা ও জুলাই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে যিনি খ্যাতি পেয়েছেন-৪ আগস্ট ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন-১/১১ এর পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে বলে। ফেসবুকে তার এই স্ট্যাটাসটি সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমে প্রচার পায়।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আলোচনা সমালোচনা চলতে থাকে।একটা আশঙ্কা তৈরি হয়,তাহলে এত ত্যাগ,এত শ্রমদানের কোনো মূল্যই কি থাকছে না? তিনি সরকারের প্রভাবশালী একজন উপদেষ্টা।কথিত আছে এনসিপিকেও নাকি তিনি নেপথ্য থেকে পরিচালনা করেন। যেমনি জুলাই আন্দোলনের চালিকাশক্তিও ছিলেন তিনি।সুতরাং বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে তাঁর এই আশঙ্কা আমাদেরকে যথেষ্টা নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দেয়।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের আশঙ্কাজনক বক্তব্য, একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টার ফেসবুক স্ট্যাটাস সবই আমাদের জানতে হয়েছে, যখন পুরো জাতি অপেক্ষা করছিল জুলাই ঘোষণাপত্র সম্পর্কে জানার জন্য। সেই সুযোগটিও এসে যায়।আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের বর্ষপূর্তি দিবসে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।২০২৪ সালে কোটা বিরোধী আন্দোলন ছিল সুস্পষ্ট দাবি ও ঘোষণা সম্বলিত। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই আন্দোলন যখন অভ্যুত্থানে রূপ নেয় তখন এর লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটানো। এবং সেটা সফলও হয়েছে। তখনই কিছু বিষয় জনসমক্ষে আসার কথা ছিলো কিন্তু তা জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হলো এক বছর পর,২০২৫ এর ৫ আগস্ট। এই দীর্ঘসময় মানুষ অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র বিষয়ে অন্ধকারেই ছিল। অনেকেরই জিজ্ঞাসা তাহলে এই ঘোষণাপত্র কি অভ্যুত্থানের নাকি অন্যকিছু?

অভ্যুত্থানের অন্যতম অংশীদার জামায়াতে ইসলামী এই ঘোষণাপত্র বিষয়ে মত ব্যক্ত করেছে- ‘হতাশ’ এই শব্দ প্রয়োগে।এবি পার্টির মন্তব্য মনে হয়েছে, তারা এটাকে মন্দের ভালো হিসেবে মনে করেছে। ইসলামী আন্দোলন,গণঅধিকার পরিষদ, খেলাফত মজলিশ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ঘোষণাপত্র প্রকাশের পর।তবে বিএনপি স্বাগত জানিয়েছে। অন্যরাও যাতে স্বাগত জানায়,সম্ভবত সেই আবেদনই মনে হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মুখ থেকে। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মুখ দেখাদেখি যেন বন্ধ না হয়।

ঘোষণাপত্র প্রকাশের রাতেও বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।অবশ্য পরদিন তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানিয়েছে।আবার ঘোষণাপত্রের কিছু বিষয় নিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব দলই যে একমত নয় তা আগেই বোঝা গিয়েছিল। ঘোষণাপত্র বিষয়ে নিবন্ধ লেখার সময় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এর কথা হয় নিবন্ধকারের-তাঁর বক্তব্য নিস্পৃহ। সিপিবিসহ বাম রাজনৈতিক দলগুলোকে ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি কেন,প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন এরমধ্যে আমরা নেই।বাম জোটের অন্যদলগুলোরও একই অবস্থান বলে জানা গেলো তাঁর কাছ থেকে।

যে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই ধর্মগ্রন্থ নয় যে তা পরিবর্তন হবে না। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে এই ঘোষণাপত্রটির ভাগ্যও পরিবর্তন হয় কি না তা ভবিতব্য। তবে মানুষের চাওয়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কোনো উছিলায় যেন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি না হয় সেদিকে সবারই দৃষ্টি রাখা উচিত।

ঘোষণাপত্রে দুটি দলের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন দেখা গেছে বলে অনেকে মন্তব্য করেন,যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের  অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ  বলেন, ‘বিএনপি ও এনসিপির বিষয়টি যেভাবে এসেছে অন্যান্য শক্তিগুলোর ভূমিকা সেভাবে আসেনি।’ “এই ঘোষণাপত্র যদি ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর জন্মসনদ হয়,তাহলে তাতে সব পক্ষের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা দরকার ছিল। গ্রহণ-বর্জনের রাজনীতি দিয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়,” মনে করেন ড.সাব্বির।(জাগো নিউজ ৬ আগস্ট,২০২৫)।তিনি ঘোষণাপত্রে সবার কথা নেই উল্লেখ করেছেন,তাঁর কথার প্রতিফলন দেখা যায় কিছু দলের ঘোষণাপত্রপাঠ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিতিতে।

