মহানবির সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির শিক্ষা

মাহমুদ আহমদ
মাহমুদ আহমদ মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:০৫ এএম, ১৪ নভেম্বর ২০২৫

বিশ্বাসের স্বাধীনতা হচ্ছে সব মানুষের মৌলিক অধিকার। ইসলাম ধর্মের বিধান মতে ‘ধর্ম’ হচ্ছে নিজ, পছন্দের একটি বিষয়। এ ধর্ম একটি সুস্পষ্ট ধর্ম। এই ধর্ম গ্রহণের পরেও চাইলে কেউ এটা ত্যাগ করতে পারে, কোনো জোর নেই, তবে এর বিচার সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজ হাতেই করেন।

ধর্মে যদি বল প্রয়োগের বিধান থাকতো, তাহলে বিশ্বনবি ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের পর অমুসলমানদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য বাধ্য করতেন এবং মক্কায় বসবাসের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নাই। এতে প্রমাণিত হয়, ধর্মের জন্য বলপ্রয়োগ ইসলাম ও মহানবির শিক্ষা নয়।

ইসলামের আদর্শ হলো শত্রুর সাথেও বন্ধুসুলভ আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা আর প্রতিটি ধর্মই শান্তি আর সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর পরিবারভুক্ত। আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় হচ্ছে ওই সৃষ্টি, যে আল্লাহর অপরাপর সৃষ্টিকুলের প্রতি অনুগ্রহ করে।’ (বায়হাকি)

আমরা বরাবরই লক্ষ্য করে আসছি, একটি মহল বরাবরই শান্তিময় সমাজকে অশান্ত করে তোলার কাজে ব্যস্ত থাকে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে তারা থাকে সদা তৎপর। অথচ প্রত্যেক ধর্মের মূল মর্মবাণী হলো-শান্তি ও মানুষের কল্যাণ কামনা।

ধর্ম মানুষকে সম্প্রীতি ও পরমত সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সব বিশ্বাসী মানুষ এক দেহসম; দেহের যে-কোনো জায়গায় ব্যথা পেলে চোখে পানি আসে, সারা শরীরে জ্বর আসে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

ধর্মকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা-হাঙ্গামার দৃষ্টান্ত বিশ্বে বহু রয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল ও সুযোগসন্ধানী একটি চক্র বরাবরই পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা চালায়। যা কখনই কাম্য নয়। কেননা ইসলাম এমন এক শান্তিপ্রিয় ধর্ম যেখানে সব ধর্মের অনুসারীদের সম্মানের শিক্ষা দেয়। প্রেম-প্রীতি, সৌহার্দ্য আর শান্তি ও সম্প্রীতির এক পরিমণ্ডল বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। অন্য কথায়, আল্লাহতায়ালার প্রতি বিশ্বস্ততার হক আদায়ে এবং তার সৃষ্টির প্রতি দায়বদ্ধ আচরণের মাধ্যমে এ বিশ্ব এক স্বর্গ রাজ্যে পরিণত করা।

ধর্মীয় বিষয়ে একে অপরের সাথে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। তাই বলে গায়ের জোরে প্রমাণ করবো আমিই শ্রেষ্ঠ। অবশ্যই না। কেননা, প্রকৃত ইসলামের আকর্ষণীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসার জোর-জবরদস্তি এবং বল প্রয়োগে নয়, বরং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির দ্বারা মানুষের হৃদয় জয় করার মাধ্যমে সম্ভব। বল প্রয়োগ করলে অন্যের অধিকার যেমন : দেওয়া যায় না, তেমনি আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভও এর দ্বারা সম্ভব নয়।

ইসলামে মুসলমান ও অমুসলমানের সম-অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ইসলাম শত্রুদের সাথেও দয়ার্দ্র আচরণ করে, তা শান্তিকালীন সময়েই হোক বা যুদ্ধাবস্থায়ই হোক। সর্বাবস্থায় ইসলাম অমুসলমানদের অধিকার মর্যাদার সাথে সংরক্ষণ করে।

বিদ্বেষ ছড়ানো ও আক্রমণের অধিকার ইসলামে নেই। বিনা কারণে কারো ওপর চড়াও হওয়া বা আক্রমণ করার অধিকার ইসলামে নেই। ইসলামের বাস্তব শিক্ষা হলো, কেবল আক্রান্ত হলেই তুমি যুদ্ধ করতে পার। অধিকন্তু, ইসলামে এ নির্দেশও রয়েছে যে, আক্রমণকারী বা আগ্রাসী হয়ো না, চুক্তি ভঙ্গকারী হয়ো না। আগ্রাসন বলতে কী বোঝায়? সে যুগে ইসলাম বিরোধীরা পরাজিত সৈন্যদের দেহ ছিন্নভিন্ন করে বিকৃত করতো, এটা সমর নীতির পরিপন্থি, জিঘাংসামূলক অত্যন্ত গর্হিত এক কর্ম। ইসলামে এটি নিষিদ্ধ। শিশু ও নারীদের হত্যা করাও নিষিদ্ধ।

