শিক্ষার্থীরা কি পড়ছে কি করছে?

রিয়াজুল হক
রিয়াজুল হক রিয়াজুল হক , কলাম লেখক, ব্যাংকার
প্রকাশিত: ০৪:২৭ এএম, ১৮ অক্টোবর ২০১৭

১৯৯৮ সালের কথা। গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলের বাংলার শিক্ষক একদিন ক্লাসে তাঁর প্রিয় ছাত্র শংকরকে (ছদ্মনাম) জিজ্ঞেস করলেন, লেখাপড়া করে কি হতে চায়? শংকরের বাবা ছিলেন ভ্যানচালক। নবম শ্রেণির শংকর সেদিন বলেছিলেন, বাবার ভ্যান চালানো বন্ধ করতে চাই। ২০১৭ সালে শংকর একটি বহুজাতিক কোম্পানির বিভাগীয় প্রধান। তার বাবার ভ্যান চালানো বন্ধ করেছে এক যুগ আগে। সন্তানের কারণেই বাবাকে আর শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় না। সমবয়সী মানুষদের সাথে গল্প আর বিশ্রামেই কেটে যায় তার সময়।

প্রতিটি ছাত্রের প্রধান কাজ হচ্ছে লেখাপড়া করা। প্রধান কাজ যখন প্রাধান্য পায়, তখন অন্য বিষয়গুলো কখনো সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। ব্যতিক্রম কোন ঘটনার বর্ণনায় আমি যাবো না। লেখাপড়াকে ছাত্রজীবনের তপস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। লেখাপড়াই হবে ছাত্রদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য। ছাত্রজীবন নিজেকে গড়ার সময়। আদর্শ মানুষ হিসেবে, ভালো মানুষ হিসেবে। অনেক কিছুর পরিবর্তনের সাথে সাথে ছাত্রজীবনের উদ্দেশ্যও যেন পরিবর্তন হতে চলেছে। ছাত্রদের হাতে এখন অনেক কাজ। লেখাপড়াই যেন গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে লেখাপড়াকে তপস্যার সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে, সেই লেখাপড়া থেকে আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক দূরে চলে যাচ্ছে।

আমরা শিক্ষার মান নিয়ে কথা বলি, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যে লেখাপড়া থেকে দূরে সরে চলে যাচ্ছে, সে কথা বলতে ভুলে যাচ্ছি। সারা রাত ধরে মোবাইল ফোনে চ্যাটিং করে, সকাল বেলা ক্লাসে গেলে স্যারের কোন কথাই মাথায় ঢোকার কথা নয়। অভিভাবকরাও সন্তানকে দামি উপহার কিনে দেবার মাঝে সাফল্য খুঁজে বেড়ায়। তারা শিক্ষকদের কাছে যেয়ে বলেন না, আমার সন্তানকে মানুষ করে দেন। আর কিছু নামধারী শিক্ষকের কাছে শিক্ষা এখন বাণিজ্য ছাড়া কিছুই না। অর্থ উপার্জনই যেন মূল কথা।

বিশ-পঁচিশ বছর আগেও মাধ্যমিকে ৪৫/৫০ভাগ পরিক্ষার্থী পাস করতো। উচ্চ মাধ্যমিকে এই হার আরো কমে যেত। এখন নব্বই ভাগের উপরে মাধ্যমিকে পাস করছে। অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই শোনা যায়, এখন তো পরীক্ষা দিলেই পাস করা যায়। তবে এতো কষ্ট করে পড়ার দরকার কি? কথায় যুক্তি আছে। না মেনেও উপায় নেই। সার্টিফিকেট অর্জনই যদি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়, তবে রাত জেগে পড়ার দরকার কি? লেখাপড়া করতে হচ্ছে না। হাতের কাছে আছে উন্নত প্রযুক্তি। আজকের স্কুল কলেজে অধ্যয়নরত ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। ইন্টারনেট ছাড়া এসব মোবাইল আবার ব্যবহার অনুপযোগী। কি নেই সেখানে? তবে ভালো কিছু গ্রহণ করার মত বিচার বিবেচনা আদৌ কি এই বয়সী ছেলে মেয়েদের রয়েছে?
টেলিফোনের সংস্কৃতি আমাদের সমাজ থেকে এক রকম উঠেই গেছে। থাকলে হয়ত আমাদের সমাজের জন্য কিছুটা ভালোই হত। শিশু কিশোরদের বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ এবং আকর্ষণ দুটোই অনেক বেশি থাকে। তাই মোবাইল ব্যবহারে অনেককে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। অনেক অভিভাবকের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী দুজনই বাইরে কর্মরত থাকেন বিধায় সারাক্ষণ সন্তানদের খোঁজ খবর রাখা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এরকম অবস্থায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাচ্চাদের মোবাইল দেয়ার কথা ভাবেন অভিভাবকেরা।

