সালমান শাহ: অকালপ্রয়াণে থেমে যাওয়া এক তারার ঝলক
বাংলা সিনেমার রূপালী পর্দায় এমন এক নক্ষত্রের আবির্ভাব হয়েছিল, যিনি এলেন, ঝলমল করলেন আর হঠাৎই হারিয়ে গেলেন। কিন্তু তার আলোর রেখা আজও মুছে যায়নি দর্শকের চোখ থেকে। তিনি সালমান শাহ, যিনি ছিলেন নব্বই দশকের তরুণদের স্বপ্ন, মেয়েদের হৃদয়ের নায়ক আর চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে এক অদম্য আশার প্রতীক। জন্ম নিয়েছিলেন ১৯৭১ সালে, অথচ মাত্র ২৫ বছরের জীবনেই এমন এক ইতিহাস লিখে গেছেন, যা দীর্ঘ ক্যারিয়ারেও অনেক তারকা রেখে যেতে পারেননি। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তার চলে যাওয়া যেন শুধু একজন অভিনেতার মৃত্যু নয়, ছিল লাখো দর্শকের আনন্দ-স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার দিন। সেই শূন্যতা আজও পূরণ হয়নি, হবেও না। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া থেকে
-
নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা চলচ্চিত্র যখন একরকম ছায়ার নিচে হাঁটছিল, তখনই আবির্ভূত হন সালমান শাহ। তার প্রথম ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ (১৯৯৩) শুধু ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করেনি, বরং দর্শকের চোখে নতুন নায়কের স্বপ্ন বুনে দিয়েছিল।
-
রোমান্টিক, মার্জিত ও স্টাইলিশ চরিত্রে তিনি যেন একেবারেই ভিন্ন ছিলেন। সেই সময়ের প্রচলিত মেলোড্রামাটিক ভঙ্গি বা আক্রমণাত্মক নায়কসুলভ ইমেজকে ছাপিয়ে তিনি এসেছিলেন এক অনন্য আধুনিকতায়।
-
সালমান শাহ ছিলেন নায়কের নতুন সংজ্ঞা। তার পোশাক, চুলের স্টাইল, কথা বলার ভঙ্গি, এমনকি হেঁটে যাওয়ার ছন্দ-সবকিছুই তখনকার তরুণদের কাছে ছিল ফ্যাশনের মাপকাঠি।
-
ঢাকাই চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো দেখা গেলো এমন এক নায়ককে, যাকে যুবকরা অনুসরণ করছে এবং মেয়েরা স্বপ্নের মানুষ হিসেবে কল্পনা করছে। তিনি ছিলেন ট্রেন্ডসেটার, যিনি ফিল্মের সীমা ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিলেন সাধারণ জীবনের আদর্শে।
-
মাত্র চার বছরের ক্যারিয়ারে ২৭টির মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন সালমান শাহ। প্রতিটি সিনেমায়ই তিনি আলাদা করে চিহ্নিত হয়েছিলেন। ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘সুজনা’, ‘দেনমোহর’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘অন্তরে অন্তরে’ কিংবা ‘স্বপ্নের পৃথিবী’-প্রতিটি ছবিতেই তিনি নায়ক মানেই কেবল শক্তিশালী শরীরী ভঙ্গি নয়, বরং আবেগ, আন্তরিকতা আর ভালোবাসার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
-
শাবনূরের সঙ্গে তার জুটিই ছিল সর্বাধিক জনপ্রিয়, যা এখনো রোমান্সের স্বর্ণালী অধ্যায় হিসেবে আলোচিত হয়।
-
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে এক শোকাবহ দিন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে অপ্রত্যাশিতভাবে নিভে যায় এক দীপ্তিমান প্রদীপ। তার মৃত্যু এখনো রহস্যময়, নানা বিতর্ক ও গুঞ্জন ঘিরে রেখেছে। কিন্তু নিশ্চিত বিষয় হলো, সেই দিনটিতেই দর্শক হারিয়েছিল তাদের প্রিয়তম নায়ককে।
-
সালমান শাহর ক্যারিয়ার সংক্ষিপ্ত হলেও প্রভাব ছিল ব্যাপক। তার পরবর্তী প্রজন্মের নায়করা অনেকেই তাকে অনুসরণ করেছেন, কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের দীপ্তি আর সহজাত আকর্ষণ অনুকরণযোগ্য ছিল না। চলচ্চিত্রে দর্শক টানার এক বিশেষ শক্তি তিনি তৈরি করেছিলেন, যা আজও অনুপস্থিত বলে মনে করেন অনেকে।
-
১৯৯৬ থেকে আজ পর্যন্ত কেটে গেছে প্রায় তিন দশক। কিন্তু সালমান শাহ এখনো সমান প্রাসঙ্গিক। ইউটিউব বা সামাজিক মাধ্যমে তার গান, সিনেমার দৃশ্য কিংবা সাক্ষাৎকারগুলো ভেসে বেড়ায়। নতুন প্রজন্মও বিস্মিত হয়, কীভাবে এত অল্প সময়ে একজন মানুষ এত গভীর ছাপ রেখে যেতে পারেন।
-
সালমান শাহকে বলা হয় বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। কিন্তু সেই নক্ষত্র খুব দ্রুতই মিলিয়ে গেছে রাতের আকাশে। আজও তার আলো পৌঁছায় কোটি ভক্তের হৃদয়ে। হয়তো তার জীবনী ছোট, কিন্তু তিনি প্রমাণ করেছেন সময় নয়, মানুষের ভালোবাসাই একজন শিল্পীর প্রকৃত আয়ুষ্কাল।