ত্রিভুজ প্রেমের করুণ কাহিনি

শান্তা মারিয়া
শান্তা মারিয়া শান্তা মারিয়া , কবি ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:১৫ এএম, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

চীন থেকে বিমানভাড়া খরচ করে ঢাকা আসার অন্যতম কারণ হলো প্রাণের বইমেলায় যেন যেতে পারি। সেই কোন ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে বইমেলায় যেতাম। বাংলা একাডেমির প্রথমদিকের বইমেলাগুলোর স্মৃতি মনে পড়ে। সে তুলনায় এখনকার বইমেলার পরিসর অনেক বিশাল। এ বছর তো আরও বড় হয়েছে।

মনে পড়ে সত্তর দশকের শেষ দিকে ও আশির দশকে বইমেলায় কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থার স্টল বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো। তখন এক প্রকাশনীর বই অন্য প্রকাশনীর স্টলে তো পাওয়া যেতই, কলকাতার প্রকাশকের বইও বিক্রি হতো। কারণ আমাদের প্রকাশনা জগত তখন আজকের মতো এত বিশাল ছিল না। বলতে গেলে আজকের তুলনায় প্রকাশনা শিল্পের অবস্থা তখন ছিল বেশ নাজুক। তবে সেই নাজুক অবস্থাতেও প্রকাশকরা তখন নিজের টাকা ব্যয় করেই বই প্রকাশ করতেন। এখনকার মতো লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই প্রকাশের রমরমা ব্যবসা তখন ছিল না। লেখক নিজেই নিজের বই একশ বা দুশ কপি কিনে নিবেন এই এক অদ্ভুত নিয়মের জালে বর্তমানে আটকে আছেন অসংখ্য লেখক। আর এ কারণেই মেলায় অনেক লেখকই রীতিমতো ক্রেতা-শিকারী হয়ে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হন। চেনাজানা কাউকে দেখতে পেলেই আর রক্ষা নেই। ঝুলোঝুলি করে তাকে নিজের প্রকাশকের স্টলের সামনে ধরে এনে বই কিনতে দস্তুরমতো বাধ্য করেন।

আবার পরিচিত লেখককে এড়াতে অনেক ক্রেতাই নানা রকম কৌশল অবলম্বন করতে বাধ্য হন। আমি নিজেও অনেক সময় পরিচিত লেখককে দেখে সরে পড়ি। কারণ আমার হয়তো তার বইটি পড়ার কোন আগ্রহ নেই, আমার আগ্রহ যে ধরনের বইতে হয়তো তিনি সে ধারার লেখক নন। বই কেনার জন্য আমার হয়তো নির্দিষ্ট পরিমাণে বাজেট রয়েছে। আমি নিজে কখনো অনিচ্ছুক কাউকে আমার বই কিনতে অনুরোধ করি না। কারণ অনিচ্ছুক লোককে ধরে বই কিনিয়ে কি লাভ? তিনি তো বাড়ি নিয়ে বইটি পড়বেন না। ফেলে রাখবেন। আমি তো পাঠক চাই, ক্রেতা চাই না।

এইসব কারণে গত কয়েক বছর ধরেই বইমেলা লেখক-প্রকাশক-ক্রেতার ত্রিভুজ প্রেমের করুণ কাহিনিতে পরিণত হয়ে চলেছে। অন্যদিকে রয়েছে লেখকের রয়ালিটি না পাওয়ার অশ্রুভেজা গল্প। এদেশে খুব কম সংখ্যক লেখক ছাড়া অন্যরা যে প্রকাশকের কাছ থেকে রয়ালিটি বাবদ কিছুই পান না তা তো ওপেন সিক্রেট। আমার লেখাটি এই পর্যন্ত পড়ে অনেকে হয়তো বলে বসবেন ‘আরে উনি পান না বলে বলছেন অন্যরাও পায় না।’ ‘অমুকে রয়ালিটি পায়নি, কিন্তু আমি রয়ালিটি পাই।’ এ কথা বলতে বাংলাদেশের লেখকরা এক ধরনের আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। লেখকদের এই ভুয়া আত্মপ্রসাদের সুযোগ নিয়েই কিন্তু প্রকাশকরা লেখকের রয়ালিটি মেরে দেন। প্রকাশকরা কাগজবিক্রেতা, ছাপাখানা, প্রকাশনাশ্রমিক সকলকে টাকা দিতে বাধ্য হলেও শুধু লেখককে সম্মানী দিতে যত প্রকার গড়িমসি করার তা করেন। কোন লেখক রয়ালিটি চাইলে বলেন ‘আরে মিয়া, আপনার বই তো ইঁদুরেও কাটে না।’