মুক্তিযুদ্ধকে যারা সর্বোচ্চে স্থান দিতে চায়, তারা কিছুটা হতাশই হয়েছে ঘোষণাপত্র পড়ে এবং শুনে। ঘোষণায় ১৯৪৭ সালের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে বলা হয়েছে,যা নিয়ে ইতিপূর্বে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।তবে সভা-সমাবেশে এনসিপি যেভাবে ১৯৭১কে ১৯৪৭ এর ধারাবাহিকতা বলে সরাসরি প্রকাশ করেছে,ঘোষণাপত্রে ঠিক ওইভাবে প্রকাশ হয়নি।শব্দের মারপ্যাঁচ দিয়ে তার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।যারা ১৯৭১কে ১৯৪৭ এর ধারাবাহিকতা বলে মনে করেন না তাদের যুক্তি হচ্ছে পাকিস্তানের দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধেই ছিল মুক্তিযুদ্ধ,সেখানে ১৯৪৭ এর ধারাবাহিকতা ১৯৭১ হয় কি করে?

তথ্যগত কিছু বিষয় নিয়েও কথা হতে পারে। ঘোষণাপত্রে উল্লেখ আছে-‘আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে বাকশালের নামে সাংবিধানিকভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে এবং মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করে,যার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশে সিপাহি জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব সংগঠিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতির পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রবর্তনের পথ সুগম হয়’।

৭ নভেম্বর আদৌ জনতার বিপ্লব ছিল কি না এ নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। ৭ নভেম্বর বাকশাল থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করা হয়নি। সেটা ছিল উর্দি বনাম উর্দির লড়াই। এক উর্দি জিতেছে আরেক উর্দির জীবন গেছে। আর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর যখন খোন্দকার মুশতাক ক্ষমতায় ছিল তখন কি বাকশাল ছিল? কিংবা ৭ই নভেম্বরও কী বাকশাল ছিল? তাইলে বাকশাল পদ্ধতির পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় কি করে? তবে এই বক্তব্য বিএনপি নিজে প্রচার করে। তাদের দলীয় সুবিধার্থে। তাহলে বিএনপির এই ন্যারেটিভকে গ্রহণ করার পেছনে যুক্তি কী  থাকতে পারে? প্রাসঙ্গিকভাবে বিতর্ক এখানে তৈরি হওয়ার সুযোগ থেকে যাচ্ছে।

ব্যাপকভাবে সমালোচিত বাকশাল পদ্ধতি গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এটা স্বীকার্য। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন কী গণতান্ত্রিক ছিল? এখানে এরশাদের সামরিক শাসনকে উল্লেখ করে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়া কি নিরপেক্ষতার সাক্ষ্য দেয়? বিভিন্ন সময় এরশাদের সামরিক শাসনব্যবস্থাকে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনেরই ধারাবাহিকতা বলা হয়। এমনও বলা হয় জিয়াউর রহমানের পথ ধরেই এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। সেখানে একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটাকে গুরুত্বসহ প্রকাশের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে।

আগামী সংসদের ওপর সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব অর্পণকে এনসিপি ও বিএনপি মেনে নেয়ায় ঘোষণাপত্র বিষয়ে জটিলতার আশঙ্কা রইল না। যদিও জামায়াতে ইসলামী বিষয়টিকে সমালোচনা করেছে।তাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী তা হয়নি এটাও তাদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে। জামায়াতে ইসলামীর মতো এবি পার্টিও একই মত পোষণ করে।তারা সন্দেহ করে সংস্কার প্রস্তাবগুলো পরবর্তী সংসদে অনুমোদন নাও হতে পারে। অবশ্য তাদের এমন আশঙ্কার পেছনে যুক্তিও আছে।নব্বুইয়ের গণ-আন্দোলনে তিনদলীয় জোটের যে চুক্তি হয়েছিল সেই চুক্তি পরবর্তীকালে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ কেউই বাস্তবায়ন করেনি। যদিও ত্রিদলীয় চুক্তির প্রধান অংশই ছিল এই দুটি দল।

অন্যদিকে সাম্প্রতিক রাজনীতির ভাবগতি দেখে মনে হতেই পারে, নির্বাচন হলে বিএনপিই আগামী সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। রাজনৈতিক মাঠে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় সেই সুযোগ তৈরি হয়েছে। যে কারণে বিএনপির চাওয়া হচ্ছে, যে কোনো ছাড় দিয়ে হলেও একটা নির্বাচন হতে হবে। তাই বিএনপির সম্মতিকে অনেকেই কৌশল হিসেবে মনে করতে পারে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বিষয়েও একটা ইঙ্গিত এখানে স্পষ্ট হয়ে যায়। এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো কিছু দলের চাওয়া অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমলে দৃশ্যমান বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা থাকছে না। তারপরও যে কোনো কাজেই পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকবেই। আর যে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই ধর্মগ্রন্থ নয় যে তা পরিবর্তন হবে না। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে এই ঘোষণাপত্রটির ভাগ্যও পরিবর্তন হয় কি না তা ভবিতব্য। তবে মানুষের চাওয়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কোনো উছিলায় যেন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি না হয় সেদিকে সবারই দৃষ্টি রাখা উচিত।

লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।