জাকসু নির্বাচন কী বার্তা দিলো?

আমীন আল রশীদ
আমীন আল রশীদ আমীন আল রশীদ , সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৪৮ এএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সম্ভবত এত নাটকীয়তা আর দীর্ঘসূত্রতার উদাহরণ তৈরি করেনি, যা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ-জাকসু নির্বাচনে। মাত্র ৮ হাজার ভোটারের ব্যালট পেপার গণনা করে ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল দিতে সময় লেগেছে দুদিনের বেশি। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে রসিকতা করে লিখেছেন, কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের দানবাক্সে জমা হওয়া কোটি কোটি টাকা দ্রুততম সময়ে গণনা করেন মাদরাসার যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা, তাদের দায়িত্ব দিলেও জাকসু ভোটের ফলাফল এর আগে পাওয়া যেতো!

মানুষের এই রসিকতার ভেতরে আছে রাগ, ক্ষোভ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অদক্ষতার প্রতি অসন্তুষ্টি। ৩৩ বছর পরে যে শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচন হলো, যে নির্বাচন নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী তো বটেই, দেশের সাধারণ মানুষেরও আগ্রহ ছিল –সেটিও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকল না।

অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পরে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই মানুষের মনে অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোয় সেই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হয়—সেটিও মানুষ দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু বলাই বাহুল্য, জাকসু এবং এর ঠিক আগে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু নির্বাচনও বিতর্কমুক্ত থাকেনি। অর্থাৎ দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে যেসব প্রশ্ন ও বিতর্ক অতীতে উঠেছে, সেই ঘেরাটোপ থেকে দেশের প্রাচীন দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ই যেখানে বের হতে পারেনি, সেখানে আগামী ফেব্রুয়ারিতে একদিনে তিনশ আসনে নির্বাচনে কী ঘটবে—তা হয়তো কিছুটা অনুমান করা যাচ্ছে।

ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের মধ্যে কয়েকটা মিল-অমিল রয়েছে।

১. ডাকসু নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলেও এখানে নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ভোট গণনা নিয়ে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলো খুব সুস্পষ্ট ও ব্যাপক নয়। কিন্তু জাকসু নির্বাচনে উত্থাপিত অভিযাগগুলো সুস্পষ্ট, ব্যাপক ও গুরুতর। যে অভিযোগে নির্বাচন কমিশনের দুজন সদস্য (অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার এবং অধ্যাপক স্নিগ্ধা রিজওয়ানা) এবং নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা তিনজন শিক্ষক (অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক শামীমা সুলতানা ও অধ্যাপক নাহরিন ইসলাম খান।) পদত্যাগ করেছেন, ভোট বর্জন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। বরং এখানে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দাবি করেছে, ভোটে কোনো অনিয়ম হয়নি। বরং ডাকসুতে পরাজিত প্রার্থী ও প্যানেলের পক্ষ থেকে উত্থাপিত মূল অভিযোগ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে ‘শিবির তোষণ’।

২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির সমর্থিত প্রার্থীরা পূর্ণ প্যানেলে জয়ী হয়েছেন মূলত তাদের রাজনৈতিক কৌশল এবং বিএনপির অতি আত্মবিশ্বাস, গত এক বছরে তাদের সম্পর্কে নানাবিধ নেতিবাচক খবর, শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিবিরের আধিপত্যসহ নানা কারণে। জাকসুতেও শিবির প্যানেলের আধিপত্য। এখানে ভিপি ছাড়া অধিকাংশ পদই তাদের দখলে। ভিপি হয়েছেন স্বতন্ত্র প্যানেলের আব্দুর রশিদ জিতু। তার জয়ে মূল ভূমিকা রেখেছে তার ব্যক্তিগত ইমেজ।

অর্থাৎ ভিপি পদে অন্য প্রার্থীরা জিতুর ইমেজকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। জুলাই আন্দোলনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে জিতুসহ একযোগে ১৮ জন সমন্বয়ক ও সহ-সমন্বয়ক পদত্যাগ করেন। ওই সময় জিতুর নেতৃত্বে পদত্যাগকারী কয়েকজন মিলে ‘গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। ওই সংগঠনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ, পোষ্য কোটা বাতিলসহ বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন জিতু। গণঅভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নেতিবাচক ভূমিকায় দেখা গেলেও ক্যাম্পাসে জিতু তার ইতিবাচক ভাবমূর্তি ধরে রেখেছিলেন।

৩. জাহাঙ্গীরনগরে ভোটের ফলাফলে দেখা গেছে, হল সংসদ নির্বাচনের অনেক পদেই প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। কোনো কোনো পদে প্রার্থীই ছিলেন না। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, হল সংসদের নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ আসলে কতটা?

