চীন-যুক্তরাষ্ট্রের চিপ যুদ্ধের ভবিষ্যৎ

মো. হাসান তারেক
মো. হাসান তারেক মো. হাসান তারেক , প্রভাষক
প্রকাশিত: ০৯:৩৭ এএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

একবিংশ শতকের শুরু থেকেই নানাবিধ বিষয় নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বিশ্ব রাজনীতি। মাত্র দুই দশকেই একাধিক যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। সংঘর্ষে জড়িয়েছে একের পর এক দেশ। এমনই বিবদমান দুই দেশ হলো চীন এবং আমেরিকা। যদিও এই দুই দেশ এখনও সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি। কার্যত ঠান্ডা লড়াই চলছে দুই পরাশক্তির মধ্যে।

একটি নয় একাধিক বিষয় নিয়ে লড়াই চলছে এই দুই দেশের মধ্যে। তবে, হয়তো অনেকেই জানেন না, সবার অগোচরে একটি মহামূল্যবান সম্পদ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে লড়াই জমে উঠেছে উভয়ের মধ্যে। এই মূল্যবান সম্পদের নাম হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর বা চিপস।

বর্তমান সময়ে সারাবিশ্ব চলে কম্পিউটার চিপে। আপনার হাতের ফোন, আপনার রান্নাঘরের ফ্রিজ থেকে শুরু করে গাড়ি কোম্পানির উৎপাদন সরঞ্জাম এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা পর্যন্ত আজকের ডিজিটালভাবে পরিচালিত সমাজের প্রতিটি অংশই সেমিকন্ডাক্টর নামে পরিচিত অতি ক্ষুদ্র, জটিল এই ডিভাইসগুলোর ওপর নির্ভর করে।

এই সেমিকন্ডাক্টরগুলো উৎপাদন করা বেশ জটিল। একই সাথে এটি উৎপাদন করতে এই বিষয়ে দক্ষ বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন পড়ে, তাদের মধ্যে আবার দারুণ কাজের সমন্বয়ও জরুরি। সিলিকনের এই ক্ষুদ্র টুকরোগুলোকে ঘিরে রয়েছে সারাবিশ্বে ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিশাল ব্যবসা, যা ২০৩০ সালের মধ্যে আরও দ্বিগুণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তাছাড়া, যারা এই প্রযুক্তির সাপ্লাই চেইন বিশেষ করে তৈরিকারক কোম্পানি এবং দেশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখবে, তারাই সামনের বিশ্বব্যবস্থায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি হওয়ার চাবিকাঠি হাতে ধরে রাখতে পারবে। টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস মিলার সম্প্রতি প্রকাশিত তার বই ‘চিপস ওয়ারস’ এই বলেছেন ‘এতকাল ধরে বিশ্বে চীন-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেমন- জাহাজ বা ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যার মতো ক্ষেত্রে চলেছে, কিন্তু এখন এ লড়াইটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এলগরিদমগুলো কারটা কত ভালো সেই ক্ষেত্রেও চলছে, যা মিলিটারি সিস্টেমগুলোতে ব্যবহার করা যাবে।’

যদিও এখন পর্যন্ত অবশ্য এই লড়াইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এগিয়ে আছে। সেমিকন্ডাক্টর আবিষ্কৃত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেমিকন্ডাক্টরের উৎপাদন বা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। একটা আইফোনের ভেতরে যে চিপগুলো থাকে তা ডিজাইন করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, এগুলো তৈরি হয় তাইওয়ান, জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ায়। তারপর এগুলো অ্যাসেম্বলিং বা একসঙ্গে সন্নিবেশ করার কাজটা হয় চীনে।

পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন বা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের কেন্দ্র হওয়ার একটা কারণ ছিল সরকারি ভর্তুকিসহ নানারকম প্রণোদনামূলক পদক্ষেপ। যার ফলে এখন সেমিকন্ডাক্টর চিপসের শিল্পে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান এগিয়ে রয়েছে। বিশ্বের বেশিরভাগ চিপ বর্তমানে তাইওয়ানে তৈরি করা হয়, যা চীন থেকে এই দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে একটি সুরক্ষা দেয় বলে দাবি করে তারা। একে এজন্যই তারা ‘সিলিকন ঢাল’ হিসেবে অভিহিত করে।

