বাংলাদেশের ধারণাগত ও সত্যিকারের ঝুঁকি মোকাবেলা


প্রকাশিত: ০৪:১৯ এএম, ২৪ জুন ২০১৭

ঈদের পরপরই গুলশান ক্যাফে হামলার এক বছর হতে চলেছে। ২০১৬ সালের ১লা জুলাইয়ের আগের বাংলাদেশ ও পরের বাংলাদেশ আর এক নয়। ফিরে আসছে এক বছর আগের গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় মুম্বই হানার স্মৃতি। সেই আগুন, সেই রক্ত, সেই অকারণ মৃত্যু। জিহাদের নামে খুন-ঝরানো এই ঘৃণা আজও কিন্তু বহাল তবিয়তেই।

অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে বসে একটা যুদ্ধ করছিল একটা পক্ষ।বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই বোঝা গেলো বাংলাদেশের মুক্তির যুদ্ধ অসমাপ্ত রয়ে গেছে। গুলি, বোমা, আগুন সব কিছু ব্যবহার করে বিভিন্ন জনপদে মানুষকে সন্ত্রস্ত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল সেই বিচারকে বানচাল করার জন্য। তারপর এলো পবিত্র রমজানের সেই দিন, যেদিন শহরের কূটনৈতিক অঞ্চলে জমজমাট এলাকায় ব্যস্ত সময়ে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, গুলি করে, চাপাতি দিয়ে হত্যা করা হলো আমাদের বিদেশি অতিথিসহ বহু মানুষকে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ যখন যাবতীয় রাজনৈতিক মতাদর্শ হতে বিযুক্ত হয়ে যায় তখন হামলার লক্ষ্য হয়ে ওঠে এমন সহিংস।

এ ধরনের যে-কোনও জঙ্গি হামলার পরেই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। আমাদেরও উঠেছিল। এই প্রশ্ন যারা করছিল, তাদের অন্তরে যতটানা ছিল দেশের জন্য উদ্বেগ, তারচেয় অনেক বেশি ছিল রাজনৈতিক প্রত্যাশা পূরণের আনন্দ। নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করা অবশ্যই সরকারের কাজ।কিন্তু এমন সুবৃহৎ ও ঘন জনসংখ্যার দেশে, আনাচেকানাচে সন্ত্রাসবাদীরা কবে কোথায় হানা দিবে, তা অনুমান করে আগাম প্রতিষেধক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রায় দুঃসাধ্য। সেই হামলার পর একের পর জঙ্গি খতমের খবরে জনগণ আস্থায় এসেছে যে, বাংলাদেশ জঙ্গিদের ঘাঁটি নয়।

গুলশান হামলার আগে একের পর এক চোরাগোপ্তা হামলা করে চাপাতির আঘাতে খুন করা হয়েছে লেখক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় মানুষকে। মুক্তচিন্তার গতিকে স্তব্ধ করতে লাগাতার আক্রমণের ফলে দীর্ঘ মৃত্যুমিছিল দেখেছে বাংলাদেশ।বিজ্ঞানভিত্তিক মুক্তচিন্তার বিপরীতে, লেখনীর জবাব পাল্টা লেখনী দিয়ে দিতে ব্যর্থ পশ্চাৎপদ চিন্তার মানুষেরা একের পর এক এসব খুন করেছে। যে চিন্তা, ভাবমূর্তি বা অনুভূতির নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য সহিংসতার আশ্রয় নিতে হয়, যুক্তিবাদী শান্তিপ্রিয় চিন্তাবিদদের কলম চিরতরে বন্ধ করে দিতে হয়, সে চিন্তা বা ভাবধারা যে কার্যত অচল এবং বাতিল, সেটার চূড়ান্ত রূপ গুলশান হামলা।

গুলশান হামলায় অভিযুক্ত পাঁচ তরুণের মধ্যে তিন জনই ঢাকার স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া করেছে দামি বেসরকারি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনজনই এসেছে স্বচ্ছল পরিবার থেকে। তারা বিশেষ সুবিধাভোগী এবং বেসরকারি ভাবে বাংলাদেশ ও বিদেশে শিক্ষিত। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগে রাষ্ট্রীয় উৎসাহে শিক্ষিত তরুণদের জঙ্গি বানিয়ে আফগানিস্তান পাঠানোর ঘটনা সবাই আমরা জানি। বলতে গেলে সেখান থেকেই সমাজের প্রভাবশালী অংশের সাথে সাম্প্রদায়িক উগ্র জঙ্গিবাদের এমন প্রত্যক্ষ মাখামাখি শুরু। তবে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়ার ঘটনা, হলি আর্টিজানই প্রথম।

