বাণিজ্য অবরোধ ও ইরান

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:২১ এএম, ২১ নভেম্বর ২০১৯

ইরানে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে শুরু হওয়া আন্দোলন ধীরে ধীরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে পরিণত হচ্ছে। কয়েক জায়গায় সহিংস বিক্ষোভের খবরও দিয়েছে দেশটির গণমাধ্যমগুলো। ১৮ নভেম্বর টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে বিক্ষোভকারীদের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। তিনি বলেছেন, তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ জনগণ করতেই পারে। কিন্তু সেটি সহিংস আন্দোলনে রূপ নিলে তা কিছুতেই মেনে নেয়া হবে না।

ইরানের এই বিপর্যয়ের কারণ উপর্যুপরি বেকার বৃদ্ধি ও মুদ্রার মানের অবনতি। ইরানের ওপর বহুদিন ধরে কঠিন বাণিজ্য অবরোধ জারি করে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের ‘সর্বোচ্চ মাত্রায়’ নিষেধাজ্ঞার অংশ হিসেবে ইরানের ন্যাশনাল ব্যাংক ও দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। গত বছর ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে ইরানের সই করা পরমাণু চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরপর তেহরানের বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে উদ্ভুত অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয় ইরান সরকার।

ইরানের মতো কঠিন অবরোধ মোকাবিলা করছে উত্তর কোরিয়াও। বাণিজ্য অবরোধ একটি দেশকে ধ্বংসের দ্বারে নিয়ে যায়। বাণিজ্য অবরোধের প্রবর্তক ছিলেন ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। তিনি কখনো বৃটেনের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধিকে ভালো চোখে দেখেননি অথচ শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়েছিল ব্রিটেনে। শিল্পে যন্ত্রযুগের সূচনাতো বৃটেনের হাতে। ফরাসিসহ ইউরোপের প্রতিটি জাতি তাদের শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতি নিয়েছে বৃটেন থেকে। এমনকি নেপোলিয়নের দেশ ফ্রান্সও। তখন নেপোলিয়ন ইউরোপের একচ্ছত্র অধিপতি। রাশিয়ার জার সম্রাট ছাড়া সবাই তাকে ইউরোপের একচ্ছত্র অধিপতি বলে স্বীকার করতেন।

রাশিয়ার সম্রাট জারের মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব করেছিলেন নেপোলিয়ন। নেপোলিয়নের রক্তে কোনো রাজবংশের রক্ত প্রবাহিত নেই এমন অজুহাতে সম্রাট জার তার মেয়েকে নেপোলিয়নের সঙ্গে বিয়ে দেননি। পরবর্তীতে সম্রাট নেপোলিয়ন অস্ট্রেলিয়ার হাবসবুর্গ সম্রাটকে একরকম বাধ্য করে তার মেয়ে মেরি লুইকে বিয়ে করেছিলেন। মেরি লুইর ঘরে নেপোলিয়নের এক ছেলে জন্মগ্রহণ করেছিল। মেরি লুই উদাসীন ধরনের নারী ছিলেন। নেপোলিয়নের প্রতি তার কোনো ভালোবাসা ছিল না। নেপোলিয়নের দুঃসময়ে তিনি তাকে পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন।

অস্ট্রেলিয়ার হাবসবুর্গ আর রাশিয়ার জারের মতো বংশানুক্রমিক রাজবংশ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ছিল নেপোলিয়নের। তিনি ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম নেতা হওয়ার পরও ক্ষমতায় গিয়ে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তার সে আশা পূরণ হয়নি। নেপোলিয়ন বৃটেনের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি দেখে ঈর্ষান্বিত হতেন আর দীর্ঘকালব্যাপী ইংরেজদের সঙ্গে ফরাসিদের বৈরিতা ছিল, যে কারণে উভয়ের মধ্যে বহু যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে। শেষ পরিণতিতে ওয়াটার লু যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে নেপোলিয়ন পরাজিত হয়ে বন্দি হয়েছিলেন। বন্দি অবস্থায় সেন্ট হেলেনা দ্বীপের কারাগারে তার মৃত্যু হয়।

