শেখ রেহানা বঙ্গমাতার অবিকল প্রতিচ্ছবি

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:১৭ এএম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

তাপস হালদার

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। তিনি দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুখ-দুঃখের সাথী, আদরের ছোট বোন। কিন্তু তিনি নিজেকে মেধা যোগ্যতা দিয়ে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। হয়ে উঠেছেন কোটি কোটি আওয়ামী পরিবারের সদস্যদের কাছে ‘প্রিয় ছোট আপা’। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ পরিবারের সকল সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে। সে সময় দুলা ভাই ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল জার্মানিতে বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার কারনে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।

সেদিন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া, ছোট বোন শেখ রেহানা, শিশু সন্তান জয় ও পুতুল বেলজিয়ামে বাংলাদেশের নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের বাসায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে রাষ্ট্রদূত এক প্রকার বাসা থেকে বের করেই দেন। কিন্তু সহায়তার হাত বাড়িয়ে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রসিদ চৌধুরী এগিয়ে আসেন। মি. চৌধুরীর সহযোগিতায় ২৫ আগস্ট তাঁরা দিল্লিতে পৌঁছান। দিল্লি পৌঁছানোর ১০ দিন পর ৪ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতে প্রথম জানতে পারেন পরিবারের আর কেউ জীবিত নেই। শ্রীমতি গান্ধীই তখন মাতৃস্নেহে তাঁদেরকে ভারতে আশ্রয় দেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা জীবনকে আবার নতুন করে গড়ে তোলার তাগিদ থেকে বেশ কিছু দিন পর আবার শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে পড়াশোনা শুরু করতে চান বলে জানান। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দিল্লির নেহরু ইউনিভার্সিটি ও কলকাতার শান্তিনিকেতনের যেকোন একটিতে ভর্তির কথা বলা হয়। শেখ রেহানার ইচ্ছা অনুযায়ী শান্তিনিকেতনে ভর্তির সব ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয়, যখন তিনি শান্তিনিকেতনে যাওয়ার জন্য ট্রেনে উঠবেন, ঠিক সেই সময় খবর আসে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে নিরাপত্তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। অগত্যা সিন্ধান্ত বদল করা হয়। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পাওয়ায় শান্তিনিকেতনে যেতে না পেরে লন্ডনে চলে যাওয়ার সিন্ধান্ত নেন। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি লন্ডনে চলে যান। সেখানে গিয়ে পড়াশুনা, চাকুরির পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচাররের দাবিতে বিশ্ব জনমত গঠন শুরু করেন।

১০ মে ১৯৭৯ দিনটি ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রথম প্রতিবাদ। স্টকহোমে অনুষ্ঠিত সে সভায় বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদানের জন্য অনুরোধ জানানো হলেও তিনি ভারতে অবস্থান করার কারণে উপস্থিত হতে না পেরে ছোট বোন শেখ রেহানাকে প্রতিনিধি করে পাঠান। সেদিন শেখ রেহানা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিশনের চেয়ারম্যান, আমেরিকার কংগ্রেসের হিউম্যান রাইটস কমিটির চেয়ারম্যান, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রধানদের কাছে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচারের প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার অনুরোধ জানিয়ে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানার বক্তব্যে পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা শুনে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের মধ্যে এক হৃদয় বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল।

আস্তে আস্তে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নিরন্তর চেষ্টার কারণে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে বিশ্ব বিখ্যাত আইনজ্ঞদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৮০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের ‘হাউস অব কমন্স’-এর নিকটবর্তী কুন্দুন রেস্টুরেন্টে এক সংবাদ সম্মেলনে স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপি-কে কমিশনের চেয়ারম্যান, মি অব্রে রোজকে সেক্রেটারি ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত আইরিশ আইনজীবী মি সন ম্যাকব্রাইড, লেবার পার্টির আইন বিষয়ক মুখপাত্র জেফ্রি টমাস কিউসি এমপি-কে সদস্য করে তদন্ত কমিশন ঘোষণা করা হয়।

পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে দুই বোনেরই রয়েছে অনন্য ভূমিকা। শেখ হাসিনার ভূমিকা প্রত্যক্ষ, তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর শেখ রেহানার ভূমিকা নেপথ্যের, তিনি বিদেশে থেকে অন্যায় অবিচার অপশাসনের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলেছেন। বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর লন্ডনেই প্রথম বাংলাদেশে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। দেশরত্ন শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দিল্লি থেকে ঢাকায় ফিরে এসে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠন এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। আর শেখ রেহানা লন্ডনে অবস্থান করেন বিদেশে আওয়ামী লীগের সংগঠনকে মজবুত করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।

