দিল্লির দাঙ্গায় মুসলিমদেরকে মুসলিম হত্যাকারী বানাচ্ছে মোদির সরকার

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১২:৫১ পিএম, ১১ জুন ২০২০

মনে আছে গত ফেব্রুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ ঢাকঢোল পিটিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দুই দিনের ভারত সফরে গিয়েছিলেন, আর ট্রাম্পের সফরের সংবাদের শিরোনামকে ছাড়িয়ে বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছিল দিল্লির হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা? কারণ ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ জুড়ে দিল্লির উত্তর-পূর্ব প্রান্তে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় অন্তত ৫৩ জন নিহত হয়েছিলেন, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলিম। এখন গত ৪ জুন সেই মুসলিম হত্যার ঘটনাবলি মুসলিমরাই করেছিল মানে দাঙ্গাটা মুসলমানরাই বাঁধিয়েছে এমনটা জানিয়ে চার্জশিট দিয়েছে দিল্লি পুলিশ।

অথচ সারা ভারত জানে, ঠিক তার আগের দু’মাস দিল্লিতে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ চলছিল। দিল্লির শাহীনবাগে মুসলিম নারী-শিশুরা অবস্থান করেছিল। তখন এটিকে নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যত রকম ঘৃণা ছড়ানো যায় সব করেছে বিজেপি এবং ভারতের হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী। বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরাও প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে নানা উসকানিমূলক বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছিলেন। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন ছিল সামনে। হিন্দু ভোটারদের একরোখা করে বিজয় অর্জনও ছিল বিজেপির লক্ষ্য। সে কারণে বায়ুদূষণের শহর দিল্লির বাতাসকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে আরও বিষাক্ত করা হয়েছে। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের মতো মুসলিম নির্যাতনকারীরাও এসেছিল হিংসা ছড়াতে। বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর এই প্রতিবাদকারীদের উদ্দেশ্য করেই জনসভা থেকে স্লোগান দেন ‘দেশের সঙ্গে যারা বেইমানি করছে তাদের গুলি করে মারা হবে।’

দিল্লির নির্বাচনে হেরে যাওয়া বিজেপিকে চূড়ান্তভাবে প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছিল শাহীনবাগের ঘটনা। তারা বারবার বলছে ট্রাম্পের সফরের পর এই সমাবেশ নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে। কপিল মিশ্র, যিনি তার সাম্প্রদায়িক এবং উদ্দীপক টুইটের জন্য পরিচিত, ২৩ ফেব্রুয়ারি উত্তর-পূর্ব দিল্লির মৌজপুর অঞ্চলে নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের পক্ষে একটি সমাবেশে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। স্পটটি ছিল শাহীনবাগের কাছে, যেখানে মুসলিমদের প্রতিবাদ চলছে। সমাবেশে মিশ্র দিল্লি পুলিশকে এই এলাকার রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য একটি ‘আলটিমেটাম’ দিয়েছিলেন, অন্যথায় তিনি বলেছিলেন, তাদের রাস্তায় আঘাত করতে হবে। তার উসকানির পরই শুরু হয়ে যায় মুসলমানদের ওপর পাথর ছুড়ে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ। ক্ষেত্র প্রস্তুত করা ছিল। পুলিশের ভূমিকায় সেটি রূপ নেয় দাঙ্গায়, যা পরের কয়েক দিন ধরে ছড়িয়ে পড়ে। সহিংসতায় অর্ধ শতাধিক মানুষ মারা গিয়েছিল, যাদের বেশিরভাগ মুসলমান।

কপিল মিশ্রের এই মন্তব্য সমালোচনার বাধা ফেলেছিল এবং দিল্লি হাইকোর্ট তাকে এবং অন্যান্য নেতাদের বিরুদ্ধে তাদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল এবং আদেশ দিয়েছে যে, অনুরাগ ঠাকুর ও পার্বশ ভার্মার বিরুদ্ধে মামলা করা হোক।

এক শুনানিতে বিচারপতি এস মুরালিধর ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, এমপি এবং বিধায়কসহ এই চারজন বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত হবে না? ক্ষতির জন্য আপনি এফআইআরে সম্পত্তি বিনষ্ট এবং অগ্নিসংযোগের কথা এনেছেন কিন্তু এই ভাষণগুলো কেন নিবন্ধভুক্ত করছেন না? আপনি কি এসবকে অপরাধ হিসেবে স্বীকার করতে চান না?’

এটি সহ্য হয়নি বিজেপি সরকারের। দিনে কোর্টে এমন কঠোর সমালোচনার পর রাতেই আদেশদাতা বিচারপতি এস মুরালিধরকে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে বদলির নোটিশ জারি করেছে সরকার, যা আরও একটি বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল।

দিল্লি দাঙ্গার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বিবিসি বাংলার দিল্লির সংবাদদাতা শুভজ্যোতি তখন তার রিপোর্টে বলেন, এটিকে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে পক্ষে-বিপক্ষের সমর্থকদের মধ্যে মারামারির ঘটনা বলে মনে হলেও, সেটি যে পুরোদস্তুর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা- তা নিয়ে এখন আর কেউ সন্দেহ করছেন না। নাগরিকত্ব আইন ছিল শুধুই একটা ছুতো। তিনি ২৬ ফেব্রুয়ারি বুধবার দুপুরের পর গিয়েছিলেন উত্তর-পূর্ব দিল্লির জাফরাবাদ এলাকায়, যেখানে সোমবার এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত হয়।