যেহেতু ৩৩ বছর পরে এখানে ভোট হলো, সুতরাং পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে যে ধরনের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল, তাও জাহাঙ্গীরনগরে হয়েছে কি না সন্দেহ আছে। এর বাইরে শিক্ষকদের দলবাজি, বিশেষ একটি দলের প্রতি পক্ষপাতের বিষয়টিও ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে। সব অভিযোগ সত্য না হলেও এসব অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ারও সুযোগ নেই। যে দলবাজি দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটা বড় সংকট—নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরেও সেই সংকট নিরসনের যে কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না—এটিই বরং বেদনার।

৪. ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ১০ ঘণ্টা পরে। ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান ফেসবুকে লেখেন: ‘পরিকল্পিত কারচুপির এ ফলাফল দুপুরের পরপরই অনুমান করেছি। নিজেদের মতো করে সংখ্যা বসিয়ে নিন। এই পরিকল্পিত প্রহসন প্রত্যাখ্যান করলাম।’ স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে শিবির তোষণের অভিযোগ এনে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন মঙ্গলবার ভোর রাতের দিকে। কিন্তু জাকসুতে অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে ভোটগ্রহণের সময় শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন বর্জন করে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল। আরও চারটি প্যানেল ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়।

৫. ডাকসুতে ভোটার সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার এবং ভোট দিয়েছেন প্রায় ৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। অথচ এখানে হল সংসদ এবং কেন্দ্রীয় সংসদের পুরো ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ১০ ঘণ্টার মধ্যে। বিপরীতে জাহাঙ্গীরনগরে ভোটার ১২ হাজার। এর মধ্যে ভোট দিয়েছের প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থী। অথচ এখানে ভোট গণনা করতে লাগলো দুদিন।

৬. ডাকসুতে ভোট গণনা নিয়ে কোনো নাটকীয়তা বা গণনার পদ্ধতি নিয়ে কোনো ওঠেনি। কিন্তু জাকসুতে ভোট গণনার পদ্ধতি নিয়েই সমালোচনা হয়েছে। বিতর্কের মুখে ডিজিটাল পদ্ধতি বাদ দিয়ে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে হাতে গোনা হয়েছে।

৭. ডাকসুতে ব্যালট পেপার বা ভোটের পরে ভোটারের আঙুলে দেওয়ার জন্য অমোচনীয় কালি নিয়েও কোনো বির্তক ওঠেনি, যা উঠেছে জাকসুতে। এখানে অমোচনীয় কালির কারণে একজন ভোটার একাধিক ভোট দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কথা বলেই পাঁচজন শিক্ষক ভোটের দায়িত্ব থেকে সরে গেছেন। যদিও প্রক্টরের দাবি, নির্বাচনে কিছু বিচ্যুতি হলেও অনিয়ম হয়নি।

৮. জাকসুর ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পরে ফলাফল ঘোষণার সময় যা ঘটেছে, সেটিও অনেকের দৃষ্টি এড়ায়নি। যেমন- ফলাফল ঘোষণা শুরুর আগে নির্বাচন কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের বক্তৃতা চলাকালীন শিক্ষার্থীদের শোরগোল বেশ কানে লেগেছে। তিনি সবাইকে সালাম দেওয়ার পরে নমস্কার দিলেন। এরপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন গুড আফটার নুন। এ সময় অনেকেই বলে ওঠেন, ‘গুড আফটার নুন বাদ দিয়ে ভোটের ফলাফল দেন।’ তিনি ধীরলয়ে কথা বলছিলেন। কিছুটা রসাত্মক করে উপস্থাপনের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু বারবারই আওয়াজ আসছিল, দ্রুত ফল ঘোষণা করুন। তিনি জীবনানন্দের বনলতা সেন কবিতাটি পড়া শুরু করেন। তখন শোরগোলের ভেতরে শোনা যায় কেউ কেউ বলছেন: ‘খাইছে খাইছে।’ অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বলেন: ‘জীবনের সব সময় শীতকাল থাকে না। এরপর বসন্ত আসে। কবি শেলি বলেছেন…।’ তার এই কথা শেষ না হতেই আবার শোরগোল তৈরি হয়। শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘স্যার ভোটের ফল দেন।’ শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীদের এই আচরণ এবং এরকম পরিস্থিতিতে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকের কাণ্ডজ্ঞানও নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

৯. ভোটের ডামাডোল ও আনন্দের মধ্যে বিষাদ ছুঁয়েছে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর—উভয় ক্যাম্পাসকেই। ডাকসুতে নির্বাচনের খবর জানানোর সময় অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন এস টিভির সাংবাদিক তরিকুল ইসলাম শিবলী। আর জাকসুকে ভোট গণনার সময় অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস মৌমিতা।

পরিশেষে, জাকসুর ফলাফল যাই হোক না কেন, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা শিক্ষক ও কর্মকর্তারা যে অদক্ষতার পরিচয় দিলেন, সেটি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে খারাপ নজির হয়ে থাকবে। ভালো শিক্ষক মানেই তিনি ভালো প্রশাসক নাও হতে পারেন; শ্রেণিকক্ষে ভালো পড়ানো আর গবেষণায় সাফল্যের পরেও একজন শিক্ষক যে অন্য কাজও ভালো করবেন—সেটি নাও হতে পারে। ফলে কাউকে কোনো দায়িত্ব দেওয়ার আগে কর্তৃপক্ষের বোঝা দরকার তিনি বা তারা কাজটি পারবেন কি না। অর্পিত দায়িত্বটি সম্পর্কে তিনি নিজে কতটা ওয়াকিবহাল—সেটি জানা জরুরি।

যেহেতু ৩৩ বছর পরে এখানে ভোট হলো, সুতরাং পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে যে ধরনের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল, তাও জাহাঙ্গীরনগরে হয়েছে কি না সন্দেহ আছে। এর বাইরে শিক্ষকদের দলবাজি, বিশেষ একটি দলের প্রতি পক্ষপাতের বিষয়টিও ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে। সব অভিযোগ সত্য না হলেও এসব অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ারও সুযোগ নেই। যে দলবাজি দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটা বড় সংকট—নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরেও সেই সংকট নিরসনের যে কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না—এটিই বরং বেদনার।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।