এছাড়া কোনো ফলবান বৃক্ষ নষ্ট না করার শিক্ষাও ইসলাম প্রদান করেছে এবং ধর্মীয় নেতাদের, পাদরি-পুরোহিত, রাব্বী, প্রমুখদেরকেও তাদের উপাসনালয়ে হত্যা করা সম্পূর্ণ অবৈধ করা হয়েছে। অন্য কথায়, যুদ্ধ কেবল মাত্র সমরক্ষেত্রেই সংঘটিত হতে পারে। অথবা অন্য কোনো বিকল্প খুঁজে না পেয়ে যদি শহর বা নগরে যুদ্ধ করতে বাধ্যও হতে হয়, তবুও কেবল তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করা যেতে পারে, যারা বিরোধিতায় আগ বাড়িয়ে অস্ত্র ধারণ করে আক্রমণ চালিয়েছে।

আমরা আজ এটাই দেখছি যে, সুন্দর, সাবলীল ও সুগঠিত এই সব ইসলামি শিক্ষার ওপর অধিকাংশ মানুষ আমল করছে না। বিভিন্ন স্থানে নৈরাজ্যকারীরা ধর্মের নামে শিশু, নারী, বৃদ্ধ, নিরীহ মানুষ হত্যা করতেও পিছপা হচ্ছে না।

ইসলামে যে সম্প্রীতির শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তাতে সাদাকালো, ধনী-গরিবের মাঝে কোনো ভেদাভেদ করেনি। একমাত্র সম্মান ও মর্যাদার ভিত্তি তাকওয়া বা আল্লাহভীতি।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ তোমাদের জাহেলি যুগের মিথ্যা অহংকার ও পূর্বপুরুষদের নিয়ে গর্ব করার প্রথাকে বিলুপ্ত করেছেন। মুমিন হলো : আল্লাহভীরু, আর পাপী হলো দুর্ভাগা। তোমরা সবাই আদমসন্তান আর আদম (আ.) মাটির তৈরি। মানুষের উচিত বিশেষ গোত্রভুক্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে অহংকার না করা।’ (সুনানে আবু দাউদ)

বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করার পর যে মদিনা-সনদ প্রণয়ন করেন, তা বিশ্ব ইতিহাসের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান এবং শান্তি-সম্প্রীতির ঐতিহাসিক দলিল। এই সনদে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য ধারা সন্নিবেশিত রয়েছে। যেমন, সনদে স্বাক্ষরকারী সব গোত্র-সম্প্রদায় মদিনা রাষ্ট্রে সমান অধিকার ভোগ করবে, সব ধর্ম সম্প্রদায়ের স্ব-স্ব ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে; কেউ কারও ওপর কোনোরূপ আক্রমণ করবে না, সন্ধিভুক্ত কোনো সম্প্রদায় বহিঃ শক্র কর্তৃক আক্রান্ত হলে উক্ত আক্রান্ত সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে, কোনো নাগরিক কোনো অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। (সিরাতে ইবনে হিশাম)

আজ আমরা অনেক ক্ষেত্রে মহানবির অতুলনীয় এই সম্প্রীতির শিক্ষা ভুলে ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছি। মহানবির (সা.) মৃত্যুর অল্পদিন আগে বিদায় হজের সময় বিরাট ইসলামি সমাগমকে সম্বোধন করে তিনি (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনোমতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করলো। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ।’ (বায়হাকি)

এই মহান শব্দগুলো ইসলামের উচ্চতম আদর্শ ও শ্রেষ্ঠতম নীতিমালার একটি দিক উজ্জ্বলভাবে চিত্রায়িত করেছে। শতধা বিভক্ত একটি সমাজকে অত্যাধুনিক গণতন্ত্রের সমতাভিত্তিক সমাজে ঐক্যবদ্ধ করার কী অসাধারণ উদাত্ত আহ্বান।

অমুসলিমদের জান-মাল-ইজ্জত সংরক্ষণের ব্যাপারে হজরত রাসুল করিম (সা.) কঠোর সতর্কবাণী দিয়ে বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের দূরত্বে থেকেও জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।’ (বুখারি)

আমার ধর্মের সাথে, আমার মতের সাথে, আমার ইবাদতের পদ্ধতির সাথে আরেকজন একমত নাও হতে পারেন, তাই বলে কি তার বিরুদ্ধে আমাকে অবস্থান নিতে হবে? অবশ্যই না। কে ভালো আর কে মন্দ তার ফয়সালা করবেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।

ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো ধর্মীয় ফেরকা বা সম্প্রদায়কে পছন্দ নাও করতে পারি, তাই বলে এ নিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলার কোনো অনুমতি ইসলাম ও আমার প্রিয় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে দেয়নি। যেভাবে মহানবি (সা.) ঐতিহাসিক মদিনা সনদের মাধ্যমে ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ-কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির স্থাপন করেছেন ঠিক তেমনি তার উম্মত হিসেবে আমাদেরকেও সেই আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

সম্প্রীতির এই দেশে যদি কেউ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের প্রতিহত করতে হবে। আমরা কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেবো না। আমাদের এদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। হাজার বছরের এই ঐতিহ্যকে কোনোভাবেই নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। এছাড়া আমাদের সংবিধান দেশের সব নাগরিককে স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম পালনের অধিকার প্রদান করেছে।

তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই আমরা সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ থেকে দেশের উন্নয়নে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবো, এটাই হোক সবার অঙ্গীকার।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
[email protected]

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।