আর এ কারণেই এদেশের লেখকদের মধ্যে পেশাদারিত্বের এত অভাব দেখা যায়। কারণ লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিয়ে কজন বাংলাদেশে টিকে আছেন বা টিকে থাকতে পারেন তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সবাই তো আর হুমায়ূন আহমেদ হয় না, হতে পারেও না।বেশিরভাগ লেখক লেখালেখির রোজগারে সংসার চালান না বা তাদের পক্ষে রেখালেখির আয়ে সংসার চালানো অসম্ভব। তাদের সকলেরই বিকল্প পেশা রয়েছে। লেখালেখি ও বই প্রকাশ করেন শখে। লেখাকে জীবিকার মাধ্যম হিসেবে নিতে পারলে তাদের লেখার মানও উন্নত হতো। তারা পূর্ণ সময়টা এর পিছনে দিতে পারতেন।

এবার আসি ক্রেতার প্রসঙ্গে। বইমেলায় লোকের অভাব নেই। কিন্তু তাদের মধ্যে ক্রেতা কজন? যত মানুষ বইমেলায় ঢোকে তারা যদি প্রত্যেকে একটি করে বই কেনে তাহলেও কোন স্টলে কোন বই পড়ে থাকার কথা নয়। এক প্যাকেট সিগারেটের দামে, দুই প্লেট চটপটির দামে একটি বই কেনা যায়। কিন্তু অনেক মানুষ সেটুকুও ব্যয় করতে নারাজ। অথচ তারাই বই মেলায় ঢোকার মুখে ফুলের মুকুট, মালা চুড়ি কিনছেন, বন্ধুবান্ধবীকে এটা ওটা খাওয়াচ্ছেন। তারমানে পকেটে টাকা আছে কিন্তু বই কেনার বেলায় সেটি পকেট থেকে বের হচ্ছে না। এযেন এক দুষ্ট চক্র। ক্রেতা কিনছেন না বলে প্রকাশক লেখককে টাকা দিচ্ছেন না। লেখক টাকা পাচ্ছেন না বলে মানসম্মত বই প্রকাশিত হচ্ছে না। আবার মান সম্মত নয় বলে পাঠক সেই বইগুলোর প্রতি আগ্রহ বোধ করছেন না।

তবে এখানে বলি সিরিয়াস বই, মানসম্মত বই, উচ্চমানের বইও কিন্তু খুব যে বিক্রি হচ্ছে তা নয়। বরং ছ্যাবলা প্রেমের কাহিনি, আবুল কাশেম মার্কা লেখকদের বইয়েরই যে বেশি কাটতি হয় একথা তো আমি না বললেও সকলেই জানেন। তাহলে গলদটা কোথায়? গলদ আমাদের জাতিগত সাংস্কৃতিক চেতনায়। আমাদের মধ্যে বইপড়ার চর্চা এবং বিশেষভাবে ভালো বই পড়ার চর্চা ধীরে ধীরে কমছে, বিলুপ্ত হচ্ছে। ওয়াজ শোনা এবং ‘ধর্মের আলোকে দাম্পত্যজীবন’, ‘শরিয়ত মোতাবেক স্ত্রী গ্রহণ’ ধরনের বই পড়ার পাঠক বাড়ছে আর উচ্চমানের সাহিত্য পড়ার মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমছে।

এতকথা লিখলাম রাগ করে। এতকিছুর পরও বইমেলা আমার যে অতি আপন, অতি প্রিয় সেকথা না বলে কি থাকা যায়? বইমেলায় গেলে আমি ফিরে যাই আমার শৈশবের সোনালি দিনগুলোয়। ফিরে যাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মধুর দিনগুলোতে। ফিরে যাই নব্বই দশকের উত্তাল দিনগুলোতে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় গেলে যেন অনুভব করি একুশের মহান ভাষাশহীদদের, ভাষা সৈনিকদের। অনুভব করি আমার প্রয়াত পিতার স্নেহস্পর্শ। অমর একুশে গ্রন্থমেলা একজন ভাষাসৈনিকের কন্যা হিসেবে আমার অতি প্রিয়, অতি আপন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কেতন দেখতে পাই বইমেলায়। শুনতে পাই বাংলাভাষার জয়ধ্বনি।

বই কেনা, বই পড়াতেই তো খুঁজে পাই জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দ। লেখক, প্রকাশক, ক্রেতা তিনে মিলেই তো বইমেলা। সে বইমেলা সুন্দর হোক, সার্থক হোক কে না চায়। সকলের প্রতি আহ্বান। মেলায় আসুন। বই কিনুন, বই পড়ুন। জয়তু বইমেলা।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।