প্রশ্ন যদি হবেই ফাঁস, পড়বো কেন ১২ মাস?

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ১০:০১ এএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো কি অসম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। দেখেশুনে মনে হচ্ছে অসম্ভব। কারণ প্রশ্নপত্র ফাঁস যেন এখন ডালভাত হয়ে গেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষায় অন্তত ৮০ বার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। আর শুধু পাবলিক পরীক্ষা নয়, বাংলাদেশে এখন প্রায় সব পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা, চাকরির পরীক্ষা, এমনকি প্রাইমারি স্কুলে প্রথম শ্রেণির পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের খবরও পত্রিকায় এসেছে।

এবারের চলমান এসএসসি পরীক্ষায় বোধহয় প্রশ্ন ফাঁসের রেকর্ড হয়েছে। এখন পর্যন্ত হওয়া সবগুলো পরীক্ষার প্রশ্নই ফাঁস হয়ে গেছে। তার মানে বাংলাদেশে এখন বইখোলা পরীক্ষা নেয়ার সময় চলে এসেছে। শুরুতে অস্বীকার করলেও প্রশ্ন ফাঁস এখন শিক্ষামন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের গলার ফাঁস হয়ে চেপে বসেছে।

অনেকরকম উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। প্রশ্ন ফাঁস হয়েই যাচ্ছে। সব দেখেশুনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যেন হাল ছেড়ে দিয়েছে। মন্ত্রী এবং সচিব- সবার কণ্ঠেই হাল ছেড়ে দেয়ার সুর। সবাই অসহায় আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন। ভাবটা এমন, যা হয় হোক, আমাদের আর কিছু করার নেই। এক প্রশ্ন ফাঁসের ব্যর্থতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সব সাফল্য চাপা পড়ে গেছে।

এবার এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে মন্ত্রণালয় অনেক সিরিয়াস ছিল। পরীক্ষা শুরুর আগেই কোচিং সেন্টার বন্ধ, কেন্দ্রে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, এমনকি কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে কারো হাতে মোবাইল পেলে তাকে গ্রেপ্তার করা, প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরিয়ে দিলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণাও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।

প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে এমনকি ইন্টারনেট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও হয়েছিল, যদিও পরে তা আর কার্যকর হয়নি। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে পুলিশও কিছু এলোমেলো ধরপাকড় করেছে। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি হাইকোর্টে গেছে। রিট হয়েছে, হাইকোর্ট রুল দিয়েছেন। হাইকোর্টের নির্দেশে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এই সব করতে করতে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হচ্ছে না।

ছেলেবেলায় কাজের সংজ্ঞায় পড়েছিলাম, সারাদিন যদি কেউ একটি পাথর ঠেলে, কিন্তু একটুও সরাতে না পারে; তবে সেটা কাজ হিসেবে গণ্য হবে না। প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সকল উদ্যোগ, সকল চেষ্টাও শেষ পর্যন্ত সেই সংজ্ঞায় অকাজ হয়ে যায়।

প্রশ্ন ফাঁস যদি বন্ধ না হয়, আপনার সকল চেষ্টাই আসলে অর্থহীন। ব্যাপারটা এখন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। প্রশ্ন ফাঁস চক্র যেন সরকারের সাথে চোর-পুলিশ খেলছে। রীতিমত ঘোষণা দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস করা হচ্ছে। এখন আর অর্থনৈতিক লাভের জন্য কেউ প্রশ্ন ফাঁস করে বলে মনে হয় না। প্রশ্ন ফাঁস এখন কারো কারো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। ব্যাপারটা এখন সরকারকে বিব্রত করার জন্যই করা হচ্ছে বলে মনে হয়।

আবারও মূল প্রশ্নে ফিরে আসি, প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো কি আসলেই অসম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায়। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আরেকটা প্রশ্ন, প্রশ্ন ফাঁস কারা করে, কেন করে? পুলিশের তৎপরতায় মনে হচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁস করে শিক্ষার্থীরা। পুলিশ যাদের ধরছে, বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। কিন্তু প্রশ্ন তো নিশ্চয়ই এসএসসি পরীক্ষার্থীরা ফাঁস করছে না। আমি শিক্ষার্থীদের কোনো দোষ দিতে চাই না। প্রশ্ন ফাঁসের প্রক্রিয়ায় নিশ্চয়ই অনেকগুলো ধাপ আছে। শিক্ষার্থীরা আছেন শেষ ধাপে। শিক্ষার্থীরা যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা শিক্ষামন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, প্রশ্ন যদি হবেই ফাঁস, পড়বো কেন বারো মাস? কী উত্তর দেবেন তারা।

প্রশ্ন ফাঁসের জন্য শিক্ষামন্ত্রী একাধিকবার শিক্ষকদের দুষেছেন। অনেকে দায় চাপাচ্ছেন অভিভাবকদের ঘাড়ে। তারাই তো ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিনে সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন। শিক্ষকরা কিভাবে প্রশ্ন ফাঁসের মত অনৈতিক কাজে জড়ান! বা অভিভাবকরা কিভাবে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সন্তানের হাতে তুলে দেন!

