টেলিফোনে ফিসফিস
বাংলা ব্যান্ড দল ফিডব্যাকের শিল্পী মাকসুদের গাওয়া একটি গান একসময় বেশ জনপ্রিয় হয় এবং কৈশোরে সেই গানটি আমরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কিংবা কলেজের বাসে গাইতাম। গানটির শিরোনাম ‘টেলিফোনে ফিসফিস’। দুটি লাইন এরকম: ‘টেলিফোনে যখন ফিসফিস করে কথা হয় দুজনায়, মন্দ লোকে যদি আড়ি পেতে শুনে ফেলে বলো কী উপায়।’…দেখা যাচ্ছে এখন আড়ি পেতে টেলিফোনের ওই কথাবার্তা শুনে তা প্রচার করে দেয়া হচ্ছে।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত টেলিফোনে কথোপকথন ফাঁসের ঘটনাটি ঘটে ২০১৩ সালে। ওই বছরের ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় দেশের দুই শীর্ষ নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যকার দীর্ঘ টেলিফোন আলাপটি ফাঁস হয় বা ফাঁস করা হয়। ৩৭ মিনিটের ওই কথোপকথনের অধিকাংশ সময়জুড়েই তারা বিভিন্ন বিষয়ে পরস্পরকে দোষারোপ করেন। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ করেন।
কারা ওই টেলিফোন আলাপ টেলিভিশনে প্রচার এবং সংবাদপত্রে প্রকাশ করেছিলেন তা হয়তো কোনোদিনই জানা যাবে না। তবে এতে দেশের রাজনীতির যে চেহারাটি প্রকাশিত হয়েছিল, তা খুব সুখকর নয়। এরপর আলোচনায় আসে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা এবং বর্তমানে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এবং বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার মধ্যকার টেলিফোন আলাপ ফাঁস—যে কথোপকথনের খেসারত হিসেবে মান্নাকে দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়েছে। সম্প্রতি সেই মান্নার সাথেই বিকল্পধারা বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাহি বি. চৌধুরীর একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। ওই আলাকে কে হিরো আর কে জিরো হয়েছেন, তা নিয়ে বিতর্ক না করাই ভালো।
এরপর খুব সম্প্রতি ফাঁস হয় আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি এবং এবারের নির্বাচনে পটুয়াখালী ৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী গোলাম মাওলা রনির একটি ফোনালাপ যেখানে তিনি তার স্ত্রীর গাড়িতে হামলার পর পুলিশ মামলা না নেয়ায় নেতাকর্মীদের থানা ঘেরাওয়ের নির্দেশ দেন। বিষয়টি মি. রনি নিজে স্বীকারও করেন।
তবে এসব টেলিফোনালাপ ছাপিয়ে যায় বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সাথে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর একজন কথিত এজেন্টের ফোনালাপ। কথিত বলছি এ কারণে যে, খন্দকার মোশাররফ দাবি করেছেন কোনো আইএআইএ এজেন্টের সাথে তিনি টেলিফোনে কথা বলেননি বা বিষয়টি এখনও প্রমাণিতও নয়। যদিও এই ফোনালাপটি ফাঁসের পরে কুমিল্লার দাউদকান্দি থানায় মোশাররফের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ দায়ের করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা ও দাউদকান্দি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সুমন অভিযোগটি দায়ের করেন।
প্রথমে ফেসবুকে এবং পরে টেলিভিশনে প্রচারিত ওই অডিওতে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান ও চীনের সহায়তা চাইতে শোনা যায়। এর আগে বিএনপি নেতা তারেক রহমান ও শমশের মবিন চৌধুরীর ফোনালাপও ফাঁস হয়। শমশের মবিন পরবর্তীতে বিএনপির রাজনীতি ছেড়ে দেন।
দীর্ঘদিন পরে তিনি সাবেক বিএনপি নেতা বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দল বিকল্পধারায় যোগ দেন এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হন। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পাঁচ দিনের মাথায় নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ান। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে সমর্থন দিয়ে তিনি সিলেট-৬ আসনে নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়িয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানান।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীরও একটি ফোনালাপ ফাঁস হয় যেখানে দলবল নিয়ে ওই আন্দোলনে অংশ নিতে তিনি একজনকে নির্দেশ দিচ্ছেন বলে শোনা যায়। আবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর পর বিএনপির সাথে ঐক্যফ্রন্টের আসন ভাগাভাগি নিয়ে জটিলতার বিষয়ে বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদের সাথে বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফের একটি কথোপকথন ফাঁস হয়।
