ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন : কারণ ও করণীয়

মর্তুজা হাসান সৈকত
দেশে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। মাত্রই কয়েকদিনের ভেতরে কক্সবাজারে মা-মেয়েকে রশিতে বেঁধে নির্যাতন ও সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের মতো বর্বরোচিত ঘটনার রেশ না কাটতেই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে পৈশাচিক নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যদিও নির্যাতনের প্রায় একমাস পর ঘটনা সামনে এসেছে।
এই বর্বরোচিত ঘটনার মূল নায়ক দেলোয়ার হোসেন এক সময় সিএনজি চালাতো। সেই সিএনজি চালকই একসময় একটি সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান হয়ে উঠেছিল। এলাকার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের সাথে তার দহরম-মহরম ছিল। এই টাইপের মানুষ অপরাধ করলেও অসহায় মানুষ ভয়ে মুখ ফুটে কিছু বলতে সাহস পায় না। কারণ, এলাকার শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যাদের সখ্যতা, ওঠাবসা থাকে, সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলা তাদের পক্ষে কঠিন কোন কাজ নয়। সিলেটে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের কাহিনীও অনেকটা এই রকম। রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে তারাও ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছিল।
এতো গেলো মাত্র কয়েকটা ঘটনা, এরকম কতশত ঘটনা যে লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যাচ্ছে সেটা কিন্তু আমরা কেউ জানি না। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পীকার নারী, যে দেশের নারীরা যোগ্যতার ভিত্তিতে দেশ-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ কাজে সফলতা অর্জন করছে, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য যে দেশের সরকার আন্তর্জাতিক পুরস্কারসহ নানা মর্যাদাকর সম্মাননা অর্জন করছে; সে দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যমে নারী নির্যাতনের অসংখ্য ছবি ভেসে বেড়াবে এটা খুবই দুঃখজনক। যদিও যে খবরগুলি এখানে আসছে তা অনেক কম। ১০০ জন নারী নির্যাতিত হলে সামনে আসছে হয়তো ১০ জনের খবর।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্র উল্লেখ করেছে, গত ৯ মাসে ৯৭৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন আরও ৪৩ জন। যে ঘটনাগুলো দৃশ্যমান হয়েছে এটা হচ্ছে কেবল তার হিসেব।
দেশের কোথাও আজ নারীরা নিরাপদ নয়। সর্বত্রই নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলছে। নারী নির্যাতনের যেসব ঘটনা ঘটে, তার সবগুলোতেই আবার সোচ্চার প্রতিবাদ হয় না। যে ঘটনাগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা গণমাধ্যমের বদৌলতে সামনে চলে আসে, সেখানেই কেবল প্রতিবাদ হয়। বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় দায়সারা প্রতিবাদের পর তা আবার তা থেমেও যায় দ্রুত। অন্যদিকে, রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে অনেক ক্ষেত্রেই ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। নতুন ইস্যু চলে আসলে পত্র-পত্রিকার দৃষ্টিও অন্যদিকে ঘুরে যায়।
তাছাড়া, নির্যাতনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবস্থা এমন হয় যে, নির্যাতনকারী নির্যাতিতার তুলনায় আর্থিক ও সামাজিকভাবে শক্তিশালী থাকে। কখনো কখনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়া থাকে, ফলে অপরাধী অপরাধ ঘটিয়ে নির্যাতিতাকে বা তার পরিবারকে হুমকি দেয়, ভয়ভীতি দেখায়। সিলেটের ঘটনায় অভিযুক্তদের যেদিন প্রথম আদালতে তোলা হয়েছিল সেদিন তারা প্রকাশ্যে হম্বিতম্বি, দম্ভোক্তি করে বলেছে, কেউ তাদের কিচ্ছু করতে পারবে না! যে সমাজে নারী নির্যাতনকারী, ধর্ষকরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, নির্যাতিতাকে প্রকাশ্যে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে, নারী নির্যাতনের ভাইরাস সে সমাজে কতটা প্রকট আকার ধারণ করেছে একবার ভাবুন।
নারী নির্যাতনের এই ভাইরাস থেকে সমাজকে মুক্ত করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে দল-মত নির্বিশেষে নারী নির্যাতনকারী ও ধর্ষকদের দ্রুত বিচার ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা। কারণ, নির্যাতনকারী, ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে এমন খবর যখন ব্যাপকভাবে আসতে থাকবে তখন ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা ভেবে হলেও নারীকে নির্যাতন করার আগে কয়েকবার চিন্তা করবে ধর্ষক, নির্যাতনকারীর দল।
অন্যদিকে, যে কোন ধরনের অপরাধীর সাজা না হলে অপরাধ করার প্রবণতা বাড়তে থাকে, এটি অবধারিত। আমাদের দেশেও এটি হয়েছে। বাংলাদেশে বেশিরভাগ নারী নির্যাতনকারী রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে, কখনো আবার নির্যাতিতার প্রান্তিক অবস্থানের কারণে আপসরফা করে বেড়িয়ে আসছে। আবার দেখা যায়, আইনী প্রক্রিয়ার ফাঁকফোকর গলেও পার পেয়ে যাচ্ছে অনেকে।
তবে আশার কথা হচ্ছে, জন দাবীর প্রেক্ষিতে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ প্রতিরোধে দেশের প্রচলিত কঠোর আইনকে আরও কঠোর ও শক্তিশালী করতে সরকার উদ্যেগ গ্রহণ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দ্ব্যর্থ-হীন কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছেন, ধর্ষণের প্রচলিত আইনকে সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হবে।
বলা হয়ে থাকে, একটি সমাজ যত বেশি নারী ও শিশুবান্ধব সে সমাজ ততবেশি উন্নত। সমাজকে নারীবান্ধব করতে হলে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের এই লাগামহীন ঘোড়াকে এখনই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এর পাশাপাশি সব রকমের নারী নির্যাতনকারীদের বিচারের মুখোমুখি করে অপরাধ ভেদে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যদি তা সম্ভব হয়, তাহলেই কেবল সমাজ থেকে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা কমিয়ে যাবে। এর অন্যথা হলে তার প্রভাব যেমন সমগ্র সমাজ কাঠামোর উপরে পড়তে থাকবে, তেমনই নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
লেখক : কবি, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম