শান্তি, পুতুল, খালেদা খানম ও খালেদা জিয়া
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অস্থির ও অশান্ত পৃথিবীতে জন্ম নেয়ার কারণে পারিবারিক ডাক্তার শিশুটির নাম প্রস্তাব করেছিলেন ‘শান্তি’। কিন্তু শিশুটি পুতুলের মতো কমনীয় ও সুন্দর হওয়ায় সবাই তাকে ‘পুতুল’ নামে ডাকতে শুরু করে। নাম দিয়েছিলেন বড় বোন সালিমা আক্তার বিউটি। তার আরেক বড় বোন খুরশিদ জাহান ডাকতেন ‘টিপসি’ বলে। যদিও এ নামে কেউ আর তাকে ডাকতেন না। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে তার নাম রাখা হয় খালেদা খানম। স্বামীর নামের অংশ যুক্ত হওয়ায় পরবর্তী জীবনে যিনি পরিচিত হন খালেদা জিয়া নামে।
বেগম খালেদা জিয়ার জন্ম ও বেড়ে ওঠা দিনাজপুরে। বাবা ইস্কান্দার মজুমদারের জন্ম ফেনীর পরশুরামে হলেও ব্যবসার জন্য স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন দিনাজপুরে। ইস্কান্দার-তৈয়বা দম্পতির তিন মেয়ে দুই ছেলে। তাদের মধ্যে খালেদা তৃতীয়। পাঁচ বছর বয়সে ভর্তি হন দিনাজপুর শহরের গনেশতলা এলাকায় সেন্ট জোসেফ স্কুলে। ১৯৬০ সালে তিনি দিনাজপুর সরকারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হন। সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ তার ‘বেগম খালেদা জিয়া জীবন ও সংগ্রাম’ বইতে লিখেছেন: ১৯৬৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন খালেদা খানম। সুতরাং, এই তথ্য যদি সঠিক হয় তাহলে খালেদা জিয়া এইট পাস বা আন্ডার ম্যাট্রিক বলে যে দাবি করা হয়েছে, সেটি ভুল।
খালেদার চুল অনেক লম্বা ছিল এবং গোসল করার পর চুল শুকানো তার পক্ষে কঠিন হয়ে যেত। তার কোনো হেয়ার ড্রায়ার ছিল না, সে সময় খুব কম মানুষই হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করতেন। বাড়ির বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় মা তার চুল বেঁধে দিতেন। ছোটোবেলা থেকেই ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিয়মিত ঘরদোর গুছিয়ে পরিপাটি রাখতেন। তিনি ফুল খুব পছন্দ করতেন এবং ফুলের প্রতি তার সেই অনুরাগ ছিল আমৃত্যু।
অস্বীকার করা যাবে না, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে যখন গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়াটি চলমান, সেই সময়ে তার বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরি ছিল। কিন্তু মৃত্যু কোনো যুক্তি মানে না। বয়স মানে না। এমনকি খালেদা জিয়া যে কয়দিন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন, তখনও অনেকের মনে এই আশা ছিল যে, হয়তো তিনি নির্বাচনটি দেখে যেতে পারবেন। তার দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের একটি পরিণতি তিনি দেখে যেতে পেরেছেন। কিন্তু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সত্যিই দেশে গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হলে সেই দৃশ্যটি দেশে সম্ভবত তিনিই সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। কেননা দেশ দীর্ঘদিন গণতন্ত্রহীন অবস্থায় থাকার পরে ১৯৯১ সালে তার হাতেই যাত্রা শুরু করে সংসদীয় গণতন্ত্র।
চাচাতো বোন নার্গিসের সঙ্গে তিনি খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তারা দুজনেই স্কুলে নাচ শিখতেন। পুতুল এক্ষেত্রে এতটাই পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন যে, দিনাজপুরের বাইরেও অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। তার বাবা খুব রক্ষণশীল হলেও তিনি মায়ের কাছ থেকে এসব ক্ষেত্রে সমর্থন পেতেন। এমনকি মা তার নাচের প্রশিক্ষণের জন্য গৃহশিক্ষকও নিয়োগ করেছিলেন। তিনি কিছু গানেও সুর তুলেছিলেন। (মাহফুজ উল্লাহ, বেগম খালেদা জিয়া: জীবন ও সংগ্রাম, জাতীয়তাবাদী প্রকাশনা সংস্থা/২০২৪, পৃ. ২৭)।
স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকরী চৌকস সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে বেগম জিয়া সাধারণ বাংলাদেশি গৃহবধূর মতো পরিমিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। খেলাধুলা ও রাজনীতিতে আগ্রহের পাশাপাশি তিনি দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে লালনপালনেই বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেন। এমনকি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন, তখনও তিনি নিজেকে রাজনীতিতে বা রাষ্ট্রীয় বিষয়ে সম্পৃক্ত করেননি। কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩০ মে তিনি কিছু সেনা সদস্যের হাতে নিহত হলে খালেদা জিয়ার ২১ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে।
রাজনীতির মঞ্চে
১৯৮২ সালে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা দখল করলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনের সূচনা করেন খালেদা জিয়া। ১৯৮৩ সালে ৭ দলীয় জোট গঠন করা হয় তার নেতৃত্বে। তিনি বিএনপির চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পাওয়ার পর এরশাদবিরোধী আন্দোলন আরও গতি পায়। জনগণের সমর্থন আদায়ে মাঠ-ঘাট চষে বেড়ান বেগম জিয়া। মানুষের বিপুল সাড়া পান। খালেদা জিয়া ১৯৮৬ সালের কারচুপির নির্বাচনের বিরোধিতা করেন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। যদিও আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং সিপিবির মতো রাজনৈতিক দলগুলো এরশাদের অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেয়ার জন্য এই নির্বাচনে অংশ নেয়। ১৯৮৭ সালে এরশাদ পতনের একদফা আন্দোলন শুরু করেন। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে সংসদ ভেঙে দেন এরশাদ। পতন ঘটে তার দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের। রাজনৈতিক দৃঢ় সংকল্পের কারণে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৭ বার আটক হন খালেদা জিয়া। ধীরে ধীরে ‘আপসহীন’ শব্দটি খালেদা জিয়ার সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।
২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যদিও বিএনপি এই অভিযোগে মিথ্যা ও বায়বীয় দাবি করে রায় প্রত্যাখ্যান করে। দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি খালেদা জিয়া। এরমধ্যে লিভার সিরোসিস, কিডনি, ফুসফুসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তার পরিবার ও দল বিদেশে নিতে চাইলেও সেই সুযোগ দেয়নি বিগত সরকার।
পাহাড়ের মতো ভারী যে মৃত্যু
বাহাত্তর বছরের গড় আয়ুর দেশে তিনি বেঁচেছিলেন ৭৯ বছর। অর্থাৎ একটি দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন। কিন্তু তার জীবনটা বয়সের এই সংখ্যার চেয়েও অনেক বড়। অনেক মহৎ। একটি চীনা প্রবাদ এরকম: ‘কোনো কোনো মৃত্যু হাঁসের পালকের হালকা; কোনো কোনো মৃত্যু থাই পাহাড়ের মতো ভারী।’
বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যু নিঃসন্দেহে এই জাতির জন্য পাহাড়েই মতোই ভারী। একটি জাতির জীবনে অভিভাবক বলতে যা বোঝায়, খালেদা জিয়া তা-ই হয়ে উঠেছিলেন। জাতির যে-কোনো দুঃসময়ে যার কাছে যাওয়া যায়, যার ওপর ভরসা করা যায়, খালেদা জিয়া তার জীবদ্দশায় এরকম একজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
একজন মানুষ কতটা সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল হতে পারেন, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ খালেদা জিয়া। গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানে যেদিন আওয়ামী লীগের পতন হলো, তখনও পরাজিতদের ওপর কোনো ধরনের প্রতিশোধ নেয়া থেকে বিরত থাকতে নেতাকর্মীদের প্রতি নির্দেশ দেন তিনি। এর কিছুদিন পরে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করে বিএনপি। সেখানে সংক্ষিপ্ত ভিডিও বার্তায়ও তিনি ধ্বংস, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার বদলে ভালোবাসা ও শান্তির সমাজ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বলেন, তরুণেরা যে স্বপ্ন নিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে মেধা, যোগ্যতা, জ্ঞানভিত্তিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।
খালেদা জিয়া কোনোদিন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ব্যাপারে কটু কথা বলেননি। অশোভন শব্দ উচ্চারণ করেননি। যে কারণে বারবার তিনি যে আওয়ামী লীগের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন, মৃত্যুর পরে সেই দলের প্রধান শেখ হাসিনাও শোকবার্তা দিয়ে বলেছেন, ‘বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁর অবদান অপরিসীম। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে এবং বিএনপি নেতৃত্বের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো।’
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজেও একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছে। সেখানে খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হয়েছে। জয় লিখেছেন, দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে, যখন সাধারণ মানুষ নিরাপত্তার অভাবে ভুগছেন এবং দেশকে অস্থিতিশীল ও বিরাজনীতিকরণের অপচেষ্টা চলছে, তখন তাঁর এই চলে যাওয়া বাংলাদেশের উত্তরণের পথে এক গভীর প্রভাব ফেলবে। অতীতের নানা বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার শিকার হওয়া সত্ত্বেও, নিজের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি অসংখ্য সাফল্য অর্জন করেছেন এবং দেশের জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণ করেছেন। জাতি গঠনে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে; তবে তাঁর মৃত্যু বর্তমানে বাংলাদেশকে স্থিতিশীল করার প্রচেষ্টায় একটি বড় ধাক্কা।’
অস্বীকার করা যাবে না, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে যখন গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়াটি চলমান, সেই সময়ে তার বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরি ছিল। কিন্তু মৃত্যু কোনো যুক্তি মানে না। বয়স মানে না। এমনকি খালেদা জিয়া যে কয়দিন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন, তখনও অনেকের মনে এই আশা ছিল যে, হয়তো তিনি নির্বাচনটি দেখে যেতে পারবেন। তার দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের একটি পরিণতি তিনি দেখে যেতে পেরেছেন। কিন্তু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সত্যিই দেশে গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হলে সেই দৃশ্যটি দেশে সম্ভবত তিনিই সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। কেননা দেশ দীর্ঘদিন গণতন্ত্রহীন অবস্থায় থাকার পরে ১৯৯১ সালে তার হাতেই যাত্রা শুরু করে সংসদীয় গণতন্ত্র।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।
এইচআর/এএসএম