রোহিঙ্গা সংকট : নিরাপত্তা পরিষদে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে

মর্তুজা হাসান সৈকত
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে প্রথমবারের মতো একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, প্রস্তাবটি মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করবে। প্রস্তাবে রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করার পাশাপাশি বাংলাদেশের সাথে স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণ করা এবং মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতসহ জাতিসংঘের সকল মানবাধিকার ব্যবস্থাপনাকে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
এই প্রস্তাব গ্রহণকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, অতীতে অনেক দেশ এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিলেও এবার কেউ বিরোধিতা করেনি। এমনকি জাতিসংঘে মিয়ানমারের স্থায়ী প্রতিনিধিও সামরিক জান্তার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে প্রস্তাবটি সমর্থন করেছেন। এর পাশাপাশি, আরেকটি কারণেও এই প্রস্তাবটি ঐতিহাসিক- মিয়ানমার ইস্যুতে অধিকাংশ সদস্য দেশের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশকারী দেশ চীন ও রাশিয়াও অন্যান্য বারের মতো এবার বিপক্ষে দাঁড়ায়নি।
এমন এক সময়ে এই প্রস্তাবটি পাস হয়েছে যার কিছুদিন পূর্বে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রতি ‘অতি জরুরি’ ভিত্তিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জোরদার করার দাবি জানিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সেখানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে এ সংকট প্রশ্নে প্রধান আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর নিষ্ক্রিয়তায় বাংলাদেশের মর্মাহত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেছিলেন- ‘গত চার বছর ধরে আমরা এই উচ্চাশাই পোষণ করে আসছিলাম যে এসব স্থানচ্যুত লোকজন নিজেদের দেশ, তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে নিরাপদে, সুরক্ষিতভাবে সসম্মানে ফেরত যেতে পারবে।
আমরা তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক সমাবেশে এবং আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আস্থা রেখেছিলাম। আমাদের কথা শোনা হয়নি, আমাদের আশা অপূর্ণই থেকে গেছে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, প্রত্যাবাসনে অগ্রগতির ঘাটতির কারণে হতাশা বৃদ্ধি পাওয়া রোহিঙ্গাদের অনেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে এবং তারা অতি সহজে জঙ্গি মতাদর্শের শিকার হচ্ছে। এটি পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এ ব্যাপারে অতি দ্রুত কিছু করতে ব্যর্থ হলে সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা মহাবিপদে পড়বে।
মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই আহ্বানের পরেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্ব হারাতে বসা রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান আবারও নতুন করে আলোচনায় আসে। এবং তারপরই সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতভাবে পাস হলো এ প্রস্তাবটি। কিন্তু এই প্রস্তাব পাসের কারণে মিয়ানমার কতখানি চাপের মুখে পড়ল, এ নিয়ে সন্দেহ কিছুটা রয়েই গেছে। কারণ, সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব দিয়ে কোনো বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এজন্য প্রয়োজন নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মত প্রস্তাব। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে, এতদিন চীন ও রাশিয়া সেখানে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করার কারণে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় নি। তবে এবার যেহেতু দেশ দুটি সাধারণ পরিষদে বিরোধিতা করে নি সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদেও ক্ষেত্রেও হয়তো আগের অবস্থান পর্যালোচনা করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানের পর একটি জোরালো পদক্ষেপ দৃশ্যমান হলেও প্রশ্ন আসতে পারে এতদিনেও কেন প্রত্যাশিত সাফল্য পায় নি বাংলাদেশ? এর কারণ হচ্ছে, জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের ওপর চলা জাতিগত নিধন নিয়ে সোচ্চার হলেও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো যারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে মোটা দাগে ভূমিকা রাখতে পারতো তারা বাংলাদেশকে আশানুরূপ সহযোগিতা করেনি।
বিশেষ করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মাঠে রেফারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া চীনের ভূমিকা বাংলাদেশকে বরাবরই হতাশ করেছে। দেশটি শুরু থেকেই বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপনের পরিবর্তে দ্বিপক্ষীয় সমাধানের পক্ষে কাজ করেছে। নিরাপত্তা পরিষদে তারা বার বার ভেটো প্রয়োগ করেছে, প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছে। অন্যদিকে, কেবল তাদের আশকারা পেয়েই মিয়ানমার নানা অজুহাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রেখেছে।