এসব নৈতিক প্রশ্ন তুলে আমরা বিস্মিত হওয়ার ভাণ করি বটে। কিন্তু আমরাও জানি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনৈতিকতার শেকড় এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে, শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক কাউকে সেখান থেকে আলাদা করা কঠিন। তাই নীতিকথায় কাজ হবে না। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে চাই কঠোর আইনী ব্যবস্থা। এখানেই লুকিয়ে আছে, প্রশ্ন ফাঁস রহস্যের সমাধান।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর আন্তরিক চেষ্টাই পারে এ সমস্যার সমাধান করতে। এখানে মিষ্টি কথায় কাজ হবে না। মিথ্যা বলা মহাপাপ, এটা জেনেও তো অনেকে মিথ্যা বলেন। কিন্তু মিথ্যা বললে পুলিশ ধরবে, এটা জানলে অনেকে সাবধান হবেন। প্রশ্ন ফাঁস করলে হাবিয়া দোযখে যাবেন, এটা বলে কোনো লাভ নেই। প্রশ্ন ফাঁস করলে পুলিশ ধরবে, এটা জানলেই শুধু সাবধান হবে মানুষ। তাই র‌্যাব-পুলিশের কঠোর ও আন্তরিক উদ্যোগই কেবল পারে, প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করতে। এখন যেভাবে পুলিশ এলোমেলো অভিযান চালাচ্ছে, সবচেয়ে সহজ শিকার হিসেবে শিক্ষার্থীদের ধরছে, তাতে কোনো কাজ হবে না।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। কয়েকবছর আগে এক মধ্যরাতে রাজধানীর জনকণ্ঠ ভবনের সামনে গাড়ি থেকে ছোঁড়া গুলিতে এক সিএনজিচালক ও এক রিকশাচালক আহত হন, পরে তারা হাসপাতালে মারা যান। এ ঘটনা নিয়ে কোনো তোলপাড় হয়নি। দুয়েকটি পত্রিকায় ভেতরের পাতায় ছাপা হয়েছে খবরটি। দুজনই যেহেতু নিন্মবিত্ত, তাই সবাই ভুলে যায়। কিন্তু পুলিশ ভোলেনি।

জনকণ্ঠ অফিসের সিসিটিভির ফুটেজ দেখে প্রথমে গাড়ির রঙ, পরে নাম্বার, সেই সূত্রে বেড়িয়ে আসে এক এমপিপুত্র মাতাল অবস্থায় যানজটে বিরক্ত হয়ে গুলি করেছিলেন। পুলিশ তাকে ধরেছে। এখনও সেই এমপিপুত্র কারাগারে আছে। তাই কোনো রাজনৈতিক চাপ এবং নির্দেশনা থাকলে পুলিশ যে কোনো জটিল রহস্যও উন্মোচন করতে পারে।

বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ মোকাবেলায়ও র‌্যাব-পুলিশের ভূমিকা প্রশংসিত। তাই পুলিশকে সত্যিকার অর্থেই ‘জিরো টলারেন্স’ নিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে মাঠে নামার নির্দেশনা দিতে হবে। আপনি ফেসবুকে বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবমাননাকর কিছু লিখে দেখেন। পুলিশ এসে ক্যাক করে আপনাকে ধরে নিয়ে যাবে। সেই পুলিশ ফেসবুকে রীতিমত হাট বসিয়ে প্রশ্নপত্র বিক্রির উদ্যোক্তাদের ধরতে পারছে না, এটা অবিশ্বাস্য।

আসলে নির্বাচনকে সামনে রেখে পুলিশ ব্যস্ত বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ে। তাদের প্রায়োরিটি প্রশ্ন ফাঁস নয়, ধরপাকড়। নীতিনির্ধারকরা হয়তো ভাবছেন, এবারের পরীক্ষা তো প্রায় শেষ। পরেরবার দেখা যাবে। কিন্তু এই প্রশ্ন ফাঁসের বিষ যে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে, তা নিয়ে তাদের ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।

প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো কঠিন তবে অসম্ভব নয়। আমি এখনও বিশ্বাস করি, সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আন্তরিক উদ্যোগই পারে এই ভয়াবহ বিষ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে। নইলে ভবিষ্যত অন্ধকার। কারণ শিক্ষাই যে জাতির ভবিষ্যত।

inner

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।