কতটুকু মনে রেখেছি কিংবদন্তি নারী সুলতানা কামালকে?
ডা. গোলাম শওকত হোসেন
স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর হতে চললো। বিশ্বনারী দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে সারাদেশে পালিত হলো। কিন্তু আমাদের মাঝে-মার্চ মাসে কজন স্মরণ করেছিলাম এ দেশের এক কিংবদন্তি নারী সুলতানা কামালকে? তিনি ছিলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী যিনি ১৯৭০ ইং সালে ব্লু পেয়েছিলেন। যদিও আমাদের নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে মারিয়া শ্যারাপভার টেনিস থেকে অবসরে যাওয়ার কথা। আমাদের পাশের দেশে “ভাগ মিল্কা ভাগ”, সুরমা বা “মহেন্দ্র সিং ধনির” মত খেলেয়াড়দের নিয়ে চলচিত্র নির্মাতারা ছবি তৈরি করেন আর আমাদের দেশে নির্মাতারা সত্য ঘটনা অবলম্বনে কাহিনী খুঁজে পান না। যাক সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য।
সুলতানা কামালের জন্ম হয়েছিল ১০ ডিসেম্বর ১৯৫২ সালে বা ভাষা আন্দোলনের বছর। বাসা ছিল বক্শীবাজার বর্তমান বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের পাশে যদিও সেটা তখন পরিচিত ছিল ইডেন কলেজ নামে। তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকার পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে নাজিমুদ্দিন রোডের মুসলিম গার্লস হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি নয় ভাইবোনের মাঝে ছিলেন অস্টম ও তিনি বোনের মাঝে সর্বকনিষ্ট। ডাক নাম ছিল তার খুকি। তার বড় বোন খালেদা বানু স্কুল ও কলেজ জীবনে পারদর্শী ছিলেন খেলাধুলায়। সম্ভবত তিনিই ছিলেন সুলতানা কামালের আইডল। বাবা দবীর উদ্দিন আহ্ম্মেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চীফ এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ছিলিন, ১৯৬৯ সালে সে ইডেন কলেজ বা বর্তমান বদরুন্নেসা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোসিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। গণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন পরোক্ষভাবে।
২
অধ্যাবসায়ের সাথে ক্রীড়া অনুশীলন চালিয়ে যান নিয়মিত। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার স্প্রিট, ১১০ মিটার হার্ডেল্স, লং জাম্প ও হাই জাম্পে সেরা হয়ে মেয়েদের মাঝে চ্যাম্পিয়ান হন এবং ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী ব্লু অজর্ন করেন।
১৯৭১ ইং সালে যুদ্ধকালীন সময়ে তার এক ভাইকে, যার নাম ছিল বাবুল, তাকে রাজাকারেরা উঠিয়ে নিয়ে যান। তিনি আর ফেরত আসেননি। সম্পূর্ণ পরিবার দিশেহারা হয়ে গ্রামের বাড়ি মাতুয়াইলে চলে যান। কিন্তু পরোক্ষ ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বদা সহায়তা করেন।

স্বাধীনতার পর সুলতানা কামাল যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে তাঁর শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে আবারও টি-শার্ট, ট্রাউজার/শর্টস আর স্নিকার পরে সবুজ মাঠে ফিরে আসেন। অনার্স পড়াকালে ১৯৭৩ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া রুরাল গেমসে তিনি রানার আপ হন- নতুন রেকর্ড গড়ার মাধ্যমে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় অ্যাথেলিটিক প্রতিযোগিতায় ১১০ মিটার হার্ডেল্সে, হাই জাম্প ও লং জাম্পে নতুন রেকর্ড করে নারী চ্যাম্পিয়ানশিপের ট্রফি ছিনিয়ে নেন।
১৯৭৫ সালে মাস্টার্স কোর্স চলাকালীন সময়ে তিনি পারিবারিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক ও ঢাকা আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম শেখ কামালের সঙ্গে। বিয়ের কিছুদিন পরই তিনি মাস্টার্সের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে মৌখিক পরীক্ষার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাত্রিতে এদেশেরই কিছু বিপথগামী সৈনিকের হাতে পাশবিকভাবে খুন হন সুলতানা কামাল, স্বামী, দেবর, শাশুড়ি, আত্মীয় পরিজন এমনকি বঙ্গবন্ধুসহ, স্বয়ং বঙ্গবন্ধু ভবনে অর্থাৎ ধানমন্ডির ৩২ নং রোডস্থ বাড়িতে।
সদা প্রফুল্ল ও হাস্সোজ্জ্বল যে নারীর বিচরণ ছিল খোলা আকাশের নিচে আর শ্যামল ঘাসের উপর; কায় -মনবাক্যে যিনি ধারণ করতেন ক্রীড়া শৈলী ও ক্রীড়া শিল্পকে, চোখ বন্ধ করলেও হয়তো যিনি শুধু সোনালী মেডেলের ঝলক দেখতেন, আর হাতে ছিল তার সদ্য বিবাহোত্তর মেহেদীর রং এর আভা। সেই মানুষটি আচমকা রাইফেলের ট্রিগারের শব্দ আর আগুনের স্ফুলিংগের সংগে বেরিয়ে আসা সোনালী বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্তে রঞ্জিত হয়ে না ফেরার দেশে চিরতরে চলে গেলেন, কিছু বুঝে উঠার আগেই।

সুলতানা কামাল বেগম রোকেয়ার স্বপ্নকে আবার প্রমাণ করেছিলেন মেয়েরা “অবরোধ বাসিনী“ নয়। সেই অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশের মেয়েরা কবি নজরুল ইসলামের ভাষায় তাই আজও উচ্চ স্বরে গায় “ জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা......” আর বিজয়ের কেতন উড়ানোর নেশায় বিচরণ করে চলছে, ঢাকা থেকে দিল্লি, কাঠমুন্ডু, কলম্বো, বার্লিন, লন্ডন বা সিডনিতে। এই সাহসী নারীদের দিয়েই সফল হচ্ছে আজ বাংলাদেশে জাতিসংঘের এসডিজি প্রোগ্রামের নারী ক্ষমতায়নের কর্মসূচি।
তাই কিংবদন্তি সুলতানা কামালের মেডেল আর ট্রফিগুলোর উপর যতই ধুলার প্রলেপ পড়ুক না কেন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় প্রকোষ্ঠে তার গৌরবময় অর্জন সবসময় স্বর্ণোজ্জল হয়ে থাকবে।
লেখক : চিকিৎসক, শিক্ষক, গবেষক ও লেখক।
এইচআর /এমকেএইচ