এই নেপোলিয়নই প্রথম বাণিজ্য অবরোধ করেছিলেন বৃটেনের ওপর, যেন ব্রিটেনের কোনো মালামাল ইউরোপের কোনো রাষ্ট্রে ঢুকতে না পারে। ইতিহাসে এটাই মহাদেশীয় অবরোধ নামে খ্যাতি লাভ করেছিল। ব্রিটেনে এই অবরোধের প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপই করেনি কারণ তখন বিশ্বব্যাপী তার সম্রাজ্য ছিল এবং তার সাম্রাজ্যে তার উৎপাদিত মালামাল বিক্রি করলেই তার কলকারখানা সচল থাকত। বরং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কারণ বৃটেনের উত্তম দ্রব্যাদি থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছিল এবং নিয়মিত ব্যবসা না করে ইউরোপীয় বণিকরা চোরাপথে বৃটেনের মালামাল আনার ব্যবস্থা করেছিল। এমনকি রাশিয়া অভিযানের সময় ফরাসি সৈন্যরা যখন বৃটেনের বুটজুতার আবদার সম্রাটের কাছে পেশ করেছিল তখন সম্রাট নেপোলিয়ন চোরাপথে ব্রিটেন থেকে বুটজুতা আনার ব্যবস্থা করেছিলেন। বুটজুতার এত বড় চালান কোথায় যাচ্ছে তা যে বৃটেন জানত না তা নয়, তবে তারা দেখেও না দেখার ভান করে থাকত।

নেপোলিয়ন শেষ পর্যন্ত এই অবরোধ অব্যাহত রাখতে পারেননি। নেপোলিয়নের নৌশক্তি বৃটেনের সমতুল্য ছিল না। মহাদেশীয় অবরোধ সফল করতে হলে সমুদ্র উপকূল পাহারা দেয়ার জন্য যে বিরাট নৌশক্তি প্রয়োজন ছিল নেপোলিয়নের তা ছিল না। সুতরাং অবরোধ টেকানো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সর্বোপরি নেপোলিয়নের কাছে ‘ফ্রান্সের স্বার্থই এবং ফ্রান্সই’ ছিল শেষ কথা। এমন স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষা দিয়ে তো অনেকের সহযোগিতা কামনা করা যায় না। এসব কারণে বৃটেনের বিরুদ্ধে নেপোলিয়নের অবরোধ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল।

আধুনিক যুগেও বাণিজ্যিক অবরোধ স্থাপন করা হচ্ছে আর তা স্থাপন করছে মূলত আমেরিকা। আগেই বলেছি খুব কঠিন অবরোধের এখন সম্মুখীন হয়েছে দুইটি দেশ- উত্তর কোরিয়া এবং ইরান। উত্তর কোরিয়া আণবিক শক্তির অধিকারী দেশ এবং উন্নত শ্রেণির ব্যালিস্টিক মিসাইল তার রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ করেছে জাতিসংঘ ও আমেরিকা। এত কঠোর অবরোধ যে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য করাই তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তার পার্শ্ববর্তী দেশ চীন সীমান্তবর্তী দেশ না হলে উত্তর কোরিয়ার মানুষ না খেয়ে মরত।

চীন-রাশিয়ার সঙ্গে কিছু বাণিজ্যও উত্তর কোরিয়ার রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার মুখ্য রফতানিযোগ্য মালামালের মধ্যে সিমেন্ট তৈরির ক্লিংকার অন্যতম। উত্তর কোরিয়া প্রচুর পরিমাণে ক্লিংকার রয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে তার পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কে আলোচনার জন্য খুবই উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন সিঙ্গাপুরে উনের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন উনের শর্ত ছিল অবরোধ প্রথমেই প্রত্যাহার করতে হবে তারপর বৈঠক। আমেরিকা তাতে সম্মত হয়নি। অনেকটা চীনের প্রেসারে উন ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসতে সম্মত হয়েছিল।

বৈঠকে কোনো সুনির্দিষ্ট চুক্তি হয়নি। শুধু বিশ্ববাসী দেখল যে বৈঠকের পর উন তার একটি ব্যালিস্টিক মিসাইল ছোড়ার স্টেশন ধ্বংস করেছিল। এরপর ভিয়েতনামে পুনরায় ট্রাম্পের সঙ্গে উনের বৈঠক হয়েছে। আর যখন দক্ষিণ কোরিয়া সফরে আসেন তখন উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া সীমান্তে এক শহরে এ বছর ট্রাম্পের সঙ্গে উনের বৈঠক হয়েছে। কোনো বৈঠকই ফলপ্রসূ হয়েছে বলে মনে হয় না।

উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে বাণিজ্যিক অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়নি। উত্তর কোরিয়া এখন পুনরায় তার ব্যালিস্টিক মিসাইল ছোড়ার কাজ আরম্ভ করেছে। উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাকে নিবৃত্ত করা যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব। এবার অবরোধ প্রত্যাহার ছাড়া উন অন্য কোনো কথা শুনবে বলে মনে হয় না। তার পরমাণু অস্ত্র ধ্বংস করতে বললে উন প্রস্তাব করেছিলেন আমি একা কেন ধ্বংস করব, ধ্বংস করলে সবাইকে নিজ নিজ পরমাণু অস্ত্র ধ্বংস করতে হবে।

উন একরোখা প্রকৃতির লোক। তাকে সহজে কাবু করা যাবে না। আমেরিকার উচিত অবরোধের মতো নির্মম অস্ত্র প্রয়োগ থেকে বিরত থাকা কারণ এটি একটি জাতিকে পঙ্গু করে ফেলে। ইরান বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রের পর্যায়ভুক্ত দেশ। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গ্যাস মজুত রয়েছে ইরানের। তেলের খনি রয়েছে তার।

সম্প্রতি ইরানে নতুন করে আবিষ্কৃত এক ডজনের বেশি খনিতে ৩০ বিলিয়ন ব্যারেল তেল পাওয়া গেছে বলে দেশটির জাতীয় তেল কোম্পানি জানিয়েছে। সংস্থাটির প্রধান সাইয়্যেদ সালেহ হেন্দি জানিয়েছেন, এসব মজুত তেলের মধ্যে ৪.৭ বিলিয়ন ব্যারেল তেল নিষ্কাশনযোগ্য। এছাড়া ইরানে ১২৮ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাসের মজুত আবিষ্কৃত হয়েছে বলেও জানান তিনি। গত চার বছরে আবিষ্কৃত এসব খনি থেকে বোঝা যাচ্ছে, ইরানে আরও নতুন গ্যাস ক্ষেত্র পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এসব খনিতে কী পরিমাণ তেল মজুত রয়েছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।

পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাকে পশ্চিমা বিশ্বের বৈরিতার মুখে ফেলেছে এবং সবাই মিলে ইরানের ওপর বাণিজ্যিক অবরোধ প্রযোগ করেছে। পরবর্তীতে জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্য এবং জার্মানি ইরানের সঙ্গে সমঝোতা স্থাপন করে ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ থেকে বিরত করে এবং ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়। জাতিসংঘসহ পাঁচ স্থায়ী সদস্য, ইরান এবং জার্মানি এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং ইরানের ওপর থেকে বাণিজ্যিক অবরোধ প্রত্যাহার করে।

২০১৭ সালে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই চুক্তি থেকে আমেরিকা তার নাম প্রত্যাহার করে নেয় এবং পুনরায় বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করে। তার ইউরোপীয় মিত্রদেরকে ইরানের ওপর অবরোধ আহ্বান জানায় কিন্তু তারা আমেরিকার পথ অনুসরণ করেনি। বরং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ দৈন্যদশা অনুধাবন করে ইরানকে দেড় হাজার কোটি ডলার অনুদান দিয়েছেন।

আমি বড় বড় তিনটি বাণিজ্যিক অবরোধের কথা আলোচনা করলাম। বাণিজ্যিক অবরোধ দিয়েও বিনাযুদ্ধে একটা রাষ্ট্রকে কাবু করা যায়। অবশ্য বড় রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে বাণিজ্যিক অবরোধ অনেক সময় কার্যকর করা সম্ভব হয় না। ক্রিমিয়া নেয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার ওপর দীর্ঘ সময়ব্যাপী বাণিজ্যিক অবরোধ দিয়ে রেখেছে কিন্তু রাশিয়া তার কোনো ভ্রূক্ষেপ করছে না। ইরান হয়তো চলমান বিক্ষোভ দমন করতে সক্ষম হবে কিন্তু তার ওপর আরোপিত বাণিজ্য অবরোধের দুর্দশা থেকে কবে মুক্তি যাবে কেউ জানে না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/বিএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।