এক পর্যায়ে চাপ দিয়ে চুক্তি করিয়েছে, অন্তরালে থেকে প্রত্যাবাসন নাটকও করিয়েছে। তদুপরি, জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও চীন ও রাশিয়ার ভূমিকার কারণে নিরাপত্তা পরিষদ কোনরকম ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যদিও গাম্বিয়ার আবেদনের প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শুনানিতে সম্মতি দেয়। তবে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়ার সময়টাতে মিয়ানমারকে সাহস যোগাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশটি সফর করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
অন্যদিকে, এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় চীনের পাশাপাশি ভারতও সম্প্রতি এক চরম প্রতিযোগিতার লিপ্ত হয়েছে। এটাও আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে। এর ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের মতো ভারতের মতো বন্ধুদেশকেও কখনও পাশে পায় নি বাংলাদেশ। চীন ও ভারত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুটি দেশই কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সীমান্ত নিয়ে চীনের সাথে ভারতের বিরোধ দীর্ঘদিনের। দেশ দুটি বেশ কয়েকবার যুদ্ধেও জড়িয়েছে।
ভারতের আকসাই চিন অঞ্চল ও অরুণাচল প্রদেশকে চীন নিজেদের এলাকা মনে করে। সেকারণে দেশটি লাদাখ ও সেভেন সিস্টার্স নিয়ে চরম নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে। এ ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে থাকা শিলিগুড়ি করিডোর। এ করিডোরটি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সেভেন সিস্টার্সে যোগাযোগের একমাত্র পথ। চীনের দোকলাম থেকে যার দূরত্ব মাত্র ১৩০ কি.মি.।
দুর্যোগপূর্ণ সময়ে চীনের চুম্বী ভ্যালিতে মোতায়েন থাকা সেনাবাহিনী শিলিগুড়ি করিডোরের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে পুরো সেভেন সিস্টার্স ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ফলে নিরাপত্তা ও যোগাযোগের কথা চিন্তা করে ভারত কালাদান প্রকল্পের মাধ্যমে সেভেন সিস্টার্সে প্রবেশের বিকল্প একটি পথ তৈরিতে উদ্যোগী হয়। এটার ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে দ্রুত সংযোগ স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ রুট ছাড়াও অন্য একটি বিকল্পও তৈরি থাকলো ভারতের কাছে। এ কারণে ভারতের কাছে দেশটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে সৃষ্ট নতুন ভূ-রাজনৈতিক ইকুয়েশনের কারণে চীনও মিয়ানমারের ওপর নির্ভরতা দিন দিন বাড়িয়েছে। বিশ্বে প্রভাব বিস্তারে চীনের বিআরআই প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ ধরা হয় মিয়ানমারকে।
বলা হচ্ছে, চীনা অর্থনীতির লাইফলাইন হয়ে উঠতে পারে এই প্রবেশদ্বার। এসবের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগরে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির ভারসাম্য চীনের পক্ষে রাখা হবে। আর এর বিনিময়ে মিয়ানমার যা চেয়েছে, তা-ই দিয়েছে চীন। এসব ইকুয়েশনের কারণে মিয়ানমারও হয়তো ভেবেছে, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করতে পারলেই রোহিঙ্গা সংকটের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ কমে যাবে। এ কারণে তারা দিনের পর দিন ছলচাতুরি করে গেছে। তবে এবারের প্রস্তাব পাসের ঘটনা নিঃসন্দেহে তাদের সে ভাবনায় পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
চীন তার ভূ-রাজনীতির স্বার্থে উত্তর কোরিয়ার মতো মিয়ানমারকেও যা খুশি তা করার লাইসেন্স দিলেও মিয়ানমার ধীরে ধীরে পশ্চিমাদের সাথেও সখ্যতা বাড়িয়েছে। মিয়ানমারের এই চালাকি চীন-রাশিয়া বুঝতে পারছে। বাংলাদেশের জোরদার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং চীনের এই বোধোদয়ের সম্ভবত যোগফলই হচ্ছে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে চীনের বিরোধিতা না করা। আর মিয়ানমার প্রসঙ্গে চীন যেদিকে রাশিয়াও সেদিকে এই নীতির কারণে রাশিয়াও বিরোধিতা করে নি। তবে বাংলাদেশকে এইটুকুতে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। চীন এবং রাশিয়ার এই পদক্ষেপ তখনই ইতিবাচক হিসেবে গণ্য হবে যদি নিরাপত্তা পরিষদেও দেশ দুটি একই অবস্থান ধরে রাখে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ব্যাপারে এখন বেশি ইতিবাচক। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চীন, রাশিয়াসহ ভারতের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোও যাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের পক্ষে যাতে কাজ করে, সে কৌশল নিতে হবে এখন। এই দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সেটির সিকিভাগও কাজে লাগানো যায় নি। তাই বাংলাদেশের সার্বক্ষণিক লক্ষ্য হওয়া উচিত, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সেই ভিত্তিকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কূটনৈতিক প্রক্রিয়াকে কীভাবে আরও জোরালো করা যায় সেদিকে কাজ করা।
নিরাপত্তা পরিষদে যদি সদস্য দেশগুলোর ইতিবাচক অবস্থান নিশ্চিত করা যায় তাহলে মিয়ানমার তার অবস্থান পাল্টাতে বাধ্য হবে। কারণ, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব মেনে চলা বাধ্যতামূলক। তাই আমাদের প্রত্যাশা একটাই- ক্যারিশম্যাটিক বিশ্বনেতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা নিরাপত্তা পরিষদেও প্রস্তাব গ্রহণের সফলতা নিয়ে আসার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করবে অচিরেই।
লেখক : কবি ও কলাম লেখক।
এইচআর/জেআইএম