তিনি বলেন, বিস্তৃত এই এলাকাটিতে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। তাদের সিংহভাগই খেটে খাওয়া গরিব মানুষ। যমুনার ওপরের সেতু পেরিয়েই উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে ঢোকার পরপরই যেন মনে হলো একটা মৃত্যুপুরীতে ঢুকলাম। মূল সড়কের দু’পাশে সারি সারি দোকানের সব বন্ধ, কোনোটি আগুনে পোড়া, এখনও কোনোটি থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। তারপর মূল সড়ক থেকে গলির ভেতরে ঢুকেও মনে হচ্ছিল পুরো এলাকা যেন জনশূন্য।

তিনি বলেন, মানুষজন দরজা বন্ধ করে সব ঘরের ভেতর বসে আছেন। ভয়ে সিটিয়ে আছেন। এলাকার মুসলিমপ্রধান এলাকাগুলোতে শুধু বাড়ি-ঘরদোরেই নয়, অনেক মসজিদে হামলা হয়েছে, আগুন দেয়া হয়েছে। শুভজ্যোতি জানান, বহু মানুষ তাকে বলেছেন, সোমবার থেকে দুইদিন ধরে চলা এই সহিংসতার সময় পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয়। যে আতঙ্কের ছাপ তিনি উত্তর-পূর্ব দিল্লির মানুষের চোখেমুখে দেখেছেন তা সহজে যাবে বলে মনে হয় না।

এখন সর্বশেষ ওই দাঙ্গার ঘটনায় যেসব এফআইআর দায়ের করা হয়েছে বা গ্রেফতার হয়েছে- তাতে মনে করা স্বাভাবিক যে দিল্লি দাঙ্গার ষড়যন্ত্রকারীরা হলো নাগরিকত্ব আইনবিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট অথবা মুসলিম ছাত্রনেতা যারা সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নথিতে কেবল প্রতিবাদকারী, জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শাহীনবাগ এবং অন্যান্য জায়গায় যেখানে সিএএর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছিল সেখানে জড়িতদের ভূমিকা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু দিল্লি পুলিশের চার্জশিটে দাঙ্গা কীভাবে হলো, তা নিয়ে যে দীর্ঘ ঘটনা পরম্পরা বর্ণনা করা হয়েছে তাতে বিজেপি নেতাদের ঘৃণা ছড়ানো বক্তৃতার কোনো উল্লেখই নেই। ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে ২৫ ফেব্রুয়ারি অবধি চলমান ঘটনাবলির ওপর ২,০০০ শব্দের রিপোর্টে পুলিশ কপিল মিশ্রসহ বিজেপি নেতাদের বক্তৃতার কথা কোথাও উল্লেখ করেনি। তাতে এটা স্পষ্ট যে, মোদি-অমিত শাহের পুলিশ তদন্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে।

দিল্লির দাঙ্গাপীড়িতদের হয়ে অনেকগুলো মামলা লড়ছেন মানবাধিকার আইনজীবী কলিন গঞ্জালভেস। তিনি বিবিসির কাছে অভিযোগ করেন, ‘দাঙ্গার সময় পুলিশের বিরুদ্ধেই মারধর, অগ্নিসংযোগ বা ভয় দেখানোর অন্তত আশি-নব্বইটা অভিযোগ এসেছে, কিন্তু পুলিশ একটারও এফআইআর নিতে রাজি হয়নি।’

এটা থেকে আরও স্পষ্ট যে মোদি সরকারের গোদি মিডিয়া হিসেবে চিহ্নিত টিভি চ্যানেলগুলো যেভাবে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের দেশদ্রোহী সাজানো হয়েছিল- দিল্লি পুলিশও ঠিক সেই লাইনেই তদন্ত করেছে। অথচ ওই প্রতিবাদ ছিল নাগরিকদের সমানাধিকারের দাবিতে একটা সিভিল রাইটস মুভমেন্ট। আর দিল্লি পুলিশের চার্জশিট পড়লে মনে হচ্ছে মুসলিমরা এতই চালাক আর ক্ষমতাশালী যে তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর দাঙ্গা চালিয়েছে!

দাঙ্গা মামলায় পুলিশ এখনও পর্যন্ত ৭৮৩টি প্রথম এফআইআর এবং ৭০টি চার্জশিট বা অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। ৭০টি চার্জশিট থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে বিজেপি নেতারা দাঙ্গায় উসকানির অভিযোগ থেকে শেষ পর্যন্ত রেহাই পেয়েই যাবেন। চূড়ান্ত চার্জশিট জমা দেয়ার জন্য দিল্লি পুলিশ যে কোর্ট থেকে ৯০ দিনের সময় পেয়েছে তার অবশ্য এখনও কিছুটা বাকি আছে। আগামী দিন তারা আরও কাকে কাকে ফাঁসায় দেখার বাকি আছে। মোদির সরকার হয়তো ভাবছে এখন করোনাকাল চলছে, লোকজন দাঙ্গা ভুলে গেছে। এই সুযোগে যা পার ইচ্ছামতো কর।

অবশ্য যে পুলিশ নিজেরাই এই দাঙ্গায় ‘গাদ্দার মারায়’ অংশ নিয়েছে, মোদি-অমিত শাহের যে সাম্প্রদায়িক সরকারের আমলে গত বছরের ৫ আগস্ট কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করার মাধ্যমে বিজেপি ভারতে মুসলিম নির্যাতনের নতুন যাত্রাটি শুরু করেছিল এবং এখন ২০ কোটি মুসলিমকে গৃহহীন, রাষ্ট্রহীন করার চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে- তাদের কাছে দিল্লি দাঙ্গার ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করা চূড়ান্ত বোকামি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।