তবে মোবাইল ফোন দেয়ার আগে তার বয়স উপযোগী মোবাইল ফোন পছন্দ করতে হবে। এরপর আমাদের ছাত্ররা ইভটিজিং, গ্যাংস্টার তৈরিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এর নানা কারণ রয়েছে। অসুস্থ প্রতিযোগিতা সর্বত্র বিদ্যমান। এছাড়া এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী মাদকের মাধ্যমে তরুণদের ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ঠিলে দিচ্ছে। এতে তাদের মনস্তাত্ত্বিক উন্নতি ঘটছে না। সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক মূল্যবোধের অভাবে ছাত্রদের একটি অংশ আজ বখাটে শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে।

এখন যারা শিক্ষার্থী, তারাই দেশের হাল ধরবে। তাই সবার আগে তাদের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। সাবধান করতে হবে সকল প্রকার ক্ষতিকর বিষয় সম্পর্কে। আমাদের নতুন প্রজন্মের সামনে আজ অনেক ধরনের আগ্রাসনের হাতছানি। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি সকলেরই বেশি আকর্ষণ থাকে। তথ্য-প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার তাদের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। বয়ঃসন্ধিকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই বয়সী ছেলে মেয়েদের প্রয়োজন সঠিক দিক নির্দেশনা। শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্যান্য বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি করে দিতে হবে। শিশু-কিশোরদের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিসীম। ছাত্রজীবনে লেখাপড়ার বিকল্প যে কিছু নেই, এটা তাদের বোঝাতে হবে।

সবশেষে ছাত্রজীবনে প্রাপ্ত একটি শিক্ষা দিয়ে লেখাটা শেষ করবো। সপ্তম শ্রেণিতে ক্লাসে একদিন অংকের শিক্ষক পরম শ্রদ্ধেয় মজিবর রহমান শেখ স্যার বলেছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রাত জেগে পড়ার জন্য হারিকেনের তেল চোখে লাগিয়ে নিতেন। এতে তাঁর চোখে জ্বলতো এবং ঘুম কেটে যেত। ফলে রাত জেগে পড়তে কষ্ট হতো না। মাদাম কুরি অর্থের অভাবে হোটেলে তিনি থালা বাসন পরিষ্কার করার কাজ করেছেন। কিন্তু লেখাপড়া থামিয়ে দেননি। তিনি দুইবার নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। তাঁরা কেউ আজ পৃথিবীতে নেই। কিন্তু সবাই তাদের মনে রেখেছে।

সবশেষে স্যার বলেছিলেন, তোমাদের লেখাপড়ার এই সময়টা খুব মূল্যবান। এখন সময় যদি নষ্ট করো, তবে জীবনের বাকিটা সময় আফসোস করে কাটাতে হবে। আর লেখাপড়া করলে করার মতো করতে হবে। লেখাপড়া খুব সহজ একটা বিষয়। তোমাদের নিয়ে বাবা-মায়ের প্রত্যাশা অনেক বেশি। তোমাদের জন্যই তাদের সকল পরিশ্রম। তাদের বৃদ্ধ বয়সে তোমরাই অবলম্বন হবে। কিন্তু সেজন্য নিজেদের সঠিকভাবে তৈরি করতে হবে। তাঁরা যেভাবে চায়, সেই ভাবে নিজেদের গড়ে তোলার চেষ্টা করো। কারণ বাবা-মা কখনো সন্তানের অমঙ্গল চায় না। স্যারের সেই কথাগুলো এখনো যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সবশেষে স্যার বলেছিলেন, ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ । একথা ভুলে গেলে চলবে না।

লেখক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
[email protected]

এইচআর/আইআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।