শুভ জন্মদিন ‘ছোট আপা’

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
প্রকাশিত: ১০:১৪ এএম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সর্বশেষ নির্বাচনে তিনটি আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন বাঙালি বংশোদ্ভূত তিনজন সাংসদ, আমাদের “তিন কন্যা”। গতবারেও তাই ছিল, তবে এবার ভোট বেড়েছে প্রত্যেকেরই। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী টিউলিপ সিদ্দিক এমপি গতবারের চেয়ে এবার দশ হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন। তার উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত হয়েছি আমরা আর ভেসেছি বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে।

টিউলিপ সিদ্দিক এমপি গর্বিত করেছেন জাতিকে আর জাতির পিতাকে। কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি টিউলিপ সিদ্দিকের ব্রিটিশ এমপি হওয়ার প্রেক্ষপটটা কি? তিনিতো ব্রিটেন না হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়ারও এমপি হতে পারতেন। থাকতে পারতেন আমাদের জাতীয় সংসদেও।

বিজ্ঞাপন

জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৭৫-এ। ক্ষমতার জবর-দখলের কুৎসিত সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় জাতির পিতার সপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তার জীবিত দুই উত্তরসূরি দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সহযোগিতা ছিল সামান্যই। বরং ছিল রাষ্ট্রীয় আর আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতায় নিপীড়ন। এমনি প্রতিকূল বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠা কন্যা শেখ রেহানা আপা একদিন থিতু হয়েছিলেন লন্ডন শহরে। বিয়েও হয়েছিল তার এই শহরেই বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণের পর। একমাত্র বোন শেখ হাসিনার সুযোগ হয়ে উঠেনি সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার। এরই ধারাবাহিকতায় শেখ রেহানার ঔরসে জন্ম নেয়া টিউলিপ সিদ্দিকের লন্ডনে বেড়ে ওঠা আর তারপর একদিন ওয়েস্ট মিনিস্টার দখল।

শুধু কি টিউলিপ সিদ্দিক এমপি? তার ছোট বোন রুপন্তী। বছর কয়েক আগে ঈদের দুদিন আগে সন্ধ্যায় অনেকটা সময় কাটিয়েছিলাম শেখ রেহানা আপার লন্ডনের বাসায়। তার লন্ডনের বাসায় সেবারই আমার প্রথম যাওয়া। গল্পে-গল্পে ঘড়ির কাটায় রাত তখন ১১টা। হঠাৎ চিন্তিত আপা- আমরা কিভাবে ফিরে যাব?

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

নুজহাত বললো, “আমরাতো স্বপ্নীলের কাজের সুবাদে একটা সময়ে লন্ডনে ছিলাম। ঠিক ঠিক যেতে পারবো”। আপা রাজি হন নি। রুপন্তী অতরাতে গাড়ি চালাচ্ছে আর পিছনের সিটে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মত ভাবছি, “বঙ্গবন্ধুর নাতনি আমাদের নিজে গাড়ি চালিয়ে ড্রপ দিচ্ছেন- এতো স্বপ্নেরও অতীত”। আর গাড়িটাও অত্যন্ত সাদামাটা, সম্ভবত একটা সুজুকি ইকোনোমি কার।

কিছুদিন আগে ছোট আপার হঠাৎ দাওয়াতে গণভবনে। উপলক্ষ রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র একমাত্র মেয়ের জন্মদিন পালন। একটু ভয়-ভয়ই লাগছিল। আমার ছেলে সূর্য অনেকটা “থোড়াই কেয়ার” টাইপের। কখন কি করে-বলে বসে! সূর্যর অবশ্য বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে মিশে যেতে সময় লাগেনি। ওর বরং আড়ষ্ঠতা সাকিব-তামিমদের সাথে সেলফি তোলায়, অথচ অবলীলায় ছোট আপার কাছে জানাচ্ছে এটা-সেটা আব্দার। বড় আপা ওর কাঁধে হাত রেখে ছবি তুলছেন। আর রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি-তো নিজ থেকেই সেলফি তুলতে দাঁড়িয়ে গেলেন, সময় নিয়ে দেখলেনও ছবিগুলো ঠিকঠাক মত উঠেছে কিনা।

আমার ছেলে সূর্য আর রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র মেয়ে একসময় কাছাকাছি স্কুলে পড়তো। নুজহাত মাঝে মধ্যে সময় পেলে সূর্যকে স্কুলে নামিয়ে দিত। হয়তোবা রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিও তাই। কখনো-কখনো ওদের দেখা হয়ে যেত। নুজহাতের কাছে শুনেছি, রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি একাধিকবার নিরাপত্তার বেষ্টনি এড়িয়ে নিজ থেকে এসে ওর সাথে কথা বলেছেন।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র সাথে আমার সর্বশেষ দেখা এবারের ৭ মার্চের জয় বাংলা কনসার্টে। সেই একই মানুষ, কোথাও কোন ঔন্যাসিকতার লেশমাত্র নেই। জাতির পিতার রক্ত যাদের ধমনীতে ধাবমান, যাদের সামান্য ইশারায় সূর্য সানন্দে এই ভূখণ্ডে উত্তর দিকে উদিত হয়ে দক্ষিণে অস্ত যাবে- তারা এতটা বিনয়ী, ভাবাই যায় না!

আমার পরম সৌভাগ্য আমি শেখ রেহানা আপাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। সুযোগ হয়েছে লন্ডনে তার বাসায় যাবার, তার আটপৌরে বাঙালি জীবন দেখার। সুযোগ হয়েছে ঈদের আগে একজন “বাঙালি মায়ের” অতিথি আপ্যায়নের ব্যস্ততা দেখার। দেখেছি নাতি-নাতনী নিয়ে তার সে কি উচ্ছ্বাস আর তার সাধাসিধে ড্রইংরুমে বসে নির্বাক হয়ে তার মুখে শুনেছি পঁচাত্তর পরবর্তী দুঃসহ দিনগুলোর সাবলীল স্মৃতিচারণ।

আমার ফেসবুকে ছোট আপার সাথে আমাদের পরিবারের ছবি দেখে আর্মেনিয়ার একজন লিভার বিশেষজ্ঞ আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন উনি আমাদের কি রকম ‘আপা’। অধ্যাপক হাশমিককে কি করে বোঝাই উনি আমাদের কেমন আপা? সম্পর্কটাতো রক্তের নয়, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু।

বিজ্ঞাপন

এমন পরিবারের সাহচর্য্য মানুষকে বদলে দিতে বাধ্য। শুধু ভাবি নিরাপত্তার অনিবার্যতাটুকু যদি না থাকতো, সৌভাগ্য হতো যদি প্রতিটি বাঙালির এই পরিবারটিকে আরেকটু কাছ থেকে দেখার, এদেশের ভবিষ্যৎটা বদলে দিতে আমাদের সম্ভবত ২০৪১- এর অপেক্ষায় থাকতে হতো না।

আমি জানিনা আমার এই লেখা কখনও ছোটো আপার চোখে পড়বে কিনা। সম্ভবত না। মনে পড়ছে সুইডেনের মঞ্চে বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গমাতার আদরের ছোট মেয়ের পরিবারের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বক্তৃতার সেই সাদা-কালো ছবিটি, আর কানে বাজছে ‘হাসিনা - এ ডটার’স টেল’-এ ছোট আপার কিছু-কিছু দৃপ্ত উচ্চারণ কেন যেনো চোখ একটু ভিজে আসছে। শুভ জন্মদিন, ‘ছোট আপা’। আপনাদের মাঝেই আমরা দেখি “আগামীর” বাংলাদেশ।

লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

বিজ্ঞাপন

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।