রাজনীতির বিশৃঙ্খলা সড়কেও

মোনায়েম সরকার
মোনায়েম সরকার মোনায়েম সরকার , রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১২:১১ পিএম, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

দেশের রাজনীতিতে শৃঙ্খলা নেই, এটা বললে অনেকে হয়তো কিছুটা হকচকিয়ে যাবেন। ভাববেন- আরে, দেশের রাজনীতি তো বেশ ক’বছর ধরে সুশৃঙ্খল অবস্থায়ই আছে। বিরোধী দলের মাঠ গরম করা আন্দোলন নেই, জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী হরতাল-অবরোধ নেই, নেই ভাঙচুর-জ্বালাও-পোড়াও-বোমা-গুলি-লাশ।

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে টানা তিনবার ক্ষমতায় থেকে রেকর্ড তৈরি করেছে। বাংলাদেশে কোনো স্বৈরশাসকও দশ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। পাকিস্তানে আইয়ুব খান উন্নয়নের দশক পালন করেছিলেন বটে, কিন্তু তার পরেই বেজে উঠেছিল তার বিদায়ের ঘণ্টা। অথচ শেখ হাসিনা তিন মেয়াদের ১৫ বছর যে টানা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন, এটা বিস্ময়কর বৈকি!

শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার বাসনা কারো নেই, তা নয়। বিএনপি তো পারলে এখনই তাকে ক্ষমতা থেকে ঠেলে ফেলে দেয়। কিন্তু শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, তাকে ও তার দলকে ধাক্কা দিয়ে ক্ষমতা থেকে ফেলে দেওয়া সহজ নয়।

তাহলে তো বলতেই হয়, রাজনীতিতে শৃঙ্খলা বিরাজ করছে। সাদা চোখে দেখলে এটা ঠিক যে, বাংলাদেশে গত ক’বছর ধরে তেমন রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। অস্থিরতা না থাকাই কি আসলে শৃঙ্খলা? আমার মনে হয়, ভেতরে ভেতরে আমাদের রাজনীতি প্রকৃতপক্ষে বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যেই আছে। আর সেটা টের পাওয়া যায় জাতীয় নির্বাচন কাছাকাছি এলে।

আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছি, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও উদযাপন করেছি। নানা উত্থান-পতন পেরিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি মজবুত অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির প্রশংসা করছে বিদেশিরাও। আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে ক্রমেই আমরা আমাদের পরিচয় উজ্জ্বল করে তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছি। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। আংশিকভাবে চালু হয়েছে মেট্রোরেল।

কর্ণফুলি নদীর নিচে ট্যানেল নির্মাণের কাজও শেষ হওয়ার পথে, এখন উদ্বোধনের অপেক্ষা। পাতাল রেলের কাজও শুরু হচ্ছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতাও বাংলাদেশ অর্জন করেছে। যদিও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি সঙ্কট দেখা দেওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে; কিন্তু এটা বৈশ্বিক সমস্যার অভিঘাত। আশা করা যায়, জ্বালানি সমস্যা কাটানোর উপায় বের করে দ্রুতই বাংলাদেশ বিদ্যুৎ সঙ্কট সমাধানে সক্ষম হয়ে উঠবে।

তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, ৫১ বছরেও আমরা একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। এটা রাজনৈতিক শৃঙ্খলাহীনতারই ফল। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাসের সঙ্কট প্রবল। কেউ কাউকে আস্থায় নিতে পারে না। এ সঙ্কট সমাধানে বাস্তবভিত্তিক কোনো উদ্যোগও নেই। দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা দুই হাতের আঙুলে গুনে শেষ করা যায় না, কিন্তু ভোটের মাঠে অনেক দলই নিখোঁজ।

