মঞ্চ থেকে পর্দা, বাবু এক জীবন্ত চরিত্র
দেখতে সাধারণ, কথাবার্তায় বিনয়ী, চালচলনে সংযত। কিন্তু পর্দায় বা মঞ্চে তিনি যেন এক বিস্ফোরক চরিত্র, চোখের ভাষা, মুখের অভিব্যক্তি আর শরীরী ভাষায় জীবন্ত করে তোলেন যে কোনও রোল। অভিনয়ের এমন ঈর্ষণীয় দক্ষতা নিয়ে যিনি এসেছেন দর্শকের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি, তিনি ফজলুর রহমান বাবু। ২২ আগস্ট জন্ম নেওয়া এই গুণী মানুষটি শুধু একজন অভিনেতা নন, তিনি একাধারে গায়ক, নাট্যকর্মী, সিনেমার শিল্পী, টেলিভিশনের পরিচিত মুখ এবং লোকগানের প্রেমিক। ছবি: ফেসবুক থেকে
-
ফজলুর রহমান বাবুর জন্ম কুষ্টিয়ায়, তবে বেড়ে ওঠা ফরিদপুরে। অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা তার শৈশব থেকেই।
-
মঞ্চনাটক দিয়ে শুরু, এরপর আসেন ঢাকা থিয়েটারের ছায়ায়। এই থিয়েটারই তাকে গড়ে তোলে। ‘শকুন্তলা’, ‘কোকিলারা’, ‘বাহার’, ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’-মঞ্চে একের পর এক চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে অভিনয় করে তিনি মন জয় করেন নাট্যাঙ্গনের মানুষদের।
-
মঞ্চে নিজের শিকড় মজবুত করে এরপর তিনি টেলিভিশন নাটকে আসেন। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তার ঝলক দেখতে শুরু করে ছোট পর্দার দর্শক। সেই থেকে আজ অবধি প্রতিটি পারফরম্যান্সে তিনি যেন নিজেকে নতুনভাবে হাজির করেছেন।
-
ফজলুর রহমান বাবুর অভিনয়ে এক ধরনের ‘জীবন্ততা’ থাকে। চরিত্রটি যদি বোকা হয়, সে যেন সত্যিকারের বোকা; চরিত্রটি যদি কুটিল হয়, দর্শক বিশ্বাস করে সে ঠিক তেমনই। এমন বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় তার সহজাত শক্তি।
-
টেলিভিশনের পাশাপাশি তিনি সিনেমায়ও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি। ‘মনপুরা’, ‘গহীনে শব্দ’, ‘দেহরক্ষী’, ‘বিষ্যুদবার’, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ কিংবা সাম্প্রতিক ‘হাওয়া’ সবখানেই তার চরিত্রগুলো আলাদা আলো ছড়িয়েছে। কখনও তিনি হাসির খোরাক, আবার কখনও নির্মম বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
-
তার উপস্থিতি এতটাই শক্তিশালী যে অনেক সময় মূল চরিত্রকেও ছাপিয়ে যায়। ‘নির্বাক অভিব্যক্তি’ দিয়ে পুরো দৃশ্য নিজের করে নেওয়ার এমন ক্ষমতা খুব কম শিল্পীর আছে।
-
ফজলুর রহমান বাবুকে নিয়ে কথা হলে শুধু অভিনয় নয়, গানকেও ভুলে যাওয়া যায় না। লোকগানের প্রতি তার অদ্ভুত টান। ‘মজলিশপুরের গম্ভীরা’, ‘ভাড়াটিয়া’, ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানগুলো শুধু শ্রোতার কানে যায়নি, গেঁথে গেছে তাদের মনেও। তার কণ্ঠে ধরা পড়ে গ্রামের গন্ধ, মাঠের হাওয়া, মানুষের গল্প। গায়ক বাবু যেন আরেক রূপে শিল্পচর্চার অঙ্গনে ঘোরেন।
-
বাবুর সবচেয়ে বড় শক্তি তার চরিত্র নির্বাচনে সচেতনতা। তিনি চিরকাল সহশিল্পী, চরিত্রাভিনেতা। নায়ক নন, কিন্তু দর্শকের ভালোবাসা যে কোনও নায়কের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি কখনও বড় চরিত্রের জন্য লালায়িত নন। বরং ছোট ছোট দৃশ্যেও তিনি এমন নিখুঁতভাবে নিজেকে মেলে ধরেন, যে চরিত্রটি দর্শকের মনে রয়ে যায় দীর্ঘদিন। ‘মনপুরা’ সিনেমায় কুটিল বাবার চরিত্র, কিংবা ‘হাওয়া’ ছবির মৎস্যজীবী-সবখানে তিনি আলাদা, অথচ অসাধারণভাবে সত্য।
-
শিল্পজগতের বাইরেও বাবু একজন পরিপূর্ণ মানুষ। তিনি ক্যামেরার সামনে যতটা প্রাণবন্ত, ক্যামেরার পেছনে ততটাই বিনয়ী। পর্দায় তাকে দেখে কেউ ভাবতেও পারবে না, তিনি কতটা সাদামাটা জীবনে বিশ্বাসী। তাকে নিয়ে অহংকার করে বাংলাদেশের নাট্য ও চলচ্চিত্রাঙ্গন। কারণ, তিনি প্রমাণ করেছেন নায়ক না হয়েও, তারকাখ্যাতি ছাড়াও, একজন শিল্পী হয়ে ওঠা যায়, যদি তাতে থাকে নিষ্ঠা, সাধনা ও ভালোবাসা।