খালেদা জিয়ার প্রয়াণ

নয়া বন্দোবস্তের জমানায় রাজনীতিতে নারীর অবস্থান ফিকে হয়ে আসছে

শাহানা হুদা রঞ্জনা
শাহানা হুদা রঞ্জনা শাহানা হুদা রঞ্জনা
প্রকাশিত: ০৯:৫৬ এএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫

লেখাটা যখন প্রেসে দেয়ার জন্য তৈরি, ঠিক তখনই খবর পেলাম বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ইন্তেকাল করেছেন। একজন গৃহবধূ থেকে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন তিনি নিজের যোগ্যতা বলে। পরিবেশ, পরিস্থিতি, সমাজ তাঁকে নেত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছিল। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি তাঁর দল নিয়ে ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয়। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

এই বাংলাদেশে ১৯৯১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নারী নেতৃত্বে ছিলেন। অথচ এরপরেও একথা সত্য যে নারীরা রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্ত অবস্থানে আসতে পারেনি। কিন্তু কেন? আমরা নারী উন্নয়নের কথা বলি, নারীকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখি। আদতে আমাদের সমাজের কতজন মানুষ নারীকে সত্যিকার অর্থে স্বনির্ভর দেখতে চান? কতজন নারী নিজেকে স্বাধীন ও স্বনির্ভর হিসেবে ভাবতে পারেন? পারিবারিক পরিমণ্ডলের বাইরের সমাজ নারীর নেতৃত্ব মেনে নিতে কতটা প্রস্তুত?

সবচাইতে সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের আমল। এইসময়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেসব সংস্কার কমিশন হতে দেখলাম, দেখলাম নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের মিটিং হতে, সেখানে কোথাও নারীর অবস্থান খুঁজে পাইনি। অথচ বিগত সরকার বিরোধী আন্দোলনে পুরুষদের পাশাপাশি অসংখ্য নারী রাজপথে আন্দোলন করেছেন, আহতও হয়েছেন অনেকে। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পেয়েছেন শুধু পুরুষ আন্দোলনকারীরা। তাদের কার, কী যোগ্যতা ছিল বা তারা কতটা কাজ করতে পেরেছেন সে আলোচনায় না গেলেও বলা যায় জাতি আশাব্যঞ্জক কিছু পায়নি।
তবে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং খেলাটা দেখালো এনসিপি। দলটি জামায়াতে ইসলামির সাথে কেন জোটবদ্ধ হলো এ নিয়ে প্রেস কনফারেন্সে সব পুরুষ সদস্যরা পাশাপাশি বসে বয়ান দিলেন। সেখানে একজন নারী সদস্যেরও উপস্থিতি চোখে পড়লো না। এখন প্রতিদিনই দেখছি একজন করে নারী নেত্রী এনসিপি থেকে ঝরে পড়ছেন। মাত্র দেড় বছরের মধ্যে কী এমন ঘটলো যে মেয়েদের বের হয়ে আসতে হচ্ছে। কারো কোনো উচ্চকিত কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে না। অবশ্য অনেকে বলছেন হিসাব-নিকাশ শেষ তাই মেয়েরাই আর থাকতে চাইছেন না। সেই হিসাবটা কী আমরা জানি না, শুধু এটুকু জানি এদেশের রাজনীতিতে নারীর জায়গা করে নেয়া খুব সহজ নয়। ত্রিশ সেট অলংকার হিসেবে উঠে আসা সহজ কিন্তু সত্যিকার লড়াইয়ের ময়দানে নিজের দলই স্পেস দিতে চায় না।

নারী রাজনৈতিক ময়দানে কথা বললেও তাকে ঘায়েল করা হচ্ছে নোংরা কথা বলে। ফলে অনেকে নিজের ইচ্ছাতেই রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। ২০২৪ এ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নারী জাগরণ নিয়ে যে আশা তৈরি হয়েছিল, অনেকের মধ্যে তা কার্যত, ফিকে হয়ে যাচ্ছে। নতুন রাজনীতি ও সংস্কারের কথা বলে সেই পুরোনো বন্দোবস্তই জারি থাকলো।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীরা শীর্ষ পর্যায়ে থাকলেও সাধারণ নারী রাজনীতিবিদদের টিকে থাকা এবং স্থায়ীভাবে প্রভাবশালী হওয়া বেশ কঠিন। এর পেছনের কারণগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে ২০২৪ এর আন্দোলনে নারীরা এত উচ্চকিত থাকার পরেও কেন চুপসে গেলেন।

এই সমাজ এখনও মনে করে রাজনীতি "পুরুষের কাজ”। নারীদের রাজনীতিতে আসা বা টিকে থাকাকে অনেকে "অনুপযুক্ত" বা "ঘরের বাইরে বেশি সময় কাটানো" হিসেবে দেখেন। পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপে অনেক নারী মাঝপথেই রাজনীতি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। যে নারীরা নির্বাচনে জিতেছেন বা টিকে আছেন, তাদের অধিকাংশেরই নিজস্ব বা পারিবারিক সম্পদ আছে। আছে পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য।

বাংলাদেশে রাজনীতিতে নারীর টিকে থাকতে না পারার কারণ কোন একক কিছু নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও মানসিকতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক দলের অসহিষ্ণু কাঠামো এবং নিরাপত্তাহীনতা। ২০২৪-এর আন্দোলনে নারীরা ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে এসে দেখা গেল সম্ভাবনা থাকলেও পরিবর্তন সেই অনেক দূরেই রয়ে গেল। অনেকেই বলেছেন ২০২৪ এর আন্দোলনে নারী অংশ না নিলে বিজয় অর্জন সহজ হতো না। নারী আন্দোলনকারীরা ছিল জয়ের নির্ণায়ক।

অথচ আমরা দেখলাম সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, রাজনৈতিক পুনর্গঠন ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় নারীদেরকে কোণঠাসা করা হলো। আন্দোলন সফল হওয়ার পর ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভক্তি বেড়ে গেল। অন্তর্বর্তী সরকারও নারী শক্তিকে বাদ দিয়ে শুধু পুরুষ নেতাদের বাছাই করে রাজ্যপাট চালু করে। অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকারও রাজনীতি ও সরকার পরিচালনায় পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে বিশ্বাসী।

অন্যদিকে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে মতাদর্শগত ও নেতৃত্বের দ্ব›দ্ব বেড়ে যাওয়ায় নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ কমে যায়। নারী কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে স্বীকার করেছেন নারীর মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিল না, তাদের মতামত প্রকাশের জায়গাও ছোট হয়ে আসছিল এবং বেড়ে যাচ্ছিল পুরুষ নেতাদের প্রাধান্য। কেউ কেউ গণমাধ্যমের সামনে বলেছেন, একটা সময় তাদের মনে হয়েছিল যে তারা ব্যবহৃত হচ্ছেন বা হয়েছেন।
নারীশক্তি, নারীশক্তি বলে আমরা যতোই উদ্বেলিত হই না কেন, দেশের রাজনীতিতে এখনো চলছে পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা। ২০২৪ আন্দোলনের সময় নারীরা সাহস দেখালেও, ক্ষমতায় যাওয়ার সময় তাদের বাদ দেওয়া হয়।

পরবর্তীতে যখন সংস্কার কমিশন গঠনের কাজে হাত দেওয়া হয়, তখনও দেখা গেছে কমিশনের প্রধান হিসেবে পুরুষ সদস্যরাই অগ্রাধিকার পেয়েছেন। এমনকি নারী ইস্যুকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি। নারী সংস্কার কমিশন যখন তাদের রিপোর্ট পেশ করলেন, তা এক ফুৎকারেই উড়িয়ে দেওয়া হলো। তাদের উপস্থাপিত কোনো ধারণা বা প্রস্তাবও গ্রহণ করা হয়নি। পাশাপাশি বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা। নারীর কথা, প্রয়োজন, দাবি, নিপীড়ন কোনোটাই মূল্য না পাওয়ায় নারীবাদী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো হতাশা ব্যক্ত করেছে।

সব আন্দোলনেই নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকে। প্রকাশ্যে দেখা যায় নারীর নেতৃত্ব, সাহস, স্বতঃস্ফূর্ততা ও ঐক্য। কিন্তু ধীরে ধীরে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ হ্রাস পেতে থাকে। নারীকে সাইডলাইন করার চেষ্টা চোখে পড়ে। ২০২৪ এর আন্দোলনের পর নারী-পুরুষ বিভক্তি, মৌলবাদী পরিবেশ, পুরুষ কর্মীদের প্রাধান্য ও অন্তর্বর্তী সরকারে খুব কম নারী প্রতিনিধিত্ব নারীকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলে। নারীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হলো বৈষম্যবিরোধী বিপ্লবের ফল ভোগ করছে পুরুষরা।

নারী আন্দোলনকারীরা ভেবেছিলেন ভবিষ্যতে নির্বাচন ও স্থায়ী সরকার গঠনের সময় নারীর প্রকৃত অংশগ্রহণ থাকবে। কারণ তা না হলে অর্থাৎ নারীর প্রকৃত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারলে ফলাফল ভালো হবে না। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার পর তরুণদের নয়া সংগঠন এনসিপির ভ‚মিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে জামাতের সাথে জোট করার কারণে এনসিপির নেতৃত্বে থাকা নারী সদস্যরা একে একে ঝরে পড়ছেন বা দল ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। নতুন বন্দোবস্তের রাজনীতিতেও নারীর সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছে।