শোনা যায়, সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরই ফোনকল রেকর্ড বা ট্র্যাক হয়। কিন্তু সবারটা ফাঁস হয় না। রাজনীতিবিদরা পরস্পরের সঙ্গে অনেক কথাই ফোনে বলেন। অনেক পরিকল্পনা করেন। তার সবকিছু সবার জানা সম্ভব হয় না। কিন্তু মাঝেমধ্যেই আমরা দেখি বিশেষ বিশেষ ফোনকল ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। এটি কতটা নৈতিক এবং এর আইনি ভিত্তি কতটুকু—তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
অনেক সময় নিজেদের ভেতর থেকেও এসব ফোনালাপ ফাঁস করে দেওয়া হয়। এখন সব স্মার্টফোনেই ভয়েস কল রেকর্ড হয়। সুতরাং যে দুজনের মধ্যে কথা হয়, তাদের একজন অন্যজনকে ছোট বা হেয় করা কিংবা নিজেকে হিরো বানানোর জন্যও কথোপকথন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিতে পারেন। আবার খুব সহজেই যে এসব কথোপকথন নিজের সুবিধামতো এডিট করা যায়—সে কথাও সবার জানা।
সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘আইন অনুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যোগাযোগ ব্যক্তিস্বাধীনতার অংশ। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইনে একটি ধারা আছে যেখানে বলা হয়েছে, তদন্ত বা মামলার স্বার্থে নিরাপত্তা সংস্থাকে সব রকমের তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে টেলিফোন সেবা দাতা সংস্থাগুলো। এই অনুযায়ী ফোনে আড়ি পাতাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্ত সংস্থার মতো সরকারি সংস্থাগুলো বাদে অন্য কেউ কথোপকথন আড়ি পেতে রেকর্ড করলে দুই বছর কারাদণ্ড এবং পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। আইনের ৭১ ধারায় বলা হয়েছে: ‘কোন ব্যক্তি যদি অপর দুই জন ব্যক্তির টেলিফোন আলাপে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়ি পাতেন, তাহা হইলে প্রথমোক্ত ব্যক্তির, এই কাজ হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫ (পাঁচ) কোটি টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন। তবে শর্ত থাকে যে, ধারা ৯৭ক এর অধীন সরকার হইতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোন কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এই ধারার বিধানাবলী প্রযোজ্য হইবে না৷
৯৭ ক ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যে কোন টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর প্রেরিত বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎসম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোন কর্মকর্তাকে ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবে এবং উক্ত কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারীকে নির্দেশ দিতে পারিবে এবং পরিচালনাকারী উক্ত নির্দেশ পালন করিতে বাধ্য থাকিবে।’
তবে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই নয়, অনেক অপরাধী গোষ্ঠীও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফোনে আড়ি পাতে বলে অভিযোগ শোনা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই কাজে স্টিং রে ডিভাইস নামে কিছু যন্ত্র আছে, সেগুলো ব্যবহার করা হয়। আবার ব্যক্তি পর্যায়ে আড়ি পাতার ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন স্পাইং সফ্টওয়্যার ইনস্টল করে দিলে, দূর থেকেও ফোন ট্র্যাক করা, কথোপকথন রেকর্ড করা এমনকি টেক্সট মেসেজ পড়া সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন।
বিবিসির একটি খবরে বলা হয়েছে, বাগিং নামে একটি পদ্ধতি আছে, যাতে মোবাইল ফোনে রিঙ্গিং ফিচারকে ডিজেবল করে দিয়ে মাইক্রোফোনের অ্যাকসেস নেয়া হয়। এর ফলে ওই মোবাইল ফোন দিয়ে যত কথা হবে, যত টেক্সট মেসেজ পাঠানো হবে, সবই অপর পক্ষের কাছে চলে আসবে। তবে আইনে যা কিছুই থাকুক, সবার উপর নীতি-নৈতিকতা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/আরআইপি