অপরদিকে, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন চিপের জন্য চীনকে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করতে হয়। তেল আমদানিতে চীনের যত ব্যয় হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর আমদানিতে। বিশ্বের শীর্ষ ১৫টি সেমিকন্ডাক্টর বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় চীনের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এটি অনুধাবন করতে পেরে চিপস তৈরির প্রযুক্তি হাতে পেতে চাইছে চীন।

বেইজিং চিপ উৎপাদনকে জাতীয়ভাবে অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং সুপার কম্পিউটার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় সর্বশক্তি দিয়ে বিনিয়োগ করছে। বিশ্বের সেরা চিপনির্মাতা হওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে থাকলেও গত এক দশকে তারা দ্রুত উন্নতি করেছে তাদের চিপ ডিজাইনের ক্ষমতায়। চিপের ওপর চীনের বিনিয়োগ এবং এটি সরবরাহের জন্য তাইওয়ান এবং অন্য এশীয় দেশগুলোর ওপর নির্ভরতা বেশ বিচলিত করে তুলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। এ কারণে বাইডেন প্রশাসন চিপস তৈরির প্রযুক্তি যেন চীনের হাতে কোনোভাবেই না পড়ে তার চেষ্টা করছে।

গত অক্টোবরে ওয়াশিংটন চিপস রপ্তানির ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করেছে, যার ফলে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের কোম্পানি চিপস, চিপ তৈরির সরঞ্জাম এবং মার্কিন প্রযুক্তি সম্বলিত সফটওয়্যারগুলো চীনের কাছে বিক্রি করতে পারবে না। পাশাপাশি চীনের নির্দিষ্ট কিছু কারখানায় চিপ উন্নয়ন বা উৎপাদনে জড়িত থাকতেও মার্কিন নাগরিক ও অন্যান্য স্থায়ী বাসিন্দাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

এই নিষেধাজ্ঞা চীনের চিপ শিল্পকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কেননা, চীন হার্ডওয়্যার এবং দক্ষ কর্মী উভয়ই অন্য দেশ থেকে আমদানি করে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরির লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেমিকন্ডাক্টর তৈরির কোম্পানিগুলোকে ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান এবং ভর্তুকি প্রদান করছে মার্কিন সরকার। এরই সুযোগ নিচ্ছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। তাইওয়ানের টিএসএমসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের দুটি প্ল্যান্টে বিনিয়োগ করছে, যা কি না তাইওয়ানের বাইরে তাদের একমাত্র কারখানা।

মাইক্রন নামে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম চিপ প্রস্তুতকারক কোম্পানি নিউইয়র্কের একটি চিপ কারখানায় আগামী ২০ বছরে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা চীনের দুর্বল জায়গায়ই আঘাত হেনেছে। নিষেধাজ্ঞা জারির পর অ্যাপল চীনের অন্যতম সফল চিপ কোম্পানি ইয়াংজে মেমোরি টেকনোলজিস কর্প থেকে মেমরি চিপ কেনার একটি চুক্তি বাতিল করেছে।

এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এত কিছুর পর চীন কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? উত্তর হচ্ছে না। চীন তার অভ্যন্তরীণ চিপনির্মাণ শিল্পের জন্য বিনিয়োগ এবং সমর্থন বাড়িয়ে দেবে। চীন তার নিজস্ব মার্কিন-মুক্ত সাপ্লাই চেইন গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে এবং ঠান্ডা অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু হবে, যা দেশগুলোকে পক্ষ বাছাই করতে বাধ্য করবে। অনেকেই চীনের বাজারেও প্রবেশের সুযোগ হারাবে।

লেখক: প্রভাষক।

এইচআর/ফারুক/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।