রাজনীতি মূলত দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক ধারার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, অন্য ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএনপি। এই বড় দুই দলের বিবাদ দেশের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলারও অন্যতম প্রধান কারণ। এই যে দেশের জনসমর্থনপুষ্ট প্রধান দুটি দলের মধ্যে বিবাদ চলছে, তার জন্য কার দায় বেশি বা কম- সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, এই বিবাদের ভার বহন করা দেশের জন্য ক্রমে দুঃসহ হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার জের ছড়িয়ে পড়ছে আরো নানা ক্ষেত্রে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও সমস্যায় জর্জরিত। সব কিছু সংখ্যার বিচারে বাড়ছে, গুণমান বিচারে নয়। সড়কের বিশৃঙ্খলা প্রতিদিন কেড়ে নিচ্ছে অনেকের জীবন। সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। জানুয়ারি মাসেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪৬ শিক্ষার্থী। ২০২২ সালে ৮৮৫ শিক্ষার্থীর করুণ মৃত্যু হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়।

এই যে সম্ভাবনাময় এত তরুণের জীবন কেড়ে নিল সড়ক, এর জন্য কি আমরা কেউ সামান্যতম বিচলিত বোধ করেছি? এসব দুর্ঘটনায় যারা মারা গেছেন, তাদের পরিবারগুলোর কান্না-হাহাকার কি আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনে সামান্য হেরফের ঘটায়? আমরা বরং সবকিছু মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। অথচ প্রতিবাদী জাতি হিসেবে এক সময় আমাদের সুনাম ছিল।

৫ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘সড়কে প্রাণ গেল অদম্য মেধাবী জাহাঙ্গীরের’ শিরোনামের খবরটি পড়ে চোখের পানি সংবরণ করা কঠিন। শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার কলসপাড় ইউনিয়নের পিপুলেশ্বর গ্রামের ২৮ বছরের জাহাঙ্গীর আলম এক দরিদ্র জেলে পরিবারের সন্তান। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়ায় তিনি প্রথম আলো ট্রাস্ট থেকে বৃত্তি পেয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

জাহাঙ্গীরের স্বপ্ন ছিল, সরকারি চাকরি করে দরিদ্র পরিবারে সংসারের হাল ধরবেন। কিন্তু ১ ফেব্রুয়ারি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা উল্টে গিয়ে মৃত্যু হয় জাহাঙ্গীরের। সঙ্গে সঙ্গে তার সব স্বপ্ন নষ্ট হয়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় যাদের প্রাণ যাচ্ছে, তাদের সব পরিবারেরই তো স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হচ্ছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা আমরা দেখি না। কার গোয়াল, কে দেয় ধোঁয়া!

সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। তিনি আওয়ামী লীগেরও সাধারণ সম্পাদক। প্রতিদিন গণমাধ্যমে বা আওয়ামী লীগ আয়োজিত সভা-সমাবেশে বক্তৃতা করতে হয়। প্রতিপক্ষ দল বিএনপির মুণ্ডুপাত করেন। বিএনপিকে আন্দোলনে ফেল নম্বর দিয়ে এক ধরনের তৃপ্তিবোধ করেন। কিন্তু প্রতিদিন যে সড়কে গড়ে ২০ জন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, সে ব্যাপারে কোনো কথা বলেন না। কেউ যদি তার মন্ত্রণালয়ের পারফরম্যান্স বিবেচনায় নিয়ে মন্ত্রী হিসেবে তাকে ফেল বলেন, সেটা নিশ্চয়ই তিনি খুশিমনে মেনে নেবেন না। কিন্তু দুর্ঘটনার দায়-দায়িত্ব কাউকে না কাউকে তো নিতে হবে। না হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে কী করে?

সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, আট বছরের মধ্যে গত ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশে আন্দোলন কম হয়নি। বিশেষ করে চার বছর আগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেশজুড়ে তোলপাড় তৈরি করেছিল।

সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরার আশা করা হলেও বাস্তবে তা হয়নি। ২০২২ সালে দেশে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত ও ১২ হাজার ৩৫৬ জন আহত হয়েছেন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে।

সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছেন, আহত ও নিহতের এই সংখ্যা গত ৮ বছরে সর্বোচ্চ। একই সময়ে রেলপথে ৬০৬টি দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত, ২০১ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া নৌপথে ২৬২টি দুর্ঘটনায় ৩৫৭ জন নিহত, ৩৫৭ জন আহত এবং ৭৪৩ জন নিখোঁজ হয়েছেন।
সড়ক, রেল ও নৌপথে সর্বমোট ৭ হাজার ৬১৭টি দুর্ঘটনায় ১০ হাজার ৮৫৮ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৮৭৫ জন আহত হয়েছেন। জানা গেছে, ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে সড়কে দুর্ঘটনা ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং প্রাণহানি ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় কেন এত মানুষকে অকালে জীবন দিতে হচ্ছে? এর কি কোনো প্রতিকারের উপায় নেই? দেশে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। রাস্তাঘাট বাড়ছে। সুন্দর সুন্দর সড়ক তৈরি হচ্ছে। মানুষের যাতায়াতও স্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। অর্থনৈতিক কারণে বা জীবন-জীবিকার জন্যও মানুষের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বেশি যেতে হচ্ছে। এজন্য যানবাহনের সংখাও বাড়ছে।

গত আট বছরে নিবন্ধিত যানবাহনের পাশাপাশি ছোট যানবাহন, বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা চারগুণ বেড়েছে। পাশাপাশি সরকারি আদেশ অমান্য করে ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলার জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে গত ৮ বছরের মধ্যে ২০২২ সালে সড়কে সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে বলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে শুধু একটি পরিবারে দুঃখ ও হাহাকার নেমে আসে তা নয়, দেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়ে। দুর্ঘটনায় নিহত, আহত ও তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক ক্ষতির হিসাব তৈরি করেছে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট। এ প্রতিষ্ঠানের হিসাবে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল- এ তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা।

চালকের বেপরোয়া মনোভাব, বিপজ্জনক পাল্লাপাল্লি, সড়কের বেহাল অবস্থা, ফিটনেসবিহীন গাড়ির চলাচল, চালকের অদক্ষতা, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতার জন্যই মূলত সড়ক দুর্ঘটনা হয়ে থাকে। এছাড়া রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখল হওয়া, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ বা আইন অমান্য করা, সড়কে চাঁদাবাজি, রাস্তার পাশে হাটবাজারের কারণেও দুর্ঘটনা হয়।

দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতির দিকে যাওয়ায় দেশব্যাপী নিরাপদ ও আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থার কথা কেন অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে না? প্রশ্ন আরও অনেক করা যায়, কিন্তু উত্তর দেবেন কে? ভারতে একদা রেল দুর্ঘটনার দায় নিজের ওপর নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন সংশ্লষ্ট মন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। ভারতেও এখন সেটাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে অনুসরণ করা হয় বলে মনে হয় না। কিন্তু তাতে করে পরিস্থিতির অবনতিই ঘটতে থাকবে।

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
লেখক : রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।

এইচআর/জিকেএস

সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। প্রতিপক্ষ দল বিএনপির মুণ্ডুপাত করেন। বিএনপিকে আন্দোলনে ফেল নম্বর দিয়ে এক ধরনের তৃপ্তিবোধ করেন। কিন্তু প্রতিদিন যে সড়কে গড়ে ২০ জন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, সে ব্যাপারে কোনো কথা বলেন না। কেউ যদি তার মন্ত্রণালয়ের পারফরম্যান্স বিবেচনায় নিয়ে মন্ত্রী হিসেবে তাকে ফেল বলেন, সেটা নিশ্চয়ই তিনি খুশিমনে মেনে নেবেন না। কিন্তু দুর্ঘটনার দায়-দায়িত্ব কাউকে না কাউকে তো নিতে হবে। না হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে কী করে?

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।