যা বলছিলাম, ২০১৬–এর ১লা জুলাইয়ের আগে বাংলাদেশের মনস্তত্ব যা-ই থাকুকনা কেন, সেই ঘটনার পর একটা জাতীয় ঐক্য আর তাহলো সন্ত্রাস আর জঙ্গিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের কড়া অবস্থান চায় মানুষ। কোনও ছাড় চায় না। তবে সমস্যাটি যেহেতু রাজনৈতিক, রাজনীতির সমস্যাও ব্যাপক। শাসক দল আওয়ামী লীগের ঘরেও সমস্যা অনেক। এই দলের ভেতরে ১৯৭১-এর পরাজিত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি তথা বাংলাদেশ বিরোধী বহু নেতা-কর্মীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে দল থেকেই বলা হচ্ছে। এরাই দলটির প্রগতিশীল এজেন্ডা বদলে প্রতিক্রিয়াশীল পথে টানছে দলকে, এমন ধারণা এখন ব্যাপক।

প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কিছু না কিছু উগ্রবাদী দলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলছে। ২০১৩ সালের ৫ মে, হেফাজতের ঢাকা দখল কর্মসূচিকে বিএনপি, জামায়াতসহ যেসব রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠি এবং ব্যক্তি সমর্থন দিয়েছিল তারাই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সমর্থক। তাই উগ্রবাদের প্রতি দেশের বড় রাজনৈতিক দলের সমর্থন থাকলে তা দমানো সহজ কাজ নয়। বরং কৌশল করতে গিয়ে অনেক সময় তাদের ফাঁদে পা দিতে হয়।

মৌলবাদী শক্তি মোকাবিলা সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় এখন। কিন্তু কখনো কখনো মনে হয় একটা দ্বিধায়ও থাকে সরকার কি করতে হবে তা নিয়ে। একের পর পর লেখক ব্লগার খুন, পুরোহিত খুন, খ্রিস্টান যাজক খুনেরচেষ্টা, বিদেশি খুন, শিয়া ও আহমদিয়াদের উপর আক্রমণ যখন হচ্ছিল তখন সরকারকে অনেক বিব্রত ও বিচলিত দেখা গেছে। সরকারের এই অবস্থান মানুষকেও একটা সংশয়ে ফেলেছিল যে, এটাই বুঝি বাংলাদেশের নিয়তি। হলি আর্টিজানের হামলা মানুষকে যেমন সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছে, তেমনি সরকারকেও অনেক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

সমস্যাটি রাজনৈতিক। এই রাজনীতি দেশীয় রাজনীতি যেমন, তেমনি আন্তর্জাতিকও। দেশীয় রাজনীতি এ কারণে যে, এই টার্গেট কিলিং শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করতে গিয়ে। যারা আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ককে সামনে এনেছে তারাই হত্যা করছে, হত্যার সমর্থন দিচ্ছে, তারাই হেফাজতকে ঢাকায় এনেছিল, তারাই তাদের ডাকে সাড়া দিতে ঢাকাবাসীকে আহ্বান জানিয়েছিল। এবং তারাই জঙ্গি খতমে বিরোধিতা করছে নানা ছলচাতুরিতে।

কঠিন রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় সাফল্য লাভের সম্ভাবনা নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্ভব হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি কার্যকর করা গেছে, এর পেছনে সরকার, বিশেষ করে তার শীর্ষ পর্যায়ে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার কাজ করেছে বলেই।

জঙ্গিবাদ আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে বড় বিষয়। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক কাম্য নয়। যেকোনো দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটা বড় সংকট। বাংলাদেশে জঙ্গিরা বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পকেটে তৎপরতা চালালেও বৃহত্তর সমাজে শিকড় গাড়তে পারেনি। এর অন্যতম কারণ, এখানকার মানুষের সহিষ্ণু মনোভাব ও নারীর ক্ষমতায়ন।

আয়তনে বাংলাদেশ ছোট হলেও এর রয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠী। এত বড় সমাজে কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে জঙ্গি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এর জন্য রাজনৈতিক, শিক্ষাগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এমন বাস্তবতায় জঙ্গিবাদ নিয়ে সরকার তথা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার স্পষ্ট অবস্থান খুব জরুরি ছিল যা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।

জঙ্গিদের পুলিশী চাপে রাখতেই হবে, তার কোন বিকল্প নেই। তবে আবারো বলতে হচ্ছে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ নিরসন সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বাড়াতে হবে। এসব খুনিরা সংগঠিত আবার কোনো কোনো তরুণ জঙ্গি মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে ‘লিডারলেস’ জিহাদ শুরু করেছে।

দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক জাগরণের যে ডাক এসেছে তাকে এগিয়ে নিতে হবে। হলি আর্টিজানের হামলার পর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে সাড়া পড়েছিল তা ঝিমিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। চুপ করে গেলে হবে না, কারণ তারা চুপ করে নেই। প্রতিক্রিয়াশীল চক্র স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কোন কিছুই বাদ দিচ্ছে না, সর্বত্রই বিচরণ করছে।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।