তিনি একজন রত্নাগর্ভা মা। বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক-কে বৃটেনের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন। টিউলিপ সিদ্দিক লেবার পার্টি থেকে বারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। ছেলে রাদওয়ান সিদ্দিক ববি ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত। অন্যদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)-র ট্রাস্টি হিসেবে। বঙ্গবন্ধুকে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি একজন আইডলে পরিনত হয়েছেন।

ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ডে পড়াশুনা করেছেন। এখন লন্ডনে কন্ট্রোল রিস্কস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গ্লোবাল রিস্ক অ্যানালাইসিস সম্পাদক। আজকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্ব মঞ্চে যে আলো ছড়াচ্ছেন, তাদের কৃতিত্বের ভাগীদারও শেখ রেহানা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বার বার উঠে এসেছে পরিবারের পাঁচ সন্তানের কথা। তাঁরা কখনো সন্তানদের আলাদা করে দেখেন না।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতেই তাঁরা দু-বোন যে বেঁচে আসেন এবং মানুষের কাজ করে যাচ্ছেন এ বিষয়ে ২০১৩ সালের ৯ আগস্ট লন্ডনে বাংলা নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্ধৃতি করে বলেন, ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। বিশ্বাস তো কাউকে না কাউকে করতেই হবে। আমরা যদি সবার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতাম তাহলে ১৫ আগস্টের পর তো দুই বোন ঘরেই বন্দী হয়ে বসে থাকতাম। তিনি আরো বলেন, কার ভেতরে কি আছে তা বলা মুশকিল হলেও সবার ওপর থেকে বিশ্বাস তো আর হারানো যায় না।

যে রাজনীতি ছোট্ট বয়সে নিজেদের কাছ থেকে বাবাকে সব সময় বিচ্ছিন্ন করে রাখত, সেই রাজনীতি যখন চিরতরে পুরো পরিবারকে ছিনিয়ে নিল, তখন আর কীসের রাজনীতি, এমন মনোভাব নিজের ভেতরে কাজ করলেও এক পর্যায়ে এসে তার মনে প্রশ্ন জেগেছে, পুরো পরিবার নিয়ে গেলেও আল্লাহ কেন তাদের দুই বোনকে বাঁচিয়ে রাখলেন? আমাদের বাঁচিয়ে রাখার পেছনে নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার কোনো উদ্দেশ্য আছে। বাবা-মার খুনিদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসার আশাই আমাদের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়।’সেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলেই আজ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা জীবনের বড় একটা সময় লন্ডনে বসবাস করলেও তিনি বাংলার সাধারণ নারীর মতই জীবনাচরণ করে থাকেন। নীরবে নিবৃত্তে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। সুযোগ্য মায়ের যোগ্য উত্তরসূরি শেখ রেহানা, মা শেখ ফজিলাতুন্নেচ্ছা মুজিব পর্দার অন্তরালে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিলেন সাহস ও অনুপ্রেরণা যার ফলশ্রুতিতে শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হতে পেরেছিলেন। আজ দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে যে বিশ্বের কাছে মর্যদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সেখানে নিঃসন্দেহে নেপথ্যে থেকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন শেখ রেহানা।

দেশরত্ন শেখ হাসিনা প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে আছেন। শেখ রেহানা থাকেন নেপথ্যে। শেখ রেহানা রাজনীতিতে নেই এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। তিনি বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দেন। বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী নিজের বক্তব্যেই তা তুলে ধরেছেন। যখন এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রী সিন্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন,তখনই সাহস দিয়ে পাশে দাঁড়ান শেখ রেহানা। তিনি বলেন,আপা তুমি যদি ষোল কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারো তাহলে এই দশ লক্ষ মানুষকেও পারবা। এবার করোনা কালেও বিভিন্ন শ্রেণির অসহায় মানুষের কথা তিনি প্রধানমন্ত্রীকে তুলে ধরেন। তিনি পাশে থেকে প্রতিটি সমস্যা ও সংকটে বড় বোনকে সাহস জোগান।

স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও সরাসরি রাজনীতিতে আসেননি শেখ রেহানা। যেভাবে বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে শক্তি, সাহস, পরামর্শ দিয়ে আমাদের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। ঠিক তেমনি শেখ রেহানা বড় বোন শেখ হাসিনার পাশে থেকে শক্তি, সাহস, পরামর্শ দিয়ে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। শেখ রেহানা যেন বঙ্গমাতার অবিকল প্রতিচ্ছবি। আজ বঙ্গবন্ধু কন্যার জন্মদিন। শুভ জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
[email protected]

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।