এর আগে রাজনৈতিক দলে ও সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্য নারী প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত আসন পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। সে পদ্ধতির ফলে সংসদে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটেনি। ২০২৪ এর জুলাই আন্দোলনে নারীর বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ দেখে অনেকেই মনে করেছিলেন এইবার নারী অ্যাক্টিভিস্টরা নিঃসন্দেহে নিজ যোগ্যতায় পদ ও পদবি পাবেন। রাজনৈতিক অঙ্গণে নারীর জোরালো পদচারণা দেখা যাবে। সবার মধ্যেই প্রত্যাশা ছিল যে জুলাই-পরবর্তী রাজনৈতিক সংস্কারের আলোচনা ও নীতি নির্ধারণে নারীদের দৃশ্যমান ও কেন্দ্রীয় ভূমিকা থাকবে।

কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি অন্য কথা বলছে। রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে নারীরা অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকলেন। মিছিলে, মিটিং এ অংশ নেয়া ছাড়া তেমন আর কোনো ভূমিকা চোখে পড়ছে না। কথা বলছেন পুরুষ, শুনছেন পুরুষ, বিবৃতি দিচ্ছেন পুরুষ, ঐক্য গড়ছেন তারাই। তাহলে অ্যাকটিভ নারীরা কোথায় হারিয়ে গেলেন? অন্যদিকে দিনে দিনে বেড়েছে নারীর চলাচলের পথে অন্তরায়, ধর্ষণ, সহিংসতা, সাইবার বুলিং।
সমাজে নারীর অবস্থা যখন এই, তখন রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। সহিংস পরিস্থিতি নারীকে মাঠে নামতে নিরুৎসাহিত করে। মাঠে যুদ্ধ করার পর যদি ফসল চলে যায় পুরুষদের হাতে, তাহলে সেই মাঠে নারী কেন থাকবে? তাছাড়া আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, এমনকি নারীদের একটা বড় অংশও রাজনীতিতে নারীদের আসাকে নিরুৎসাহিত করেন।

রাজনৈতিক দলগুলোও কী চায় নারী নির্বাচনে আসুক? দলগুলো নির্বাচনি ময়দানে সবসময়ই নারীকে আসন ছেড়ে দিতে অনীহা প্রকাশ করে থাকে। এই যে জুলাই সনদ নিয়ে এতো কথা, কিন্তু সেই জুলাই সনদও স্বাক্ষর করা হলো, নারীর সরাসরি নির্বাচনের কোনো পদক্ষেপ ছাড়াই, মাত্র ৫ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের বাধ্যবাধকতা রেখে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াতেও নারীর অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে।
বাংলাদেশের রয়েছে নারী আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস। কিন্তু সবই স্তিমিত হয়ে যায়, যখন নারীকে উপেক্ষা করে পেছনে ফেলে রাখা হয়।

এমনিতেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলে নারীদের জায়গা করে নেয়া সহজ নয়। এর উপর যখন সমাজ বৈরী থাকে, মৌলবাদী শক্তির উত্থান হয়, তখন রাজনীতির ময়দানে নারীর এগিয়ে যাওয়া আরো কঠিন হয়। মাঠপর্যায় থেকে রাজনীতি করে নারীরা একটি দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত যেতে পারবে তখনই, যখন পরিবার, সমাজ ও অর্থনৈতিক শক্তি তাদের অনুক’লে থাকবে।

নারী সবসময়ই চেষ্টা করে শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসতে কিন্তু শেষপর্যন্ত টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে যায়। রাজনীতির মূল ধারায় নারীর মুখ খুবই নগণ্য। সংসদ কিংবা স্থানীয় সরকারেও নারীর সংখ্যা কম। বর্তমান সময়ে নারীর বিরুদ্ধে সাইবার বুলিং আরো বেড়েছে।

নারী রাজনৈতিক ময়দানে কথা বললেও তাকে ঘায়েল করা হচ্ছে নোংরা কথা বলে। ফলে অনেকে নিজের ইচ্ছাতেই রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। ২০২৪ এ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নারী জাগরণ নিয়ে যে আশা তৈরি হয়েছিল, অনেকের মধ্যে তা কার্যত, ফিকে হয়ে যাচ্ছে। নতুন রাজনীতি ও সংস্কারের কথা বলে সেই পুরোনো বন্দোবস্তই জারি থাকলো।

৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫

লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।